ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার দায় প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে

দক্ষিণ ২৪ পরগণার জয়নগর

বালেশ্বরের ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ভারতীয় রেল ব্যবস্থার ভেতরের ভেঙে পড়া অবস্থাটাকে একেবারে নগ্ন করে দিল। তবে সেই চেহারা সামনে এল প্রায় চারশো মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং হাজারের বেশি মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে। প্রধানমন্ত্রী থেকে রেলমন্ত্রী সকলেই তাঁদের শাসনে রেল ব্যবস্থার কী বিরাট উন্নয়ন হয়েছে তাঁর লম্বা ফিরিস্তি সুযোগ পেলেই দেশের মানুষকে শুনিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে সপ্তাহে গড়ে দুটি করে বন্দে ভারত ট্রেনের উদ্বোধন করে চলেছেন। প্রচারের সবটুকু আলো শুধুমাত্র নিজের উপরই যাতে পড়ে তার জন্য রেলমন্ত্রী বা অন্য কাউকে এ মহান কাজটি তিনি করতে দেন না। প্রতিবারই কখনও দীর্ঘ, কখনও নাতিদীর্ঘ বত্তৃতায় ডিজিটাল ভারত, গতিশীল ভারতের গল্প শোনান। গত এক বছর ধরে রেলের খবর মানে শুধুই বন্দে ভারত। অথচ দেশের রেল ব্যবস্থার সিংহভাগ যে এক্সপ্রেস, সুপার এক্সপ্রেস বা লোকাল ট্রেনগুলি, সেগুলির দুরবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা দেশের মানুষকে জানতেও দেন না। যাঁরা এই ট্রেনগুলিতে নিত্য যাতায়াত করেন একমাত্র তাঁরাই এই নরকযন্ত্রণার সাক্ষী। যখন এই রকম কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তখনই একমাত্র দেশের মানুষ জানতে পারে কী ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলছে ভারতীয় রেল ব্যবস্থা।

এই মুহূর্তে রেলে প্রায় ৩ লক্ষ পদ খালি। এর মধ্যে একটা বড় অংশই নিরাপত্তা সংক্রান্ত। ট্রেন চালকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম থাকায় নিয়ম ভেঙে বহু সময়ই চালকদের ১২ ঘণ্টার বেশি ডিউটি করানো হয়। কখনও প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে টানা ডিউটি করানো হয়। এই দায়িত্বে যে মনঃসংযোগ দরকার, অতি পরিশ্রমের ফলে বহু সময়ই তা ব্যাহত হয়।

গত বছর অনেক শোরগোল তুলে রেলমন্ত্রী অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম বা ‘কবচ’ ব্যবস্থা চালুর কথা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর থেকে সরকার ক্রমাগত এমন প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যাতে যে কারও মনে হবে দেশের গোটা রেল ব্যবস্থাটাই বোধহয় এই নিরাপত্তার বলয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে। বাস্তবে প্রায় ৭০ হাজার কিলোমিটার রেল লাইনের এখনও মাত্র এক হাজার কিলোমিটারেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনগুলির কোনওটিতেই সেই কবচ নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। থাকলে হয়তো এতগুলি মানুষের প্রাণ এমন বেঘোরে চলে যেত না। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন যুদ্ধকালীন দ্রুততায় পুরো রেল ব্যবস্থায় এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হল না?

রেল কর্তারা রুটিন মাফিক উত্তর দিয়েছেন, অর্থাভাবেই তা করা যায়নি। সত্যিই কি অর্থাভাব? প্রথমত, ব্যাপক দুর্নীতি সত্ত্বেও ভারতীয় রেল একটি লাভজনক সংস্থা। দ্বিতীয়ত, করোনার সুযোগ নিয়ে সরকার রেলে যাত্রীদের থেকে বহু সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। যেমন, প্রবীণ যাত্রীরা যে সুযোগ পেতেন তা বন্ধ করে দিয়েছে এবং নির্লজ্জের মতো তার ফলে কত টাকা বাঁচাতে পেরেছে তা ফলাও করে প্রচার করেছে। গত কয়েক বছরে প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম দ্বিগুণ করেছে। বহু প্যাসেঞ্জার ট্রেনকে সুপারফাস্ট নাম দিয়ে কয়েক গুণ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়াও ডায়নামিক প্রাইসিংয়ের (তৎকাল, প্রিমিয়াম তৎকাল) নাম করে যাত্রীদের থেকে যথেচ্ছ টাকা আদায় করে চলেছে রেল। এই টাকা কোথায় যাচ্ছে?

রেল ব্যবস্থার অতি প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য নাকি টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বহু পুরনো ট্রেন বদলানো হয় না, ভাঙাচোরা কামরাগুলি বদলানো হয় না, সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নতি করা হয় না, লাইনগুলির নিয়মিত নজরদারি, ওয়েলডিংয়ের কাজ ব্যাহত হয়। এর ফলে বালেশ্বরের মতো এত বড় দুর্ঘটনা নিয়মিত না ঘটলেও ছোটখাটো দুর্ঘটনা অজস্র ঘটে চলেছে। গত এক বছরে ৪৮টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে যাতে রেলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবার তেমন বড় ক্ষতি না হওয়া দুর্ঘটনার পরিমাণ ছিল ১৬২টি। যখনই কোনও বড় দুর্ঘটনা ঘটে, মন্ত্রীরা দুঃখ দুঃখ মুখ করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং একটি তদন্ত কমিশন ঘোষণা করেন। তারপর কোনও দিন হয়তো তদন্তের রিপোর্ট বের হয়, কখনও হয়তো তা-ও হয় না। হলেও সেই রিপোর্ট কোনও এক ফাইলে বন্দি হয়ে থাকে। তারপর সব কিছু যেমন চলছিল তেমনই চলতে থাকে।

যাত্রী নিরাপত্তায় টাকা নেই, অথচ প্রধানমন্ত্রী ‘২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেই দুশোটি শহরের মধ্যে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বন্দে ভারত চালানোর যে ঘোষণা করেছেন তার জন্য টাকার কোনও অভাব হচ্ছে না। কারণ সেগুলি প্রধানমন্ত্রীর মহান কীর্তি হিসাবে প্রচারিত হচ্ছে। এই বন্দে ভারত কাদের জন্য? অন্তত সাধারণ মানুষের জন্য তো নয়। এই ট্রেনের ভাড়া সাধারণ এক্সপ্রেস ট্রেনের থেকে ৫ গুণ বেশি। এই ট্রেনের বিশেষত্ব কী? এতে যাত্রীরা নাকি দারুণ রকমের গতি, আরাম এবং সুবিধা পাবেন। ট্রেনের গতি নাকি ১৬০-১৭০ কিমি প্রতি ঘণ্টায়। সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে, বাস্তবে ট্রেনগুলি চলছে ৭০ কিমি গতিবেগে। কারণ আলাদা কোনও লাইনে নয়, পুরনো লাইনেই চলছে ট্রেনগুলি। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, নতুন চালু করা কোনও বন্দে ভারতে এসি কাজ করছে না, কখনও প্রয়োজনীয় জল থাকছে না, কখনও পচা কিংবা বাসি খাবার দেওয়া হচ্ছে। আর বুলেট ট্রেন তো প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন! সেই স্বপ্নে বুঁদ হয়ে না থেকে প্রধানমন্ত্রী যদি দেশের সিংহভাগ মানুষ যে সব ট্রেনে নিত্য যাতায়াত করেন, সেগুলিতে মানুষের সুস্থভাবে যাতায়াতের ব্যবস্থা করতেন তবে প্রচারের কৃত্রিম আলো টানার জন্য তাঁকে এত ফিকির খুঁজতে হত না, মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই তাঁর প্রশংসা করতেন। কিন্তু তিনি তো দেশের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি নন যে তাদের সুযোগ-সুবিধার জন্য ব্যাকুল হবেন! বরং ধনী, পুঁজিপতি, শিল্পপতিদের জন্য আরও কত বেশি আরামে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা যায় তার জন্যই তো তিনি দায়বদ্ধ। তাই প্রধানমন্ত্রী বুলেট ট্রেনের স্বপ্নে, বন্দে ভারতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকেন, আর খেটে-খাওয়া গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষ দলে দলে প্রাণ দিয়ে, পরিবার-পরিজনকে পথে বসিয়ে সেই স্বপ্নের মূল্য চোকায়। ধরায় কীর্তি রেখে যেতে হবে যে!

প্রধানমন্ত্রী দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে বলেছেন, দোষীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হবে। রেলমন্ত্রী আরও কয়েক পা এগিয়ে অনতিবিলম্বেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, প্রযুক্তিগত কোনও ত্রুটি নয়, কিছু কর্মচারীই এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী এবং তাঁদের নাকি ইতিমধ্যে চিহ্নিতও করা হয়ে গেছে। হয়তো এ বার নীচের তলার কিছু কর্মীকে বলির পাঁঠা করা হবে নিজেদের গাফিলতি, অপদার্থতা এড়াতে–ওপরতলার লোকেরা চিরকাল যেমন করে এসেছে। মেন লাইনে যাওয়ার জন্য সিগন্যাল সবুজ হয়ে থাকলেও, পয়েন্ট-এর (যার মাধ্যমে ট্রেন লাইন পরিবর্তন করে) অভিমুখ যে লুপ লাইনের দিকে খোলা থাকতে পারে, এমন বিপজ্জনক সম্ভাবনার কথা জানিয়ে চার মাস আগে সতর্ক করলেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। তাই দোষী তো শুধু কয়েক জন কর্মীই নয়, স্তরে স্তরে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের শাস্তি হবে না কেন? সরকারের যে ব্যয়সঙ্কোচ এবং বেসরকারিকরণের নীতির জন্য আজ অর্থাভাবের অজুহাত তুলে সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ হয় না, লাইনগুলির সংস্কার হয় না, নিরাপত্তার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় না, উপরতলার সেই নীতিকারদের চিহ্নিত করা হবে তো? যাঁরা সাধারণ ট্রেনগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চরম অবহেলা করে বন্দে ভারতকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেন তাঁদের শাস্তির ব্যবস্থা হবে না কেন? তা যাতে না করতে হয় তার জন্যই কি তড়িঘড়ি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন রেলমন্ত্রী? বন্দে ভারত চালুর কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী যদি একাই দাবি করেন তবে এই দুর্ঘটনার দায়ও তো তাঁকেই নিতে হবে। পদত্যাগ করলে মৃত মানুষগুলির প্রাণ ফিরবে না, কিন্তু নৈতিক দায় বলে কিছু থাকলে তা কেন নেবেন না রেলমন্ত্রী? কেন সেই দায় মাথায় নিয়ে তিনি পদত্যাগ করবেন না?

তা হলে শুধুই কি দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া রেল কামরাগুলিতে পচে-ওঠা মৃতদেহের চড়া দুর্গন্ধ, আহত যাত্রীদের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠা বাতাস, প্রিয়জনকে খুঁজতে থাকা আত্মীয়দের অসহনীয় উদ্বেগ, আতঙ্কে শুকিয়ে যাওয়া চোখের জল, মর্গ বানিয়ে তোলা স্কুলবাড়িতে ফুলে ঢোল হয়ে ওঠা সারি সারি মৃতদেহের মাঝে হঠাৎ স্বজনের দেহ খুঁজে পাওয়ার হাহাকার মানুষের স্মৃতিতে থেকে যাবে? আর বারবার করে তা আমাদের বুঝিয়ে দিতে থাকবে, যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেশের কর্তারা মানুষের ভোটে জিতে এসে মানুষেরই জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, জনসাধারণের প্রাণ বাজি রেখে নিজেদের প্রাণ-মন সঁপে দেয় শুধু মুনাফাবাজ একচেটিয়া মালিকদের শোষণের পথ সুগম করতে, সে দেশের মানুষের জন্য এই অসহায় আর্তনাদ, এই নিরুপায় যন্ত্রণা ভোগই বরাদ্দ? নাকি এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইব আমরা?