জয়নগরে শচীন ব্যানার্জী-সুবোধ ব্যানার্জী ভবন উদ্বোধন

ভবনের ফলকের আবরণ উন্মোচন করছেন সাধারণ সম্পাদক

দুই বিপ্লবীর জীবন-সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে তেজ ও সাহসের সাথে এগিয়ে আসুনঃ কমরেড প্রভাস ঘোষ

৩১ আগস্ট। ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন এবং ১৯৯০ সালের মূল্যবৃদ্ধি ও পরিবহণের ভাড়াবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহাসিক শহিদ দিবসে জয়নগরের বুকে অনুষ্ঠিত হল এক মহতী সমাবেশ। ওই দিন দলের দুই প্রবাদপ্রতিম নেতা কমরেড শচীন ব্যানার্জী এবং কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর নামাঙ্কিত ‘শচীন ব্যানার্জী-সুবোধ ব্যানার্জী ভবন’ উদ্বোধন হল। শচীন ব্যানার্জী ও সুবোধ ব্যানার্জী মেমোরিয়াল ট্রাস্টি বোর্ডের উদ্যোগে নির্মিত এই ভবনে ১১০০ আসনের অডিটোরিয়াম সহ ৩০০ আসনের সেমিনার হল ও লাইব্রেরির ব্যবস্থা থাকবে। প্রাথমিক ভাবে নির্মিত ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ।

 

বিশালতার দিক থেকে এর থেকে অনেক বড় বড় সমাবেশ প্রত্যক্ষ করেছে জয়নগর। কিন্তু এই সমাবেশ ঘিরে আবেগ, উচ্ছWলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। অল্প সময়ে এই ভবন নির্মাণ সহজ ছিল না। দলের কর্মীরা যেমন এই ভবন নির্মাণে দিন-রাত এক করে পরিশ্রম করেছেন, তেমনই আর্থিক এবং কায়িক শ্রম দিয়ে ভবন নির্মাণ সুসম্পন্ন করতে সাহায্য করেছেন স্থানীয় সর্বস্তরের মানুষ। সমাবেশে মায়েরা এসেছেন শিশুদের নিয়ে, ছাত্র-যুবকেরা আগ্রহের সাথে শুনেছেন কমরেড শিবদাস ঘোষের সুযোগ্য ছাত্র কমরেড প্রভাস ঘোষের বক্তব্য, বুঝে নিয়েছেন এ দেশের বুকে শোষণহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সঠিক আদর্শের ভিত্তিতে এই মানুষগুলির মতো কষ্টকঠিন সংগ্রামই একমাত্র রাস্তা। প্রবীণ মানুষেরা কেউ অশক্ত দেহে এসেছেন অপেক্ষাকৃত নবীনদের কাঁধে ভর দিয়ে, কেউ এসেছেন লাঠি বা ক্রাচ নিয়ে এই দুই প্রবাদপ্রতিম মানুষের স্মৃতি জাগরূক রাখতে।

নবনির্মিত ভবনের প্রবেশ পথের শুরুতেই ডানদিকে দক্ষিণ ২৪ পরগণায় দলের নেতৃত্বে পরিচালিত গণআন্দোলনের সুসজ্জিত প্রদর্শনী, কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল দুষ্কৃতীদের হাতে নিহত ২০০ জন শহিদের তালিকা, বাঁদিকে পুকুর ঘেঁষে বুক স্টল। একটু এগোলেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমাজপ্রগতিতে অগ্রগণ্য অসংখ্য মানুষ ও শহিদদের স্মৃতিতে নির্মিত ২৮ ফুট উচ্চতার সাদা-কালো রঙের স্মারক বেদি। মাঝের সাদা স্তম্ভটা যেন দল, আর কালো অংশগুলি যেন চারপাশ থেকে আঁকড়ে ধরে দলটাকে রক্ষা করে চলা অসংখ্য মেহনতি মানুষ। তার সামনেই নবনির্মিত মঞ্চ।

অসংখ্য মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। তারপর তিনি স্মারক বেদিতে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ভবনের মঞ্চে রাখা কমরেড শিবদাস ঘোষ, কমরেড শচীন ব্যানার্জী ও কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন তিনি। একে একে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান যথাক্রমে পলিটবুরো সদস্য সৌমেন বসু, স্বপন ঘোষ, রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। সভা সঞ্চালনা করেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তরুণ নস্কর। উপস্থিত ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃবৃন্দ।

শুরুতে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ স্মরণে রচিত সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। শচীন ব্যানার্জী-সুবোধ ব্যানার্জী মেমোরিয়াল ট্রাস্টি বোর্ডের প্রতিবেদন পাঠ করেন ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি সুজাতা ব্যানার্জী। এই দুই নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় শোষিত মানুষের মুক্তি সাধনের উদ্দেশ্যে আমৃত্যু যে কঠোর জীবনসংগ্রাম ও উন্নত চরিত্রের সাধনা করে গেছেন তা এই প্রতিবেদনে উঠে আসে। বলা হয়, এই উদ্দেশ্যেই তাঁরা জয়নগরের বুকে ক্লাব-লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। তাতে মনীষী চর্চা-বিতর্ক সভা-খেলাধূলা-যাত্রা-নাটকের আয়োজন হত। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, উন্নত রুচি-সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে, যে কোনও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে রুখে দাঁড়ানোর মতো মানুষ গড়ে তোলা। প্রতিবেদনে বেদনাময় চিত্তে স্মরণ করা হয় ইয়াকুব পৈলান, দেবপ্রসাদ সরকার সহ অসংখ্য নেতার মৃত্যুজনিত অনুপস্থিতি এবং অসংখ্য শহিদের আত্মদানকে, যাঁরা এই ভবন নির্মাণের শুরু থেকেই উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। প্রতিবেদনে দৃঢ় প্রত্যয়ে বলা হয়– এই ভবন মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক শিবদাস ঘোষের দুই সহযোদ্ধার স্মৃতি বহন করে সমাজ পরিবর্তনের মহতী সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়ে যাবে চিরদিন।

শচীন ব্যানার্জী-সুবোধ ব্যানার্জীর সংগ্রামী ভূমিকা স্মরণে রচিত সঙ্গীত এবং সুবোধ ব্যানার্জীর স্বরচিত গণসঙ্গীত পরিবেশন করে পিসিএআই পরিচালিত সঙ্গীত গোষ্ঠী। শহিদ কিশোর কমরেড মাধাই হালদারের স্মৃতিতে রচিত সঙ্গীত স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৯০-এর রক্তাক্ত সংগ্রামী ইতিহাসের কথা। এরপর আনুষ্ঠানিক ভাবে ভবনের দ্বারোদঘাটন করেন কমরেড প্রভাস ঘোষ। তাঁর হাতে শচীন ব্যানার্জী-সুবোধ ব্যানার্জী স্মারক তুলে দেন বোর্ডের সম্পাদক নন্দ কুণ্ডু। কিশোর বাহিনী কমসোমলের ৩৩ জন স্বেচ্ছাসেবক (১৯৯০-এর ৩১ আগস্ট থেকে ২০২৩-র ৩১ আগস্টের স্মৃতিতে) মহান নেতাদের গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে।

জনসমাগমে উপচে পড়া সভায় কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক, সর্বহারার মুক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক এবং দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষের সুযোগ্য অনুগামী এবং বীর বিপ্লবী সহযোদ্ধা কমরেড শচীন ব্যানার্জী ও কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর নামাঙ্কিত ভবন উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রথমেই মনে হচ্ছে, সদ্য অনুষ্ঠিত ৫ আগস্ট বিশাল ব্রিগেড সমাবেশের ব্যাপকতা ও গভীরতা এবং স্ব-আরোপিত শৃঙ্খলা, জনসাধারণের একাগ্র চিত্তে শোনার ব্যাকুল আগ্রহ দেশবাসীকে মুগ্ধ করেছে, দলের প্রতি জনগণের আস্থা আরও বাড়িয়েছে– এর কতটুকু কৃতিত্ব আমাদের প্রাপ্য আর কতটা অবদান কমরেড শচীন ব্যানার্জী-সুবোধ ব্যানার্জীর মতো নেতাদের!

দল গঠনের শুরুতে যখন কমরেড শিবদাস ঘোষ একা লড়াইয়ের সূচনা করেছিলেন, তখন তাঁর কোনও পরিচয় নেই, কোনও নাম নেই, লোকজন নেই, থাকা-খাওয়ার সংস্থান নেই, সেদিন যাঁরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কমরেড নীহার মুখার্জী সহ কমরেড শচীন ব্যানার্জী, কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী, কমরেড প্রীতীশ চন্দ, কমরেড হীরেন সরকার। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তীব্র আদর্শগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ এই দল গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ বিরোধী ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে আলিপুর জেলে থাকাকালীন কমরেড শিবদাস ঘোষের সঙ্গে কমরেড শচীন ব্যানার্জীর পরিচয়। শিবদাস ঘোষ অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন, শচীন ব্যানার্জী যুগান্তর দলে যুক্ত ছিলেন। জেলেই কমরেড শিবদাস ঘোষ মা’র্বাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গভীর উপলব্ধি থেকে বুঝতে পারেন, এ দেশে যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি নেই। তিনি নতুন দল গড়ার আহ্বান করেন। এ বিষয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের দৃঢ় প্রত্যয়, তাঁর বক্তব্যের প্রভাব কমরেড নীহার মুখার্জী, কমরেড শচীন ব্যানার্জীদের আকৃষ্ট করে। একদিকে তাঁর বক্তব্যের শক্তি, দৃঢ়তা, তেমনই যাঁরা আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁদেরও সত্যের প্রতি বিশ্বাস, তাঁরা যেভাবে জীবন-মরণ পণ করে সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন, তা অত্যন্ত দুর্লভ, দৃষ্টান্তমূলক ও প্রশংসনীয়। ১৯৪৬ সালে শচীন ব্যানার্জী প্রথম সুবোধ ব্যানার্জীকে নিয়ে যান কমরেড শিবদাস ঘোষের কাছে। সুবোধ ব্যানার্জী তখন সেবামূলক কাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর সুবোধ ব্যানার্জী সঠিক দিশা খুঁজে পান। স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে দল গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, তখন দক্ষিণ ২৪ পরগণার বিস্তীর্ণ এলাকা দুর্গম, নদীবেষ্টিত ও বিপদসঙ্কুল। জঙ্গলে বাঘ, নদীতে কুমির– কমরেড শচীন ব্যানার্জী কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে একটার পর একটা গ্রামে গরিব চাষি-খেতমজুর-ভাগচাষিদের কাছে জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান নিয়ে গেছেন। তিনি দরিদ্র, শিক্ষা-বঞ্চিত মানুষদের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করলেন। সাথে সামিল হলেন কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীও। দক্ষ সংগঠক শচীন ব্যানার্জীর অসমসাহসী ভূমিকা আর সুবক্তা সুবোধ ব্যানার্জীর লড়াইয়ের উদাত্ত আহ্বান চাষি-মজুরদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। শচীন ব্যানার্জীর জহুরির মতো চোখ ছিল, মানুষ চিনতে পারতেন। অল্প কথার মধ্যেই তাঁর মূল্যবান আহ্বান অন্যের বিবেককে স্পর্শ করত, প্রাণসঞ্চার করত। এই জেলায়– ইয়াকুব পৈলান, কমরেড আমির আলি হালদার, রেণুপদ হালদার, রবীন মণ্ডল, নলিনী প্রামাণিক সহ যাঁরা নেতৃস্থানীয় ছিলেন এবং পরবর্তী স্তরের অনেক নেতা ও সংগঠককেকমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ এবং শোষিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামে সামিল করেছিলেন কমরেড শচীন ব্যানার্জী। এক দিকে কমরেড সুবোধ ব্যানার্জীর মর্মস্পর্শী আবেদন, অন্য দিকে কমরেড শচীন ব্যানার্জীর একটি একটি করে কর্মী-সংগঠক গড়ে তোলা, তাঁদের দলের দায়িত্ব দেওয়া। আর এর সাথে যুক্ত হল বিভিন্ন এলাকায় কমরেড শিবদাস ঘোষের অসংখ্য রাজনৈতিক ক্লাস। বহু শিক্ষিত যুবক সেই সময় দলে যুক্ত হয়েছিলেন। সে সময় জোতদার-জমিদারদের বিরুদ্ধে দলের নেতৃত্বে লড়াই করে ভাগচাষিদের দাবি আদায় হয়, বহু জমি উদ্ধার হয়, গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ হয়। এর ভিত্তিতে অত্যন্ত শক্তিশালী সংগঠন গড়ে ওঠে।

কমরেড শচীন ব্যানার্জী এতটাই দক্ষ সংগঠক ছিলেন যে বিভিন্ন রাজ্যেও তিনি দক্ষতার সাথে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তৎকালীন বিহারের সিন্দ্রিতে কমরেড প্রীতীশ চন্দকে নিয়ে শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তুলেছিলেন। মালিক পক্ষের দালালরা কমরেড শচীন ব্যানার্জী এবং কমরেড প্রীতীশ চন্দের উপর জঘন্যতম আক্রমণ চালায় ও জখম করে। তা সত্ত্বেও তাঁরা কাজ চালিয়ে যান। ওই কারখানাতেই তিনি দলের সঙ্গে যুক্ত করেন পুরুলিয়ার কমরেড সাধুচরণ ব্যানার্জীকে। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরুলিয়ার চলে আসেন, আড়শা, বাঘমুণ্ডিতে প্রথম দল গড়ে তোলেন। ওই কারখানা থেকে কমরেড গগন পট্টনায়ককে অনুপ্রাণিত করে কমরেড শচীন ব্যানার্জী তাঁকে নিয়ে ওড়িশার কটকে যান এবং সেখানে প্রথম পার্টি সংগঠন গড়ে তোলেন। পরে তাঁকে নিয়ে ওড়িশার সুকিন্দাগড়ে বনাঞ্চল ধ্বংসের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং খনি শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি।

১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলনে ঘোড়সওয়ার পুলিশের ঘোড়ার পায়ের তলায় পড়ে কমরেড শচীন ব্যানার্জীর পাঁজর ভেঙে যায়। পরে ফুসফুস আক্রান্ত হলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। জয়নগরে শহরে তিনি এত জনপ্রিয় ছিলেন যে একটানা ২৩ বছর মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার ছিলেন। পরে অসুস্থ হলে ঘাটশিলায় স্বাস্থে্যাদ্ধারের জন্য তাঁকে পাঠানো হলেও ফুসফুস অকেজো হওয়ায় শরীর ভেঙে পড়ে। ১৯৮৫ সালের ৫ আগস্ট কমরেড শিবদাস ঘোষের স্মরণসভায় আসতে চাইলে কমরেড নীহার মুখার্জী তাঁকে ওই শরীরে আসতে বারণ করেন। কিন্তু তিনি জানান, যাঁর শিক্ষায় সবকিছু ছেড়ে এলাম, সারা জীবন লড়াই করলাম, তাঁর স্মরণসভায় যাব না! আর যদি আসতে না পারি? আমাকে নিষেধ করবেন না। ৫ আগস্ট ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও কলকাতার় সমাবেশে তিনি যোগ দেন। এরপরই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, পরে হার্ট অ্যাটাকে তিনি মারা যান। এই সব কথা স্মরণে এলে মনে হয় এই দল বিকাশের ক্ষেত্রে, বিস্তারের ক্ষেত্রে আমাদের অবদান কতটুকু আর তাঁদের কতটা!

কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, ১৯৫০ সালে যখন আমি দলে আসি, তখন দলে অর্থসঙ্কট তীব্র। সুবোধ ব্যানার্জী কলকাতায় একটা মেসে থেকে টিউশন করতেন। মেস চালানোর জন্য সামান্য অর্থ রেখে বাকিটা দলকে সাহায্য করতেন। সর্বহারা শ্রেণির প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৫২ সালে প্রথম বিধায়ক নির্বাচিত হন কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী। মহান লেনিনের শিক্ষা, শোষণের অবসান, মেহনতি মানুষের মুক্তি একমাত্র সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন অর্থাৎ বিপ্লবের দ্বারাই সম্ভব। ভোটের দ্বারা বুর্জোয়ারা ঠিক করে, কোন দল তাদের হয়ে কাজ করবে। জনগণের মধ্যে যেহেতু ভোট সম্পর্কে মোহ আছে, তাই বিপ্লবীরা ভোটে যায় এটা প্রমাণ করার জন্য যে পার্লামেন্টে, বিধানসভায় সমস্যার সমাধান হবে না, বিপ্লবের পথই একমাত্র রাস্তা। এই আদর্শকে সামনে রেখে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় তিনি দেখালেন, বিধানসভার ভেতরেও শোষিত জনগণের-শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধি-বিপ্লবী দলের প্রতিনিধি হিসাবে বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করতে হয়। প্রতিদিন বিধানসভায় যাওয়ার আগে তিনি কমরেড শিবদাস ঘোষের সাথে আলোচনা করে তাঁর সুচিন্তিত অভিমত নিতেন। তার ভিত্তিতে বিধানসভায় তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি সহ বক্তব্য গোটা পশ্চিমবঙ্গে আলোড়ন সৃষ্টি করে। জননেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর জনপ্রিয়তায় এস ইউ সি আই (সি) জয়নগরের পার্টি থেকে ৬০-এর দশকে সুবোধ ব্যানার্জীর পার্টি হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছিল। আর সুবোধ ব্যানার্জীকে বোঝাতে হত, এটা কমরেড শিবদাস ঘোষের পার্টি। আমার এই ক্ষমতা-যোগ্যতা কমরেড শিবদাস ঘোষের জন্য, আমি তাঁর ছাত্র।

১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট এবং ১৯৬৯-এ দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টে মন্ত্রী হয়েছিলেন কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার ভিত্তিতে পার্টি কয়েকটি শর্ত দিয়েছিলেন প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারকে– সরকারি অর্থ গরিব মানুষের জন্য ব্যয় করতে হবে, ঘুষ বন্ধ করতে হবে, শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে, কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের আন্দোলনে পুলিশি আক্রমণ চলবে না। বাকি শর্তগুলি যুক্তফ্রন্ট সরকারের শরিকরা সমর্থন করলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাত দিয়ে শেষ শর্তটিতে প্রবল আপত্তি করল। মন্ত্রী হয়েই সুবোধ ব্যানার্জী ঘোষণা করলেন, ন্যায়সঙ্গত গণআন্দোলনে পুলিশি হস্তক্ষেপ চলবে না। এই আশ্বাস পেয়ে পশ্চিমবঙ্গে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-গণআন্দোলন ফেটে পড়ল। ভারতে তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল। টাটা-বিড়লা সহ অন্যান্য পুঁজিপতি গোষ্ঠী আতঙ্কিত হয়ে পড়ল।

অন্য দিকে দেশের নানা প্রান্তে সুবোধ ব্যানার্জীকে শ্রমিকরা ডাকছে, তাঁর বক্তব্য শুনতে চাইছে। টাটা-বিড়লার চাপে জ্যোতি বসু ও অজয় মুখার্জীর মধ্যে গোপন বৈঠক হয়। তাতে সুবোধ ব্যানার্জীকে সরানোর কথা হয়। সেই সময় সুবোধ ব্যানার্জীর লিউকোমিয়া ধরা পড়ে। পরে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার ভয় পেয়ে আমাদের শ্রম দপ্তর না দিয়ে পূর্ত দপ্তর দিল। দলের নীতিটি যাতে বহাল থাকে সে জন্য পূর্তদপ্তরই আমরা মেনে নিই এবং সেই দপ্তরও তিনি দলের নীতি বহাল রেখে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন। তিনি হাইকোর্টের পাশে বিপ্লবী ক্ষুদিরামের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এই মূর্তি তৈরি করেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড তাপস দত্ত। শহিদ মিনারের নামকরণ, বিনয়-বাদল-দীনেশের মূর্তি স্থাপন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মূর্তি ও বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের রূপকার মহান লেনিনের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ভবানী ভবনের নামকরণ ও লেনিনের নামে রাস্তার নামকরণও করেন তিনি। কমরেড সুবোধ ব্যানার্জী যখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় তখনও ‘কেন এস ইউ সি আই (সি) ভারতের মাটিতে একমাত্র সাম্যবাদী দল’ বইটির ইংরেজি অনুবাদ করছেন। তাঁর মৃত্যুতে সেটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। উল্লেখ্য, তিনি যখন প্রায় মৃত্যুশয্যায় তখন এক কারখানার মালিক কমরেড ব্যানার্জীকে ওষুধ কিনে দিতে চান, কিন্তু সুবোধবাবু তা প্রত্যাখান করেন এবং বলেন, আমি সারা জীবন মালিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। ফলে তাদের দেওয়া অর্থে কেনা ওষুধ আমি গ্রহণ করতে পারব না।

তাঁর লেখার দক্ষতা ছিল, গণদাবীর সম্পাদক ছিলেন দীর্ঘদিন। দলের তৎকালীন ইংরেজি মুখপত্র সোসালিস্ট ইউনিটির সম্পাদক ছিলেন।

কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আর্থিক সংকট চূড়ান্ত, শোষণে জর্জরিত মানুষ, অন্যদিকে মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করছে পুঁজিবাদ। মুনাফার স্বার্থে পরিবেশ ধ্বংস করছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষক দলগুলি মানুষের জীবনে সর্বাত্মক সংকট নিয়ে আসছে। তিনি বলেন, নির্বাচনে নানা রঙিন প্রতিশ্রুতি, দেদার টাকার স্রোত বইলেও মানুষের সমস্যার কোনও সমাধান হবে না। বিজেপি-কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূল সকলেই ভোটসর্বস্ব দল, ভোটের স্বার্থে করতে পারে না এমন কাজ নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনের সমস্যার সমাধান করতে হলে, তাদের কাজের অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার আদায় করতে হলে গরিবের দলকে চিনতে হবে। এর জন্য রাজনীতি সচেতন হতে হবে। বিপ্লবী রাজনীতিকে বুঝে তাকে শক্তিশালী করতে হবে। কমরেড প্রভাস ঘোষ উপস্থিত যুবকদের কাছে আবেদন জানান, তারা যেন অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে শচীন ব্যানার্জী-সুবোধ ব্যানার্জীর মতো তেজ নিয়ে, সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন। আর প্রবীণদের আহ্বান জানান, তারা যেন ঘরের সন্তানদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে এগিয়ে দেন। শেষে কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্যের কিছু অংশ রেকর্ড থেকে শোনানো হয়। যখন সভাস্থল ছেড়ে যাচ্ছেন সকলের কানে তখন বাজছে কমরেড শিবদাস ঘোষের উদাত্ত আহ্বান– বিপ্লবী রাজনীতি উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি। শত আঘাতেও, অত্যন্ত শোকের মধ্যেও বিপ্লবীর দায়িত্ববোধ ভুলে গেলে চলে না।