বুলডোজার আর মাফিয়া উত্তরপ্রদেশ সরকারের দুই দোসর

উত্তরপ্রদেশে বুলডোজার যে কী মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে এখন, কানপুর দেহাত অঞ্চলে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এই অমানুষিক বর্বরতা ও পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার নিন্দা করার ভাষা বোধহয় সভ্যসমাজে নেই। বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভাঙতে এসে মা (প্রমীলা দীক্ষিত ৪৫) ও মেয়েকে (নেহা দীক্ষিত ২১) জীবন্ত পুড়িয়ে মারে পুলিশ। সরকারি আধিকারিকদের সামনেই ঘটে এই ভয়াবহ ঘটনা। নিহত মহিলার স্বামী ও ছেলে সহ গ্রামবাসীদের দাবি, সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট, রেভিনিউ অফিসার, পুলিশ এবং তাদের দুষ্কর্মের সহযোগী স্থানীয় জমি মাফিয়া বিশাল দীক্ষিত ও তার সাগরেদদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেটই বাড়িতে আগুন লাগাবার আদেশ দিয়েছে, পুলিশই আগুন লাগিয়েছে– সংবাদপত্রে এমনটাই উঠে আসছে।

১৩ ফেব্রুয়ারি সকাল, কানপুর দেহাত অঞ্চলের মাদৌলি গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলেছে বুলডোজার। তার সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটে চলেছে একদল উর্দিধারী পুলিশ, পাশাপাশি চলেছে এক জমি মাফিয়া ও তার সাগরেদরা। সাথে কিছু সরকারি আধিকারিকও। এক সময় বুলডোজার এসে থামে কৃষiরগোপালের বাড়ির সামনে, সেই সঙ্গে পুরো দল। হাঁকডাকে গৃহকর্তা কৃষ্ণন বাড়ি থেকে বের হলে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে বলেন যে, তৎক্ষণাৎ পুরো বাড়ি খালি করে দিতে হবে, বাড়ি ভাঙা হবে, এটা ‘গ্রাম সমাজের’ জমি, বে-আইনিভাবে দখল করে বাড়ি করে আছে সে। ছেলে শিবম প্রতিবাদ করে বলে, কয়েক পুরুষ ধরে এ জমিতে তাদের বাস, আগে তাদের ঝুপড়ি ঘর ছিল, পরে পাকা হয়েছে– সে-ও কুড়ি বছর আগের কথা। কেউ কখনও বে-আইনি বলে নালিশ করেনি। গ্রাম সমাজ, স্থানীয় পুলিশ কোনও দিন আপত্তি জানায়নি। সরকার কোনও আগাম নোটিসও দেয়নি। এখন হঠাৎ করে বলা হচ্ছে, তারা বেআইনি দখলদারি, তা কী করে হয়? ‘এ বাড়ি ভাঙতে দেব না’– শিবম বাবা কৃষ্ণনকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকে, ঘরের ভিতর থেকে মা ও মেয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। চারজনই বাড়ি থেকে না বেরনোর সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ জোর করে বাড়িতে ঢুকে তাঁদের উপর চড়াও হয়, শিবমকে মারধর করে, টেনে হিঁচড়ে মা ও মেয়েকে বাড়ির বাইরে বের করতে চায়। না পারায় ক্ষিপ্ত সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্টে্রট তৎক্ষণাৎ বাড়িতে আগুন লাগাবার আদেশ দেন। পুলিশ কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ইতিমধ্যেই বুলডোজারও বাড়ি ভাঙতে শুরু করে দিয়েছে। শিবমের অভিযোগ, পুলিশ পরিবারের সবাইকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেছিল। সে কোনও ক্রমে বেরিয়ে আসতে পারলেও মা ও বোনকে বাঁচাতে গিয়ে তার বাবা পুড়ে মারাত্মক আহত হন। পুলিশকে বারবার বলা সত্ত্বেও তারা বাঁচাবার চেষ্টা করেনি। জীবন্ত পুড়ে মারা যায় মা ও মেয়ে। সরকারি আধিকারিক ও পুলিশের সামনে মা ও মেয়ের মর্মান্তিক মৃত্যু– এ তো হত্যাকাণ্ডের সামিল! শিবম ঘটনায় যুক্ত ৩৯ জনকে অভিযুক্ত করে এফআইআর করতে গেলে পুলিশ তা নিতে অস্বীকার করে। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে এলাকার শত-শত মানুষ ধরনা-অবস্থান শুরু করলে বাধ্য হয়ে প্রশাসন এফআইআর নেয়। মৈথীর সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট ও রেভিনিউ অফিসারকে সাসপেন্ড করা হয়। এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে দু-জন, এক সরকারি আধিকারিক এবং বুলডোজার চালক।

উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ শুধু নয়, বেশ কিছু রাজ্যে বুলডোজার শাসকের দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠছে সর্বত্র। বুলডোজার দিয়ে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষের ঘর-বাড়ি-সম্পত্তি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, এটা দেখে ইতিমধ্যেই প্রতিবাদ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের একদল প্রাক্তন বিচারপতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার সাথে যুক্ত বিশিষ্টজনেদের একাংশ। গত ১৪ জুন তাঁরা ভারতের প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি লিখে আর্জি জানিয়েছিলেন, আদালতের আদেশ নেই, অথচ বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, এটা মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়ন। আইনের শাসনকে পুরোপুরি নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া বন্ধ হওয়া দরকার। তা বন্ধ তো হয়নি, বরং বেড়েছে। মার্চে এলাহাবাদে বুলডোজার দিয়ে একাধিক সংখ্যালঘু মানুষের বাড়ি ঘর ও সম্পত্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি সুযোগ বুঝে বুলডোজার অভিযানে নেমে পড়েছে বিজেপি মদতপুষ্ট জমি মাফিয়ার দল। তারা নিশানা করছে সেইসব নাগরিকদের যারা বিজেপির অনুগত নয়, সমালোচক বা যার অনেকটা পরিমাণে সম্পত্তি রয়েছে, কিন্তু লোকবল কম বা নেই, কিংবা দামি এলাকায় যাদের পুরনো বাড়ি ও জমি আছে। শাসক দল, সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর ও পুলিশের যোগসাজসে এবং তাদের মদতে জমি মাফিয়ারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মাদৌলি গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, জমি মাফিয়া ও তাদের দলবল ওই গ্রামের অনেক জমি গ্রাস করেছে, এখন কৃষ্ণন দীক্ষিতেরটা দখল করতে চাইছে।

১৯৬১ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি প্রয়াত উর্দু কবি এ এন মোল্লা এক ফৌজদারি মামলার পর্যবেক্ষণে সখেদে বলেছিলেন, ‘এমন একটি বেআইনি অপরাধী দল এ দেশে নেই, যাদের অপরাধের রেকর্ড, ভারতীয় পুলিশ বাহিনী নামে পরিচিত সঙ্ঘবদ্ধ শক্তিটির অপরাধের রেকর্ডের ধারেকাছে পৌঁছতে পারে’। সেই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জওহরলাল নেহেরু। বস্তুতপক্ষে, বিজেপি শাসনে পুলিশের আন্দোলন দমনকারী জনবিরোধী ভূমিকা, শাসকদলের দলদাসে পরিণত হওয়ার রীতি এবং সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধী বাহিনী হিসেবে উঠে আসা– এ সবের সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতার পর থেকেই, কংগ্রেস আমলে। এখন মোদি-যোগী তথা বিজেপি শাসনে শত শত পরিবারকে নিঃস্ব করে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিনা অপরাধে। মিথ্যা অজুহাতে ধরে পুলিশ রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে যাকে ইচ্ছে তাকেই দেগে হচ্ছে। সাংবাদিক-শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মী সহ সাধারণ মানুষ কেউ বাদ যাচ্ছেন না। অভিযুক্তদের ধরে এনে, বিনা বিচারে এনকাউন্টার করে সরাসরি হত্যা করা পুলিশের কাছে গর্বের বিষয় হয়ে উঠেছে। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে যে, পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে মানে সে ‘অপরাধী’। ‘অভিযুক্ত’ ও ‘অপরাধী’-র মধ্যে কোনও ফারাক রাখা হচ্ছে না।

মাদৌলী গ্রামে বুলডোজার অভিযানে মা ও মেয়ের জীবন্ত পুড়ে মরার ঘটনা সামনে এনেছে কতগুলি গুরুতর প্রশ্ন। কৃষ্ণনগোপালের বাড়ি বেআইনি নির্মাণ, বলেছেন সরকারি আধিকারিকরা। কথাটা তর্কের খাতিরে সত্য ধরলেও প্রশ্ন, সরকার কি ইচ্ছে করলেই কারও বাড়ি ভাঙতে পারে? ১৯৮৫ সালে মুম্বাইয়ের এক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল, বাড়ি বা বাসস্থান বা জীবিকার জন্য যে সম্পত্তি, তা ভাঙতে গেলে সরকার বা কর্তৃপক্ষকে আগাম নোটিস, পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে, আর নিতে হবে পুনর্বাসন এর দায়িত্ব– এ ক্ষেত্রে আইনের ওই নির্দেশ মানা হল না কেন? অভিযোগ উঠেছে, যে কেরোসিন দিয়ে বাড়িতে আগুন লাগানো হয়, তা কি পরিকল্পনা মাফিক আগে থেকেই রাখা ছিল? জেলা প্রশাসন ও পুলিশ গোড়া থেকেই বলে আসছে, এটা আত্মহত্যার ঘটনা। জেলাশাসক আগুন লাগানোর কথা মানতে চাননি, তাঁর বক্তব্য মা ও মেয়ে ঘরের ভিতর থেকে আগুন লাগিয়েছে। তা যদি হয়, সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ চোখের সামনে তা দেখেও তাদের বাঁচানোর কোনও চেষ্টা করল না কেন? গ্রামবাসীরা প্রশ্ন করেছেন, বাড়ি ভাঙতে আসা সরকারি আধিকারিক ও পুলিশের ওই দলে জমি মাফিয়ারা ছিল কী উদ্দেশ্যে? তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন? প্রশাসনের কাছ থেকে কোনও প্রশ্নেরই জবাব পাওয়া যায়নি।

দেশে যতটুকু গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশ রয়েছে, বিজেপি বুলডোজার দিয়ে সেইটুকুও গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বার্থে ও প্রতিহিংসা চরিতার্থতায়, এখন তার পরিধি আরও বিস্তার করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সমাজের অন্যান্য স্তরেও, এমনকি বর্ণবিদ্বেষ ও নানা ধরনের হীন স্বার্থে। এই অবস্থায় আইন-আদালতের বিচারের অপেক্ষায় না থেকে গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষায় সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে– এ ছাড়া বিকল্প কোনও রাস্তা নেই।