ব্যাঙ্ক শিল্পের সাম্প্রতিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, কিছু প্রশ্ন

ব্যাঙ্ক শিল্পের কর্মীদের চাকরির শর্তাবলি ও বেতন কাঠামো নির্ধারণের ক্ষেত্রে এতদিন যা হয়নি ২২ জুলাই ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এবং ব্যাঙ্ক কর্মচারী–ফিসারদের্ ৮ টি সংগঠনের মধ্যে সম্পাদিত একাদশ দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে তাই হল৷ দশম চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর৷ এরপর দীর্ঘ টালবাহানার পর গত ২২ জুলাই ২০২০ তে স্বাক্ষরিত হল এই চুক্তি৷ চুক্তিতে এই প্রথম ব্যাঙ্কের পারফরম্যান্স বা মুনাফার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে কর্মী–অফিসারদের বছরে বছরে বাড়তি ভাতার ব্যবস্থা৷ এরই নাম ‘পারফরম্যান্স লিঙ্কড ইনসেন্টিভ’ বা পিএলআই৷ এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হল, এই মুহূর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির মুনাফা বাডানো খুবই জরুরি এবং সেই লক্ষ্যে কর্মীদের উৎসাহিত করতে এ হেন পদক্ষেপ৷

এখানে প্রশ্ন হল, কর্মীরা উৎসাহিত হলেই কি মুনাফা বাড়বে? এতদিন পর্যন্ত ব্যাঙ্কের কর্মীরা কি উৎসাহের সঙ্গে কাজ করত না? এ তো ব্যাঙ্ককর্মীদের প্রতি অনাস্থা বা অসম্মান৷ বিভিন্ন ব্যাঙ্কে যে মুনাফা হয়েছে তা তো কর্মীদের পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই হয়েছে৷ অথচ সেই অর্থের নয়–ছয় তো দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে৷ লাভের গুড় পিঁপড়েতে খেয়ে যাচ্ছে৷ ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ বা ব্যাঙ্কের পরিভাষায় অনুৎপাদক সম্পদের (এনপিএ) পরিমাণ ১০ লক্ষ কোটি টাকা কবে ছাড়িয়েছে৷ এগুলি আদায়ের ব্যাপারে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বা সরকারের ভূমিকা কী? এ ব্যাপারে তাদের কোনও হেলদোল দেখা যাচ্ছে না৷ নেওয়া হচ্ছে না কোনও কঠোর বা কার্যকরী পদক্ষেপ৷ এজন্য ব্যাঙ্কের সাধারণ কর্মচারীরা কি দায়ী? দায়ী কি ব্যাঙ্কের চতুর্থ বা তৃতীয় শ্রেণির কর্মী যাদের অ্যাওয়ার্ড স্টাফ বলা হয় কিংবা সাধারণ অফিসাররা? এদিকে আবার সাডে ৪ লক্ষ কোটি টাকার মতো ঋণ ছাড দেওয়া (‘রাইট–ফ’ করা) হয়েছে৷ ছাড় দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্পোরেট হাউসকে, যাদের সম্পদ দিনের পর দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে৷ বলা বাহুল্য, মোট অনাদায়ী ঋণের প্রায় ৮৬ শতাংশ হল এই সব বড় বড় শিল্পপতি–ব্যবসায়ীদের৷ আমরা জানি, বেশ কয়েক বছর আগে একাধিক ব্যাঙ্কের থেকে ৯,৬০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিজয় মাল্য নির্বিঘ্নে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন৷ পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ককে রাস্তায় বসিয়ে প্রধানমন্ত্রীর স্নেহভাজন নীরব মোদী, মেহুল চোক্সিরা ১১,৪০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এক রকম সরকারি সহযোগিতায় দেশান্তরিত হয়েছেন৷ এমন আরও বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত ব্যাঙ্কের হাজার হাজার কোটি টাকা নয়–ছয় হচ্ছে৷ আরবিআই জানিয়েছে, গত আর্থিক বছরে অর্থাৎ ২০১৯–২০ অর্থবর্ষে তৎকালীন ১৮টি সরকারি ব্যাঙ্কে ১,৪৮,৪২৮ কোটি টাকার প্রতারণা হয়েছে৷ এরপরও লাভের কথা বলা হচ্ছে৷ এগুলি বন্ধ না করে পিএলআই চালুর অর্থ কি ?

কর্তৃপক্ষের মতে, এই মুহূর্তে মুনাফা বাড়ানো জরুরি৷ কিন্তু কেন? আসলে ব্যাঙ্ক শিল্পকে বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে এমন পদক্ষেপ৷ কোষাগারে টান, তাই বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রির উদ্যোগ চলছে৷ এই সংস্থাগুলির মধ্যে ৫/৬ টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কও রয়েছে৷ লাভ না করলে এগুলি কিনবেই বা কে? এদের লাভের অঙ্ককে বাড়ানোর জন্যই কর্মীদের উৎসাহ দিতে পিএলআই–এর মতো উৎসাহ ভাতা৷ সেই হিসাবে এই লাভ শেষ পর্যন্ত ব্যাঙ্কশিল্পের বেসরকারিকরণের রাস্তাকে আরও প্রশস্ত করবে৷ যারা ব্যাঙ্কগুলিকে লুট করে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে তাদেরই ব্যাঙ্কের মালিক করার এভাবে সব রকম প্রচেষ্টা চলছে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে৷

এখানে আর একটি বিষয়ও ভেবে দেখতে হবে৷ আজ মুনাফার ভিত্তিতে কর্মীদের উৎসাহ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে, যে পরিকল্পনায় ভাতা–প্রাপকরাও সামিল৷ দু’দিন পরে এই পথ বেয়েই তো চলে আসবে ব্যক্তিগত কাজের ভিত্তিতে উৎসাহ ভাতা দেওয়া বা পাওয়ার প্রশ্ন৷ তখন সেটা নেওয়া বা না নিলে প্রত্যাখ্যান করার বিষয়টা কি খুব সহজ হবে? এ কেবল উৎসাহ ভাতা পাওয়ার বিষয় নয়, এ বস্তুত কর্মচারীদের মধ্যে বিভেদও সৃষ্টি করবে৷ কর্মচারীদের ঐক্য তথা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে৷