চন্দ্রযানের সাফল্যের কারিগররা ১৮ মাস বেতনহীন

সমস্ত উৎকন্ঠা, অনিশ্চয়তা দূর করে ২৩ আগস্ট চন্দ্রযান-৩ চাঁদের মাটিতে সফল ভাবে অবতরণ করেছে। কিন্তু বরাবরই চাঁদের দক্ষিণ মেরু মানুষের কাছে অজানাই থেকে গেছে। চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্য এখানেই যে এই প্রথমবার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে কোনও নভযানের সফল অবতরণ হয়েছে। তাই এই চন্দ্রাভিযান ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ।

চন্দ্রযান-৩-এর সফল অবতরণের ফলে গোটা দেশেই উচ্ছ্বাস এবং আনন্দের বাতাবরণ। কিন্তু এই আনন্দের দিনেও চোখে জল রাঁচির ‘হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন’ (এইচইসি)-র ২৫০০ কর্মীর। এই কর্মীরাই দিন-রাত এক করে বানিয়েছেন চন্দ্রযান-৩-এর বিভিন্ন জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ। চন্দ্রযান-৩-এ ব্যবহৃত মোবাইল লঞ্চিং প্যাড, স্লাইডিং দরজা, ক্রেন তৈরি করেছেন তাঁরাই। অথচ চরম দারিদ্রের মধ্যে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা। ১৮ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না সংস্থায় কর্মরত আধিকারিক, ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান ও অন্যান্য কর্মীরা। চরম আর্থিক সংকটের কবলে পড়ে কর্মীদের অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন অন্য পেশা বেছে নিতে। কেউ বিক্রি করছেন চা, কেউ ফল-সবজি আবার কেউ আখের রস বিক্রি করছেন সংসার চালাতে। অর্থের অভাবে অনেকেরই ছেলে-মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে। অনেকে তাদের বৃদ্ধ বাবা-মার চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পারছেন না। বিনা চিকিৎসায় প্রিয়জনদের মৃত্যুও দেখতে হয়েছে কয়েকজনকে। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সকলের কাছেই চিঠি লেখা হয়েছে সংস্থার পক্ষ থেকে। কিন্তু সমাধান কিংবা আশ্বাস কোনওটাই মেলেনি। চন্দ্রযান-৩ এর সফল অবতরণের পর আশায় বুক বেঁধেছেন সংস্থার কর্মীরা। তবে এখনও পর্যন্ত সরকারি তরফে কোনও আশার কথা শোনা যায়নি। এই অবস্থায় সংস্থার কর্মীরা ঠিক করেছেন আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে কোনও সুরাহা করা না হলে তাঁরা নিজেদের পরিবার ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনকে সাথে নিয়ে রাজভবন ঘেরাও করবেন এবং বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যাবেন। চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্য যেমন দেশবাসী হিসেবে আমাদের গর্বিত করে একই ভাবে এই চন্দ্রযান তৈরির যারা কারিগর তাদের ১৮ মাস বেতনহীন যন্ত্রণার ছবি আমাদের লজ্জা দেয়।

ভারতের এই সফল চন্দ্রাভিযান স্বাভাবিক ভাবেই গোটা বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে নতুন অবদান রাখল। পাশাপাশি দেখিয়ে গেল, মানবজাতির কল্যাণের লক্ষ্যে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করলে মানুষের অর্জিত জ্ঞান, অধ্যবসায়, কর্মদক্ষতা ও প্রচেষ্টা কী অসাধ্যসাধনই না করতে পারে!

বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রায় মানুষ যখন মুগ্ধ, বিস্মিত, ঠিক সেই সময়ে, গত ২৩ আগস্ট মধ্যপ্রদেশে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে স্বয়ং ইসরো চেয়ারম্যান অনৈতিহাসিক ও অবৈজ্ঞানিক এমন এক মন্তব্য করেছেন, যা এ হেন পদে অধিষ্ঠিত একজনের কাছ থেকে আশাই করা যায় না। তিনি বলেছেন, বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও সূত্রাবলির উৎস হল বেদ। বিমানবিদ্যার বৈজ্ঞানিক নিয়ম, মহাবিশ্বের গঠন সহ আধুনিক নানা ধারণা, সবই নাকি বেদে আছে। সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়, বেদের যুগে, বিজ্ঞান যখন তন্ত্রমন্ত্র ও প্রকৃতি-উপাসনার স্তরে, সেই সময়ে আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও সূত্র আবিষ্কার করা বাস্তবেই সম্ভব ছিল না। কারণ, তার বাস্তব ভিত্তিটুকুও তখন তৈরি হয়ে ওঠেনি। ইসরো চেয়ারম্যান এমন মন্তব্য করে ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী শাসকদের প্রীতিলাভে হয়ত সফল হয়েছেন, কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার পথে তাঁর এই মন্তব্য অবশ্যই বাধা সৃষ্টি করবে, যা মানবকল্যাণের প্রবল অন্তরায়।