বস্তি গুঁড়িয়ে দারিদ্র আড়াল করা গেল কিঃ জি-২০

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত করবেন। আচ্ছা, শক্তিশালী অর্থনীতি বলতে প্রধানমন্ত্রী কি বুঝিয়েছেন– দেশের ১৪০ কোটি মানুষের আর্থিক উন্নয়ন? তাদের হাতে কাজ, পেটে ভাত, মাথায় ছাদের ব্যবস্থা? এমনটা যদি কেউ বোঝেন তবে তিনি ডাহা ভুল করবেন। যাঁরা এমনটা বোঝেন তাঁদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য জি-২০ সম্মেলনের প্রস্তুতি পর্বে গত চার মাস ধরে দিল্লি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার দরিদ্র মানুষের বসতিগুলি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিল মোদি-প্রশাসন। যেগুলি কোনও প্রকারে টিকে গেল সেগুলি ঢেকে দেওয়া হল পুরু কাপড় আর প্রধানমন্ত্রীর বিরাট বিরাট ছবি লাগানো কাটআউট দিয়ে। আর এ ভাবেই সম্মেলনে আসা বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের কাছে ‘দারিদ্রমুক্ত’ ভারতকে তুলে ধরলেন প্রধানমন্ত্রী আর তার সরকার।

জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে বিদেশি অভ্যাগতদের চোখে ‘উজ্জ্বল’ ভারতের ছবি তুলে ধরতে শুধু দিল্লির সৌন্দর্যায়নেই খরচ করা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। রাস্তায় বসেছে লেজার আলো, বসেছে ফোয়ারা, নানা রকমের মূর্তি থেকে ফুলের টব, কয়েক দিনের মধ্যে পোঁতা হয়েছে কয়েক হাজার গাছ। দিল্লি সহ দেশের সর্বত্র টাঙানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখের ছবি সহ সুশোভিত পোস্টার। অন্যদিকে এই উজ্জ্বলতার উল্টো পিঠে যে বাস্তব ভারতের অন্ধকার চিত্র, তা ঢাকতে বলি দেওয়া হচ্ছে দিল্লির হাজার হাজার গরিব মানুষকে। তাদের ঝুপড়ি, বস্তি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে উচ্ছেদ করেছে সরকার, অথবা সুদৃশ্য আচ্ছাদনে ঢেকে দিচ্ছে। চোখের সামনে একচিলতে আশ্রয়, নিত্যব্যবহার্য জিনিস গুঁড়িয়ে যেতে দেখে তারা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলছেন, আমরা কি মানুষ নই? অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটছে আশ্রয়হীন, রোজগারহীন অসংখ্য মানুষের। এমনকি ফুটপাথবাসীদের জন্য শীত ও বর্ষায় মাথা গোঁজার ঠাঁই ‘রেন বসেরা’ (রাত্রি নিবাস)– তাও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ফ্লাইওভারের তলায় ঘুমনো মলিন চেহারার হতদরিদ্রদের উচ্ছেদ করে ঝাঁ চকচকে করা হয়েছে শহর। সব আয়োজনের একটাই উদ্দেশ্য, বিদেশি প্রতিনিধিরা যাতে ভারতের দারিদ্র দেখতে না পায়। দিল্লির দারিদ্র আড়াল করতে কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার খরচ করেছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

শুধু তাই নয়, ৮-১০ সেপ্টেম্বর দিল্লির একটা বড় অংশে কার্যত লকডাউন ঘোষিত হয়েছে। কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে সেনাবাহিনীর বন্দুকের নলের মুখে রাখা হয়েছে দিল্লির বাসিন্দাদের। স্কুল-কলেজ-দোকানপাট-অফিস-আদালত সব বন্ধ। ওই তিন দিন সবাইকে ঘরের মধ্যে থাকার নির্দেশ জারি করেছে প্রশাসন। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ দু’বেলা না বেরোলে যাদের পেটে গামছা বেঁধে থাকতে হয়, তাদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। দিল্লির নানা বস্তি এলাকা, ফুটপাত ছাড়াও দিল্লি লাগোয়া নয়ডা এলাকার বস্তিও ঢেকে দেওয়া হয়েছে ত্রিপল দিয়ে। মেট্রো স্টেশন সহ রাস্তার দু’পাশের দোকানদারদের বাধ্য করা হয়েছে ধার কর়ে হলেও দোকান রঙ করতে। যদিও সেই দোকান ওই তিন দিন খোলা চলবে না। জি-২০কে ‘জনসাধারণের আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেছে বিজেপি সরকার, বস্তি উচ্ছেদ করেই কি তারা জনসাধারণকে যুক্ত করলেন!

এই বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ঝুপড়ি, দোকান ভাঙার কাজ শুরু হয়। ১ এপ্রিল থেকে চার মাসে দিল্লি জুড়ে ৪৫টি উচ্ছেদ অভিযান চলেছে। ঝুপড়িবাসীদের ভোটার কার্ড, আধার কার্ড থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন তাদের বেআইনি জবরদখলকারী বলে তাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারি জমি খালি করার নামে জি-২০ কে অজুহাত করে বুলডোজার দিয়ে চলছে উচ্ছেদ অভিযান। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দিল্লির ২ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ গৃহহীন ছিল। বাস্তবে সংখ্যাটা দেড় লক্ষের কাছাকাছি। তাঁদের জন্য অস্থায়ী মাথা গোঁজার ঠাঁইও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই উচ্ছেদ অভিযানে আরও লক্ষাধিক মানুষ গৃহহারা হলেন।

কাজের আশায় সারা ভারত থেকেই বহু দরিদ্র মানুষ দিল্লির ফুটপাতে, ঝুপড়িতে আশ্রয় নিয়ে দিন গুজরান করেন। সরকারি, বেসরকারি নানা কাজ সম্পন্ন করতে ঠিকাদাররা এদের উপরই ভরসা করে। বহু উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের ভরসাও এরাই। সেই গৃহহীন মানুষগুলির রুটি-রুজি বন্ধ হওয়ায় দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোটানোও দুষ্কর। এরা থাকবে কোথায়, খাবে কী– তা নিয়ে প্রশাসন বা সরকারের কোনও উচ্চবাচ্য নেই।

আসলে ভারতে জি-২০ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার মধ্য দিয়ে বিজেপি সরকার চাইছে একদিকে আমেরিকা-চিনের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক সুপার-পাওয়ার হিসেবে বিশ্ববাণিজ্যে ফয়দা তুলতে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে কম দামে তেল ও অস্ত্রের ব্যবসা বাড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বে পেশি আস্ফালন করতে। আসলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে শক্তিশালী অর্থনীতি মানে শক্তিশালী একচেটিয়া পুঁজি। দেশের মানুষের দৈন্যদশা নিয়ে সরকারের কোনও হেলদোল নেই।

একদিকে বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্রে জর্জরিত দেশের মানুষ, অন্যদিকে বিজেপির জাত-পাত-সম্প্রদায়ের বিভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। শাসক বিজেপি সম্পর্কে মানুষ মোহমুক্ত হচ্ছে, তা বিজেপি নেতাদের অজানা নয়। নিজেদের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও যাতে উজ্জ্বল করা যায়, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে যাতে জি-২০-র চাকচিক্য দিয়ে ঢাকা যায়, তার চেষ্টা করছে বিজেপি সরকার। শুধু বিদেশিদের সামনে নয়, জৌলুসে চোখ ধাঁধিয়ে দিতে চেয়েছে দেশের মানুষেরও।

কিন্তু পারল কি ঢাকতে? ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপানের বড় বড় সংবাদপত্রে বস্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার খবর ছেপেছে। তাতে রয়েছে রাজধানীর দরিদ্র বস্তির করুণ বিবরণ। স্বাভাবিক ভাবেই শত চেষ্টাতেও দারিদ্রের বাস্তব চিত্র ঢাকা যায়নি। সুদৃশ্য ত্রিপলের টুকরো ফাঁক দিয়ে তা ঠিক বেরিয়ে এসেছে।