Breaking News

জি-২০: চার হাজার কোটির বেশি ব্যয় করে দেশের জনগণকে কী দিলেন মোদিজি!

দিল্লিতে সদ্য সমাপ্ত ‘জি-২০’ (জি টোয়েন্টি) সদস্য দেশগুলির শীর্ষ বৈঠকের সাফল্যে উল্লসিত বিজেপি নেতারা পুষ্পবৃষ্টি করে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানিয়েছেন। কারণ তাঁর নেতৃত্বের জন্যই নাকি জি-২০ সম্মেলনে সমস্ত পক্ষকে একজোট করে যৌথ ঘোষণাপত্র রচনা সম্ভব হয়েছে। মোদিজি নিজেও বলেছেন, এই বৈঠক দেখিয়ে দিল ‘ভারত বিশ্বের জন্য প্রস্তুত, বিশ্বও আজ ভারতের জন্য প্রস্তুত’। দেখা যাক ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা খরচ করে দেশের জন্য এর থেকে কী লাভ ওঠালেন নরেন্দ্র মোদি! তার আগে অবশ্য ঠিক করতে হবে, দেশ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। এর মানে যদি দেশের সাধারণ মানুষ হয়, তাহলে তার খোঁজ এক রকম হবে। আর যদি দেশ মানে দেশের একচেটিয়া মালিকদের বোঝায়, তাহলে তা হবে আর এক রকম।

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং উন্নয়নশীল ২০টি দেশ ও গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক বোঝাপড়ার গোষ্ঠী জি-২০। ১৯৯৯-তে সদস্য দেশগুলির অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে শুরু হলেও ২০০৮-এ বিশ্বজোড়া প্রবল মন্দা সামলাতে এই মঞ্চে রাষ্ট্রপ্রধানদেরও যুক্ত করা হয়। এবারের সম্মেলনে আফ্রিকান ইউনিয়নকে যুক্ত করা হল। সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে বাজার নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত কমিয়ে আপাত সমঝোতাই এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য, যাতে পুঁজিবাদী বাজারের সর্বগ্রাসী সংকটকে কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা যায়। যে বিষয়গুলি এবারের জি-২০ বৈঠকের বড় সাফল্য বলা হচ্ছে সেগুলিকে এক এক করে দেখা যাক।

নরেন্দ্র মোদিজির সভাপতিত্বঃ গত এক বছর ধরে ভারত ছিল জি-২০-র সভাপতিত্বের দায়িত্বে। ফলে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদি সেই আলো নিজের দিকে টানার সুযোগ পেয়েছেন। এটাকেই বিজেপি মোদিজির বিরাট সাফল্য বলে প্রচার করছে। যদিও এই চেয়ারটা নিতান্তই নরেন্দ্র মোদিজির পড়ে পাওয়া। কারণ প্রতি বছরই এর সভাপতি বদল হয়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব দেশকেই দায়িত্ব নিতে হয়। যেমন আগামী বছর দায়িত্ব যাচ্ছে ব্রাজিলের হাতে। ফলে ওই সময় রাম-শ্যাম যে কেউ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে থাকলে তিনিই জি-২০-র সভাপতি হতেন। মোদিজির বিশেষ কোনও কৃতিত্ব এতে নেই। আর এতে ভারতীয় জনগণেরও প্রাপ্তি কিছু নেই।

জনগণের জি-২০: বিজেপির দাবি মোদিজির সভাপতিত্বে জি-২০ জনগণের মঞ্চ হয়ে উঠেছে। ব্যাপারটা অবশ্য হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন দিল্লির বস্তিবাসী গরিব মানুষ। বুলডোজারের ধাক্কায় তাঁদের মাথা গোঁজার সামান্য আশ্রয়টুকুও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

দেশের নানা রাজ্যে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দেশের পুঁজিপতিদের সাথে মন্ত্রী এবং অফিসার পর্যায়ের কিছু বৈঠক হয়েছে। এর কোনটিতে সরকার জনগণের মত নিয়েছে? ভারতের মন্ত্রী-আমলারা এ দেশের পুঁজিপতিদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য দরকষাকষি করেছেন অন্য দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধি সরকারের সাথে। জনগণ মানে কি পুঁজিমালিকরা, ধনকুবেররা? তাদের দর কষাকষিতে খামোখা জনগণের নামটেনে আনা কেন? সামনে লোকসভা ভোট বলেই কি এখন জনগণের কথা মনে পড়ছে?

যৌথ ঘোষণাপত্রঃ সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধানের স্বাক্ষরিত যৌথ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে পারা নাকি মোদিজির আর একটি সাফল্য! বিজেপির দাবি, নরেন্দ্র মোদির সভাপতিত্ব ছাড়া এই ঘোষণাপত্র তৈরিই হত না। ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে রাশিয়া এবং আমেরিকাকে এক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করানোর মতো কঠিন কাজটি তিনিই নাকি শুধু পারেন! এ ব্যাপারে একটা দামি কথা বলেছেন পোলিশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্যাট্রিক কুগেইল। তাঁর মতে বিশ্ব জোড়া ঋণ সংকট, জলবায়ু ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব, প্রতিজ্ঞা ছাড়াই শুধু কিছু কথার সমাহার–এমন একটি ঘোষণাপত্রে সই করতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কারণ এর কোনও কার্যকারিতাই নেই। এটাও জানা কথা যে, এই ধরনের ঘোষণাপত্রে মিষ্টি কথাগুলি লেখার সময় সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ছুরিগুলো আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রাখে। দরকষাকষির পর বোঝাপড়া আপাতভাবে কিছুটা হয়, কারণ সকলেরই স্বার্থ থাকে বাজার নিয়ে টানাটানি, তীব্র দ্বন্দ্ব একটু হলেও কমানোর। কিন্তু মঞ্চ ছেড়ে উঠলেই এরা পরস্পরের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী। ঘোষণাপত্রে ‘সর্বসম্মতির’ প্রধান কারণ হল– এবারের সম্মেলনে ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলি ভারতের সাথে মিলে বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে কিছুটা ছাড় আদায় করতে মরিয়া ছিল। এদিকে বৃহৎ শক্তিগুলি বর্তমান বিশ্বজোড়া মন্দার বাজারে ভারতের মতো বিরাট জনসংখ্যার দেশের বাজার হারাতে চায় না। ফলে তারা কিছুটা নরম থেকেছে। চিনও ভারতের সাথে আপাত স্থিতাবস্থা বজায় রেখে আমেরিকাকে কিছুটা চাপে রাখার কৌশলে ঘোষণাপত্র নিয়ে বিশেষ কিছু বলেইনি।

ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধঃ এ প্রসঙ্গে ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, বিশ্বের কোনও দেশ অপর দেশের সার্বভৌমত্ব গায়ের জোরে কেড়ে নেবে না, এটা যুদ্ধের সময় নয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। যুদ্ধের জন্য মানুষের সমস্যার কথাও কয়েক শব্দে লেখা আছে। কিন্তু কোথাও রাশিয়াকে আক্রমণকারী বা আগ্রাসনকারী বলা হয়নি। এই ফাঁপা শব্দে ভরা দলিলে স্বাক্ষর দিতে রাশিয়া এবং আমেরিকার মতো দুই ঘোষিত শত্রুপক্ষের কারও সমস্যা নেই। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যে সত্যটা এই ঘোষণাপত্র সামনে এনে দিয়ে গেল– তা হল, আমেরিকা কিংবা ইউরোপের সাম্রাজবাদীরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যাই বলুক না কেন, যুদ্ধটা শেষ হলে ওদের সকলের ক্ষতি। ইউক্রেনে সত্যিই যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইলে জি-২০-র মতো বিশ্ব অর্থনৈতিক মঞ্চকে তারা কাজে লাগাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করত। কিন্তু অস্ত্র ব্যবসা থেকে শুরু করে বিশ্ববাজারে আধিপত্যের স্বার্থে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আস্ফালন ও দাদাগিরি বজায় রাখতে তাদের এটা দরকার। অন্যদিকে রাশিয়া, চিন সহ অন্য সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ আছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর আধিপত্য খর্ব করে নিজেদের ব্যবসার প্রয়োজনে প্রভাবাধীন অঞ্চল প্রসারের চেষ্টা করা। ভারতের স্বার্থ হল, এই যুদ্ধের সুযোগে রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল সহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা আদায় করে নেওয়া। রাশিয়াও খুশি, কারণ তাকে কার্যত যুদ্ধ বন্ধ করার কোনও চাপই দেওয়া হয়নি। কার্যত ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের স্বার্থকে বলি দিয়েছে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের অনুসারী রাষ্ট্রগুলির সম্মেলন জি-২০। ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলির জনগণও খাদ্যের অভাব সহ নানাভাবে এর বোঝা বইতে বাধ্য হচ্ছেন।

আফ্রিকান ইউনিয়ন ও গ্লোবাল সাউথ: প্রচার হচ্ছে, আফ্রিকান ইউনিয়নকে জি-২০-র অন্তর্ভুক্ত করার কৃতিত্বও নরেন্দ্র মোদির। দক্ষিণ আফ্রিকা এই জোটের অন্তর্ভুক্ত ছিলই। এবারে আফ্রিকান ইউনিয়ন হিসাবে জি-২০-র বাণিজ্য চুক্তির আওতায় সে মহাদেশের এক বিরাট অংশ অন্তর্ভুক্ত হল। এতে লাভ হল কার? আফ্রিকার দেশগুলির অধিকাংশই চরম দারিদ্রের শিকার। অথচ খনিজ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে এগুলি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আফ্রিকার সম্পদ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে তাই কাড়াকাড়ির শেষ নেই। জি-২০তে আফ্রিকান ইউনিয়নকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভারতের বিশেষ উদ্যোগের প্রধান কারণ হল ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বিপুল মুনাফা দিতে পারে আফ্রিকা। তারা সেখানে ইতিমধ্যেই বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করছে। তাদের আরও বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে ভারতীয় শাসকরা সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি আমেরিকার সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এগোচ্ছে। আফ্রিকায় ইতিমধ্যেই চিনের প্রভাব থাকায় মার্কিন কর্তারাও ভারতের ভূমিকাকে কাজে লাগিয়ে চিনকে কিছুটা পিছু হঠাতে চাইছেন। তাই তারাও জি-২০তে আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তিতে উৎসাহী। অন্যদিকে চিন এবং রাশিয়াও জি-২০তে আফ্রিকান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তিকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে আগ্রহী। নরেন্দ্র মোদিজির এতে আলাদা কোনও কৃতিত্ব থাকার কথাই নয়, তা নেইও।

এবারের জি-২০তে একটা শব্দ বারবার শোনা গেছে– ‘গ্লোবাল সাউথ’। আমেরিকা, রাশিয়া, চিন এবং ইউরোপের বড় সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে দরকষাকষির সুবিধার জন্য আফ্রিকা, এশিয়ার কিছু দেশ, ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান দেশগুলি এবং অস্টে্রলিয়া নিউজিল্যান্ড বাদে ওশিয়ানিয়ার কিছু দেশ নানা বিষয়ে এক সঙ্গে চলতে চায়। এদের যৌথ প্রচেষ্টাকে বলা হচ্ছে ‘গ্লোবাল সাউথ’। ভারতের উৎসাহ হল, এদের মধ্যমণি হয়ে উঠতে পারলে এই সব দেশের বাজারে ঢুকতে ভারতীয় পুঁজিপতিদের যেমন সুবিধা হবে, তেমনই এর মাধ্যমে অনেকে মিলে বড় সাম্রাজ্যবাদী ব্লকের সাথে টক্কর যেমন দেওয়া যাবে, পাশাপাশি বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে বোঝাপড়ার রাস্তাটাও অনেকটা পরিষ্কার হবে। লক্ষণীয়, এবারের জি-২০ বৈঠকে ভারত সরকারের বিশেষ আগ্রহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই গোষ্ঠীর সদস্য না হয়েও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভারতকে আশ্বস্ত করেছেন চিন তাঁদের ‘বাণিজ্যিক বন্ধু’ হলেও ভারত তাঁদের ‘আত্মিক বন্ধু’। ভারতও বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন চাপ থেকে শেখ হাসিনাকে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে। তথাকথিত গ্লোবাল সাউথের মধ্য দিয়ে ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজি এবং এই সব দেশগুলির উচ্চাকাঙক্ষী বুর্জোয়াদের লাভ হতে পারে। কিন্তু ভারত সহ অন্যান্য দেশগুলির সাধারণ মানুষের এতে কী লাভ?

নতুন করিডরঃ জি-২০-র বোঝাপড়ার অন্যতম হল ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত করিডর। তাতে স্থলপথ এবং জলপথ উভয়ই কাজে লাগবে। ভারত, সৌদি আরব, আরব আমিরশাহি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যের এই করিডরে আমেরিকাও উৎসাহী। তারা উদ্যোগ নিয়ে এই প্রকল্পের মধ্যে ইজরায়েলের বন্দরকেও যুক্ত করার কাজটা সম্পন্ন করেছে। ফলে এশিয়া থেকে ইউরোপের নানা দেশে পণ্য চলাচল অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। মার্কিন সরকারের আশা চিনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোডে’র পাল্টা হিসাবে এই করিডর মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অনেকটা অংশে চিনের বদলে তাদের আধিপত্য বাড়াতে সাহায্য করবে। লক্ষ করার মতো বিষয় হল চিন এই নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে শুধু বলেছে, নতুন করিডর নিয়ে বোঝাপড়া ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ বদলের কাজে ব্যবহার না হলে তাদের আপত্তি নেই। যদিও বাস্তবটা হল, আজকের বিশ্বে বাজার নিয়ে দ্বন্দ্ব এতটাই তীব্র যে, সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে সামরিক তাকত এবং ভূ-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আধিপত্য বজায় রাখা। সে দিক থেকে চিনের এই আপাত নির্লিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য দেখিয়ে দিচ্ছে এক নতুন সাম্রাজ্যবাদী টক্করের সম্ভাবনাকে। উল্লেখ করা দরকার, সম্প্রতি ব্রিকস গোষ্ঠীর সম্প্রসারণ নিয়ে চিনের প্রচেষ্টার সাথে ভারতের স্বার্থের সংঘাত হয়েছে, আবার তার আপাত সমাধানও হয়েছে। জি-২০ সম্মেলনের ঠিক একদিন আগে মোদিজি যেভাবে জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ‘আসিয়ান’ সম্মেলনে ছুটে গিয়ে একটা বত্তৃতা দিয়ে এসেছেন সেটাও লক্ষ করার মতো। কারণ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলির এই গোষ্ঠীর সাথে আলাদা সখ্যতার ছবি জি-২০ বৈঠকে ভারতের দর কিছুটা বাড়াতে সক্ষম বলে কূটনীতিকরা হিসাব কষেছেন। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সাময়িক বিপর্যয়ের পর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির প্রচারকরা ঢাক পিটিয়ে বলেছিলেন, সমাজতান্ত্রিক শিবির নেই, ফলে একমেরু বিশ্বে আর যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই। সেদিনই মহান লেনিনের শিক্ষাকে তুলে ধরে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার আলোকে এস ইউ সি আই (সি) দেখিয়েছিল, সাম্রাজ্যবাদই যুদ্ধের জন্ম দেয়। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অনুপস্থিতি যুদ্ধের বিপদকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দেবে। আজ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ভয়াবহতা সেই সত্যকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

পরিবেশঃ ঘোষণাপত্রে ২০১৫-র প্যারিস জলবায়ু চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার যথারীতি আছে। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আমেরিকা সহ শিল্পোন্নত দেশগুলি ‘কার্বন ট্যাক্সে’র নামে যে বোঝা কম উন্নত দেশগুলির ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে, তা নিয়ে ঘোষণাপত্র নিশ্চুপ। গ্লোবাল সাউথের মুখপাত্রের দাবিদার ভারতও কিছু বলেনি। জলবায়ু রক্ষার তহবিলের জন্য ২০৩০-এর মধ্যে ৫.৮ থেকে ৫.৯ ট্রিলিয়ান মার্কিন ডলারের তহবিলের কথা বলা হয়েছে। এর জন্য ‘মাল্টি ডেভলপমেন্টাল ব্যাঙ্ক’-এর মাধ্যমে সরকারি তহবিল জোগানোর কথাও আছে। কিন্তু ২০১০ থেকে উন্নত দেশগুলির সম্মিলিতভাবে বছরে যে ১০০ কোটি ডলার দশ বছর ধরে জলবায়ু উন্নয়নে খরচ করার কথা ছিল, তার কী হল? এ ব্যাপারে ঘোষণাপত্র উল্লেখমাত্র করেই থেমে গেছে। তহবিল কারা দেবে, তাও নির্দিষ্ট করা হয়নি। এছাড়া উন্নত দেশগুলি ‘সবুজ টেকনোলজি’ অর্থাৎ দূষণহীন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ত্ব কোনওভাবেই শিথিল করতে রাজি নয়। ফলে অনুন্নত দেশগুলির ওপর এই প্রযুক্তি একটা বিপুল বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে বৃহৎ শক্তিগুলির লাভ হচ্ছে কিন্তু বেশিরভাগ দেশের পক্ষে দূষণহীন প্রযুক্তি ব্যবহারই অসম্ভব হয়ে উঠছে। এছাড়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ‘ডিফরেস্টেশন ফ্রি প্রোডাক্টে’র নামে দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলির কৃষিজ, বনজ সম্পদের ওপর বিপুল কর বসাচ্ছে। যদিও তাদের দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলিই ঘুরপথে এই সমস্ত সম্পদ রপ্তানি করছে। ফলে মার খাচ্ছে অনুন্নত দেশগুলির কৃষিজীবীরা। জি-২০ ঘোষণাপত্র এ নিয়ে একেবারে নীরব।

সুস্থায়ী উন্নয়নঃ সমস্ত পোশাকি আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রে যেমন থাকে জি-২০-র ঘোষণাপত্রেও ঠিক তেমনভাবেই ‘সাসটেনেবেল ডেভলেপমেন্ট’ বা সুস্থায়ী উন্নয়নের প্রতিজ্ঞা নেওয়া হয়েছে। যদিও, ২০১৫-তে যে ১৭টি বিষয় ধরে ২০৩০-এর মধ্যে এর লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এতদিনে তার ১২ শতাংশ মাত্র করা গেছে বলে জানিয়েছে জি-২০-র সভা। ভারতের সভাপতিত্ব নিয়ে যতই ঢাক বাজাক বিজেপি, দেখা গেছে এই উন্নয়ন মাত্রাগুলির নিরিখে ‘সভাপতি মশাই’ বেশ পিছিয়েই আছেন। ক্ষুধা, অপুষ্টি দূর করার বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি সহ আর্থিক অসুবিধা দূর করে মানুষের কাছেখাদ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাপারে অনেক কথা হয়েছে। উচ্চমানের শিক্ষা এই উন্নয়নের একটা অংশ। কিন্তু, বিশ্বায়নের ফরমুলা অনুযায়ীযখন পুঁজিবাদী সরকারগুলি নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু বেসরকারি পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার পথে হাঁটছে সেই সময় তারা কী করে একেবারে প্রান্তিক মানুষের কাছে এগুলি পৌঁছে দেবে? দেখা যাচ্ছে, বাস্তব সমস্যাগুলিকে গম্ভীর ভাষায় তুলে ধরার ভড়ংয়ের আড়ালে খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, জ্বালানী সব ক্ষেত্রেই বাড়তি বাণিজ্যের লক্ষ্যমাত্রাই ঘোষণাপত্রের উদ্দেশ্য। সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় স্বাধীনতা, মত প্রকাশের ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানবাধিকার রক্ষাকে সুস্থায়ী উন্নয়নের অংশ বলা হয়েছে। এই নিরিখে ভারতের স্থান কোথায়, তা দেশের মানুষ যেমন হাড়ে হাড়ে জানে, তেমনই বিশ্বও জানে।

দেখা গেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দিল্লিতে বসে এগুলির ব্যাপারে কোনও মুখ না খুললেও ঠিক সম্মেলন থেকে উড়ে ভিয়েতনামে নেমেই ঘুরপথে বলে দিয়েছেন ভারতে এগুলির একান্ত অভাব। বিজেপি নেতারা নিশ্চয়ই তার খবর রাখেন।

ঋণ সংকটঃ বিশ্বজুড়ে তীব্র ঋণ সংকট, আর্থিক অসাম্যের কথাও ঘোষণায় এসেছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের যে শিরোমণির জন্য আজ বিশ্বের ৩৯টি দেশ মারাত্মক ঋণের ফাঁদে জাড়িয়েছে, সেই আমেরিকার নামটিও উচ্চারিত হয়নি। বরং মার্কিন নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি পরিচালিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার হাত ধরে বাণিজ্য চুক্তিগুলি সাজানোর কথা বলা হয়েছে। মাল্টিডেভলপমেন্টাল ব্যাঙ্কের মাধ্যমে উন্নয়নে খরচের কথা বলা হয়েছে। যদিও বাস্তব হল, সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে এই ধরনের লগ্নি প্রতিষ্ঠান মানে হচ্ছে আরও বেশি লুঠ, আরও বেশি দুর্বল দেশের ওপর ঋণের ফাঁদ।

তাহলে শেষ পর্যন্ত জি-২০ সম্মেলন থেকে জনগণের লাভ কী দাঁড়াল! এর থেকে এ দেশের সাধারণ মানুষের কিছু জোটার কথা ছিল না, তা জোটেওনি। কিন্তু দেখা গেল জাহাজ-রেল করিডরের মাধ্যমে আদানি গোষ্ঠীর বিপুল বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এবং ইজরায়েলে যতগুলি বন্দর এই কাজে লাগবে তার বরাত যেন আদানিরা পায় তা নিশ্চিত করার জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন মোদিজি। স্বাভাবিকভাবেই এ জন্য অর্থ জোগানের বন্দোবস্ত করতে হবে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলিকেই। অর্থাৎ জনগণের গচ্ছিত টাকাতেই আদানি গোষ্ঠী টাকা ঢালবে এই প্রকল্পে।

এ দেশের একচেটিয়া মালিকরা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে তা মেরে দেওয়ার যে নজির স্থাপন করেছেন সেটা এই ক্ষেত্রে আর একবার স্মরণ না করে পারা যাচ্ছে না। আরও স্মরণ করা দরকার নতুন আন্তর্জাতিক করিডর যদি বাস্তবায়িত হয়ও, তার দ্বারা লাভবান কারা হবে? পণ্য চলাচলের খরচ বাঁচার সুযোগ কি ভারতীয় জনগণ পাবে? এ দেশের তেল ব্যবসার নজির বলে, কোম্পানিগুলির খরচ বাড়লে ভারতে তেলের দাম বাড়ে, খরচ কমলে তা কিন্তু কমে না। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে অন্য রকম কিছু আশা করাই বৃথা।

তা হলে ৪১০০ কোটি টাকার রোশনাই জ্বেলে ভারতীয় জনগণকে জি-২০ থেকে নরেন্দ্র মোদিজি কী উপহার দিলেন? বিশাল বড় ধোঁকা ছাড়া কিছু কি?