উজ্জ্বলা যোজনা নামেই, গরিবের ভরসা সেই কাঠ-কুটো

 

গ্রামীণ ভারতের ৫১ শতাংশ পরিবার রান্নার গ্যাস ব্যবহার করতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে গ্রামে ৭৬ শতাংশ পরিবার কাঠকুটো, শুকনো ডালপালা জোগাড় করে মাটির উনুনে রান্না করে। কয়লা, ঘুঁটে বা কেরোসিন কেনার সামর্থ্যও তাদের নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সমীক্ষায় এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য শহরের হিসাবটা একটু আলাদা। কারণ, শহরে কাঠকুটো, ডালপালা, মাটির উনুন শত খুঁজলেও পাওয়া যায় না। তবুও বহুমূল্য গ্যাসের খরচ বাঁচাতে দিনে একবার রান্না কিংবা চালে একফুট দিয়েই নামিয়ে রেখে আধসেদ্ধ খাবারে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়েছেন বহু মানুষই। কিন্তু রান্নার গ্যাসের মতো দূষণহীন জ্বালানি যখন আধুনিক জীবনে এসেই গিয়েছে তখন উনুনের কালো ধোঁয়ায় চোখ মুছতে মুছতে কেন রান্না করতে হচ্ছে মহিলাদের?

২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী ‘উজ্জ্বলা’ যোজনা চালু করেছিলেন। বিজেপি নেতারা বলেছিলেন, গরিব ঘরের মহিলাদের বিনামূল্যে রান্নার গ্যাসের সংযোগ দিয়ে তাদের দূষণের হাত থেকে রক্ষা করাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। ঘরে ঘরে মহিলারা ভেবেছিলেন, দুঃখের দিন তা হলে বোধহয় শেষ। কিন্তু গ্যাসের সংযোগ পেয়ে লাভ কী, যদি তা ব্যবহার না করা যায়? উজ্জ্বলা যোজনার সব ‘উজ্জ্বলতা’ ঢাকা পড়ে গেল সিলিন্ডারের দামবৃদ্ধিতে। গ্যাসের দাম বাড়তে শুরু করল হু হু করে। ২০১৪ সালে যে গ্যাসের দাম ছিল ৪১০ টাকা, ২০২৩-এর মার্চে তার দাম হয়েছে ১১২৯ টাকা অর্থাৎ তিন গুণ দাম বেড়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশের সময়ে জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত ৯.৬ কোটি পরিবারকে উজ্জ্বলা যোজনার অধীনে আনা হয়েছে। কিন্তু যারা সংযোগ পেয়েছে, তারা আদৌ গ্যাস ব্যবহার করতে পারছে কি না তা নিয়ে সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই। দেখা যাচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ওই পরিবারগুলির ১১.৩ শতাংশ মাত্র একবার সিলিন্ডার নিতে পেরেছে এবং ৫৬.৪ শতাংশ পরিবার মাত্র চারটি বা তার কম সিলিন্ডার নিতে পেরেছে। উপরন্তু উজ্জ্বলা যোজনায় ভর্তুকি মাত্র ২০০ টাকা, গ্যাসের দাম ১১২৯ টাকা হওয়ার ফলে ভর্তুকির টাকা বাদ দিয়ে ৯২৯ টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই বহু পরিবারের। আর বেশিরভাগ গ্রাহক যারা ‘উজ্জ্বলা’র অর্ন্তভুক্ত নন, তাদের ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে মাত্র ১৯.৫৭ পয়সা। তাও সর্বত্র দেয় না। এই ভিক্ষার দানে কারও কোনও সুরাহা হওয়া সম্ভব কি? ফলে এলপিজি সংযোগ থাকলেও কাঠকুটো জ্বালিয়ে রান্না করতে বাধ্য হচ্ছেন অধিকাংশ গ্রাহক।

একদিকে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে চড়চড় করে, পাল্লা দিয়ে রোজগার কমছে মানুষের। তার উপর গ্যাসের দামের এতটা বৃদ্ধি! স্বভাবতই প্রয়োজন থাকলেও গ্যাসের ব্যবহার কমাতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

গ্যাসের দামবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ যখন জেরবার, তখন সমস্যার সমাধানে সরকারের ভূমিকা কী? গত বাজেটে এই খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ৪০০০ কোটি টাকা। কিন্তু খরচ করা হয়েছে মাত্র ১৮০ কোটি টাকা অর্থাৎ বরাদ্দের মাত্র সাড়ে চার শতাংশ! এই বার বাজেটে ওই ১৮০ কোটি টাকাই বরাদ্দ হয়েছে। গত বছরে নতুন সংযোগ দিতে খরচ হয়েছিল ৮১০০ কোটি টাকা। এ বছর সে খাতে বরাদ্দ মাত্র এক লক্ষ টাকা। বরাদ্দ থেকেই স্পষ্ট, সরকার গ্যাসের সংযোগ দিতেও আগ্রহী নয়। তাহলে রান্নার গ্যাস কি সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে থাকা বাস্তবে সম্ভব, নাকি তা মুষ্টিমেয় উচ্চবিত্তের ব্যবহারের জন্যই নির্দিষ্ট থাকবে?

তেল কোম্পানিগুলির লোকসান আটকাতেই কি গ্যাসের এত দামবৃদ্ধি? বাস্তব তা বলছে না। দেখা যাচ্ছে, ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, ভারত পেট্রোলিয়াম, হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়ামের মতো সংস্থাগুলি মোটা টাকা লাভ করছে। ইন্ডিয়ান অয়েলের মুনাফা ২০২১-‘২২-এ ২৪.১৮৪ কোটি টাকা, ভারত পেট্রোলিয়ামের ২০২২-এ শুধু প্রথম ত্রৈমাসিকে লাভ ১৫০১.৬৫ কোটি টাকা, হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম ২০২১-‘২২ অর্থবর্ষে লাভ করেছে ৬ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। এই বিপুল মুনাফা সত্ত্বেও গ্যাসের দাম আরও না বাড়ালে তাদের ক্ষতি হচ্ছে বলে অজুহাত তুলছে তারা। লজ্জার বালাই না রেখে ‘ক্ষতি’ পূরণ করতে সরকার এদের ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার ঘোষণা করেছে (ব্লুমবার্গ রিপোর্ট)। একদিকে কোম্পানিগুলির অতি মুনাফা লোটা এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জন্য সরকারের ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়াই গ্যাসের এত দামবৃদ্ধির কারণ। ফলে নেতা-মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতি– সাধারণ মানুষের কাছে শহরে-গ্রামে সুলভে গ্যাস পৌঁছে দেওয়া যে কথার কথামাত্র, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।