কেরিয়ারের নিশির ডাক

আবারও মৃত্যুর অন্ধকারে ঝাঁপ দিল এক কিশোরী ছাত্রী, রাজস্থানের কোটায়। এই নিয়ে এক বছরে সেখানে আত্মঘাতী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়াল ২৫। গত ২৬ আগস্ট কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কোটায় পড়তে আসা দু’জন ছাত্রের আত্মহত্যার খবর স্তব্ধ করে দিয়েছিল মানুষকে। সে স্তব্ধতা যেন কাটছেই না।

‘৯০-এর দশকের শুরুর দিক থেকে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং-কে কেরিয়ার করতে চাওয়া ছাত্রছাত্রীদের ভিড় শুরু হয়েছিল কোটা শহরের কোচিং সেন্টারগুলিতে। এখনও নিট বা জেইই-র মতো কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হওয়ার লক্ষে্য প্রতি বছর বিপুল সংখ্যায় ছাত্রছাত্রী এখানকার কোচিং সেন্টারগুলিতে ভর্তি হয়। এছাড়া আইআইটি বা চাকরির সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলির জন্যও এখানে কোচিং চলে। বর্তমানে প্রায় দু’লক্ষ ছাত্রছাত্রী উজ্জ্বল কেরিয়ারের স্বপ্ন নিয়ে এখানে থেকে পড়াশোনা করছে। কোটায় রমরমিয়ে চলছে কোচিং ব্যবসা।

এই উজ্জ্বলতার মধ্যে হিংস্র শ্বাপদের মতো মাঝে মাঝেই হানা দিচ্ছে মৃত্যুর কালো ছায়া। কোটায় প্রতি বছর একের পর এক ছাত্রছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে চলেছে। গত বছরে ঝরে গেছে ১৫টি তাজা প্রাণ। তার আগের বছরগুলিতে কখনও ৪ জন, কখনও ৮ জন, কোনও বছর ১২ বা ১০ জন ছাত্রছাত্রী আত্মঘাতী হয়েছে। এ বছর এই সংখ্যা এখন পর্যন্ত দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে। এদের সকলেরই বয়স ১৫ থেকে ১৮-র মধ্যে। সদ্য কৈশোরের সীমা পার হওয়া যে বয়সে মন থাকে খুশিতে ভরপুর, পৃথিবীর সব কিছুকে সুন্দর বলে মনে হয়, যাবতীয় বিপদ, সমস্যা মোকাবিলা করার আত্মবিশ্বাস থাকে বুকের ভিতরে, সেই বয়সের ছেলেমেয়েরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন গড়ার আশায় পড়তে এসে এভাবে মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছে কেন?

উত্তর খুঁজতে গিয়ে কোটায় কোচিং সেন্টারের প্রাক্তনীদের অনেকে বলেছেন, সেন্টারগুলি শুধু তাদের ব্যবসা বাড়ানোর দিকেই নজর দেয়, ছাত্রছাত্রীদের মানসিক পরিস্থিতি নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায় না। সেন্টারগুলির মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা প্রবল হওয়ায়, তারা সকলেই নিট বা জেইই পরীক্ষায় সাফল্যকেই পাখির চোখ করে। তা করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপর পড়াশোনা ও পরীক্ষার ভয়ঙ্কর চাপ সৃষ্টি করেন শিক্ষকরা। অনেক সময় কারও কাছে সেই চাপ এতটাই অসহনীয় হয়ে ওঠে যে তারা মৃত্যুর মধ্যেই এই চাপের হাত থেকে মুক্তির রাস্তা খোঁজে।

মনোবিদরা সমীক্ষা করে দেখেছেন, কোটায় ১০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে চারজনই মানসিক অবসাদের শিকার। ১০ জনের মধ্যে আট জন লড়ছে উদ্বেগ ও মানসিক চাপের বিরুদ্ধে। তাঁরা দেখাচ্ছেন, ছাত্রছাত্রীদের এই যন্ত্রণাদায়ক মানসিক পরিস্থিতির পিছনে রয়েছে মা-বাবার উচ্চাশা পূরণ করতে পারা নিয়ে ভয়ঙ্কর উদ্বেগ। এখানে পড়তে আসা অনেক ছেলেমেয়েই মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের। কারও বাবা-মা ঋণ করে, কেউ বা জমি-সম্পত্তি বিক্রি করে কোটায় পড়ানোর লক্ষ লক্ষ টাকা জোগাড় করেন। ফলে ছেলেমেয়েদের তাড়া করে বেড়ায় যে কোনও মূল্যে নিট-জেইই-র মতো কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হওয়ার চাপ। না পারলে বাবা-মার স্বপ্ন পূরণ করা যাবে না, জলে যাবে কোচিং-এর জন্য অতি কষ্টে জোগাড় করা টাকা– এই চিন্তা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রবল উদ্বেগের জন্ম দেয়। এদের মধ্যে কারও হয়তো ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং আদৌ পছন্দের বিষয়ই নয়। বিজ্ঞানের বিষয়গুলি হয়তো টানেই না তাদের। বহু ক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের চাপে নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করার বদলে তাদের ঝাঁপ দিতে হয় নিট বা জেইই পরীক্ষায় সফল হওয়ার যুদ্ধে। নিজের পছন্দের বিষয়ের গভীরে ডুব দেওয়া হয় না তাদের। এদিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অঙ্কের মতো কঠিন বিষয় পড়তে এসে সেগুলি ঠিকমতো বুঝতে পারা, গ্রহণ করা তাদের অনেকের পক্ষেই হয়ে ওঠে অত্যন্ত কঠিন। অথচ মাথার উপর খাঁড়ার মতো ঝুলছে বাবা-মায়ের প্রত্যাশা। সঙ্গে রয়েছে কোচিং সেন্টারের অমানুষিক চাপ। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর হতাশা, ব্যর্থতার বোধ, হীনমন্যতা গ্রাস করে কিশোর-কিশোরীদের তরুণ মনগুলিকে। উদ্বেগ, ব্যর্থতার আশঙ্কা অসহনীয় হয়ে উঠলে, গভীর অন্ধকারে সামান্য আশার আলোটুকুও হারিয়ে গেলে শেষপর্যন্ত কেউ কেউ মৃত্যুর কাছে নিরুপায় আশ্রয় খোঁজে। স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়ে মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে লিখে রেখে যায় চোখের জলে ভেজা সুইসাইড নোট। কেউ বা নীরবেই বিদায় নেয়।

পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজস্থান সরকারের মন্ত্রী, পুলিশ, প্রশাসনের কর্তারা নানা দাওয়াইয়ের নিদান দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেওয়া দরকার, কোথাও কয়েক মাস পরীক্ষা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, পুলিশের পক্ষ থেকে কোথাও হেল্পলাইন খোলা হচ্ছে, কোথাও বা নানা ধরনের যান্ত্রিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, যাতে গলায় দড়ি দিয়ে বা ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে কেউ মরতে না পারে।

কিন্তু এ সবই গভীর ক্ষত ঢাকতে চামড়ার উপরের স্তরে সামান্য একটু মলমের আস্তরণ। আসল অসুখ রয়েছে সমাজের গভীরে। যে মরতে বসা ব্যবস্থা সিন্দবাদ নাবিকের গল্পের সেই সমুদ্র-বুড়োর মতো চেপে বসে রয়েছে সমাজের কাঁধে, কোটায় কিশোর-কিশোরীদের এই মর্মান্তিক অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী আসলে সেই ব্যবস্থারই অন্তঃসারশূন্যতা।

সমাজ জুড়ে আজ এক প্রবল অনিশ্চয়তা। সর্বোচ্চ মুনাফা লুটের লক্ষে্য ছুটতে থাকা এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখার মতো সম্পদের অভাব না থাকলেও অভাব রয়েছে সেই সম্পদ ভোগ করার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার। বেকার সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দিনে দিনে তা চরমতর আকার নিচ্ছে। এই অবস্থায় সন্তানের ভবিষ্যৎ-চিন্তায় স্বাভাবিক ভাবেই আকুল হয়ে উঠছেন অভিভাবকরা। কী করলে ছেলেমেয়েরা আর্থিক দিক দিয়ে স্বনির্ভর হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে, নিশ্চিন্ত জীবনের অধিকারী হয়ে সুখে দিন কাটাতে পারবে– সেই চিন্তায় বাস্তবিকই ঘুম নেই বাবা-মায়েদের। তাই যেমন করে হোক তাদের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা বড় চাকুরে বানাতে মরিয়া হয়ে উঠছেন তাঁরা। সন্তানের পছন্দের বিষয় কোনটি, তা জানা বা সেই বিষয় নিয়ে পড়াশোনায় এগিয়ে দেওয়ার বদলে নিশ্চিত রোজগারের আশায় ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দিকে তাদের ঠেলে দিচ্ছেন মা-বাবারা। যদিও বেকারত্বের হাঁ-মুখ ইদানীং গ্রাস করে নিচ্ছে বহু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারকেও। সমস্ত দফতরে সরকারি নিয়োগ বন্ধ। নতুন কারখানা একটা খুললে দশট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশ বেকারে ছেয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারি দফতরগুলিতে নিতান্ত নিচের তলার পদে কাজ পাওয়ার জন্যও শয়ে শয়ে উচ্চশিক্ষিতদের সঙ্গে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিধারীদেরও আবেদন করার খবর মাঝে মাঝেই সংবাধমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবুও– ‘আশা কুহকিনী’।

এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভিভাবকদের বিপুল উচ্চাকাঙক্ষার বিষয়টি। সবাইকে পিছনে ফেলে যে কোনও উপায়ে নিজেকে, নিজের সন্তানকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, সকলের মধ্যে শুধু নিজেকে বড় করে দেখা ও দেখানোর এই আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতাও ব্যক্তিমুনাফাকেন্দ্রিক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চরিত্রবৈশিষ্ট্য। যেহেত়ু উচ্চকোটির মানুষ হিসাবে সমাজে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের একটা বিশেষ মর্যাদা আছে, তাই বহু ক্ষেত্রেই ছেলেমেয়েকে ওই পদে আসীন করার প্রবল আকাঙক্ষা থাকে অভিভাবকদের। সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে তাই অনেক বাবা-মা জোর করে তাদের এই রাস্তায় ঠেলে দেন।

কোটার আত্মঘাতী কিশোর-কিশোরীদের অনেকেই তাদের বাবা-মায়ের এই অবুঝ উচ্চাকাঙক্ষার অসহায় শিকার। ফলে ফুলে ফেঁপে উঠছে কোটার কোচিং ব্যবসা। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত বছর কোটার শুধুমাত্র একটি নামজাদা কোচিং সেন্টারেই বিনিয়োগ হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। এমনকি বিদেশ থেকেও বিপুল পরিমাণে লগ্নি আসছে কোটার কোচিং ব্যবসায়। খাটছে বহুজাতিক পুঁজি। শহর ছেয়ে যাচ্ছে একের পর এক কোচিং সেন্টারের সাফল্যের খতিয়ান ভরা রঙিন বিজ্ঞাপনে। বাবা-মায়েরা সন্তানের ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নের হাতছানিতে আরও বেশি করে পা বাড়াচ্ছেন রাজস্থানের এই ছোট শহরটির দিকে। কিছু সংখ্যক ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ই সাফল্যের মুখ দেখছে। কিন্তু বাকিরা? তাদের ব্যর্থতার গুমরে ওঠা কান্না পাক খাচ্ছে কোটা শহরের আকাশে-বাতাসে। হতাশা কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের অধিকাংশ। কেউ সফল হচ্ছে, আবার কারও জায়গা হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের মর্গে।

কেরিয়ারের জন্য এই মরণ-বাঁচন লড়াই, তাকে ঘিরে বিপুল মুনাফার ব্যবসা, কেরিয়ারকে কেন্দ্র করেই জীবনের মূল্যের পরিমাপ এবং পরিণামে প্রতি বছর এত ছাত্রছাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু– এই চক্র ভাঙতে গেলে প্রয়োজন পরিকল্পিত অর্থনীতির, যা দিতে পারে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। ব্যক্তি-মুনাফাভিত্তিক না হওয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বেকার সমস্যা মাথা তুলতে পারে না। সাধারণ মানুষের জীবনে সেখানে অনিশ্চয়তা নেই। কেরিয়ার এবং রোজগারের পরিমাণ দিয়ে নয়, সেখানে মানুষের সম্মান-মর্যাদা নির্ধারিত হয় সমাজের জন্য তার পরিশ্রম ও অবদানের কথা মাথায় রেখে। তাই সমাজতান্ত্রিক সমাজে সন্তানকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর জন্য মা-বাবাকে মাথা কুটে মরতে হয় না। চলমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বাস করে এমন একটা সমাজ আজ স্বপ্ন বলে মনে হলেও পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়ন ও চিন এই কাজ করে দেখিয়েছে। সে দিন সমাজতান্ত্রিক দেশের ছেলেমেয়েরা জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ নিতে সক্ষম হয়েছে। সমাজের কল্যাণে আনন্দের সঙ্গে তারুণ্যের বিপুল শক্তিকে কাজে লাগাতে পেরেছে তারা। দেশকে তারা এগিয়ে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়। পুঁজিবাদী ভারতের নিরুপায় ছেলেমেয়েদের মতো কেরিয়ারের নিশিডাকে বিভ্রান্ত হয়ে অসহনীয় মানসিক চাপের হাত থেকে বাঁচতে মৃত্যুর হাতে নিজেকে সঁপে দিতে হয়নি তাদের।

যতদিন এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকে থাকবে তত দিন এমন ঘটনার পুরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে এই মৃত্যু মিছিল বন্ধ করা যাবে না।