কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা বিশ্বের কমিউনিস্টদের নজর কেড়েছে– কমরেড কে রাধাকৃষ্ণ

ব্রিগেডের সভায় সভাপতি কমরেড কে রাধাকৃষ্ণ

আমাদের প্রিয় নেতা, শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক, এই যুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ স্মরণে সমবেত এ এক বিশাল জনসমুদ্র। এটি খুব আনন্দের বিষয় যে, আমরা বর্ষব্যাপী জন্মশতবর্ষ পালনের পর আজ এই বিশাল সমাপনী সমাবেশে সমবেত হয়েছি। সারা বছর ধরে সমগ্র দেশে, প্রতিটি কোণায়, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে, কলকারখানায়, শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, ছাত্র, যুবক ও মহিলাদের মধ্যে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা প্রচার করা হয়েছে, কমরেড শিবদাস ঘোষকে নিয়ে চর্চা হয়েছে, সারা দেশে কমরেড শিবদাস ঘোষের নাম ধ্বনিত হয়েছে। তাঁকে নিয়ে নতুন আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

কমরেড, এই গৌরবময় অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা আমাদের প্রিয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। তিনি সর্বহারা শ্রেণির মহান নেতা কমরেড ঘোষের কমরেড-ইন-আর্মস (সহযোদ্ধা)। তাঁর বলার আগে আমি কয়েকটি কথা বলতে চাই। তা হল, কমরেড শিবদাস ঘোষের অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ চিন্তাভাবনা, তাঁর উপলব্ধির গভীরতা। যেভাবে তিনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন উপলব্ধি করেছিলেন, সেটি আমাদের অনুধাবন করা খুব জরুরি। আজ আমরা তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী করা অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি। ১৯৭৬ সালে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু তিনি যা বলে গেছেন ধীরে ধীরে বিশ্বে তা স্বীকৃতি পাচ্ছে। বলশেভিক কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী নীনা আন্দ্রেভা যখন জীবিত ছিলেন, তিনি কমরেড শিবদাস ঘোষের লেখা বই ‘স্ট্যালিন বিরোধী পদক্ষেপ প্রসঙ্গে’ পড়েন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের দেশের মাটি থেকে তিন হাজার কিলোমিটার দূরে বসে রাশিয়ার অভ্যন্তরের সব কিছু কতটা ভাল ভাবে বুঝেছিলেন! কী গভীর বিশ্লেষণ, কী দূরদর্শিতা ছিল তাঁর! এমনই মন্তব্য করেছেন নীনা আন্দ্রেভা। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমরেড সারা ফ্লাউন্ডার্স কিউবা সম্পর্কে কমরেড শিবদাস ঘোষের বিভিন্ন মতামত সম্পর্কে একই ভাবে সহমত পোষণ করে বলছেন যে, কিউবান সংকটের বিষয়টি অন্য ভাবে মোকাবিলা করা উচিত ছিল। এমন কিছু আগাম সাবধানবাণীর কথা আমি বলছি। আজ বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্টরা কমরেড শিবদাস ঘোষের বিশ্লেষণ সম্পর্কে আগ্রহী হচ্ছেন।

কমরেডস, এগুলি স্রেফ অনুমান নয় বা অনুমান-নির্ভর ভবিষ্যদ্বাণী নয়। এটি ‘সকল বিজ্ঞানের বিজ্ঞান’ বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের গভীর উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে রচিত।

আমাদের দেশ সম্পর্কে কমরেড শিবদাস ঘোষের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল? আপনারা জানেন, তিনি কেবলমাত্র মহান মার্কসবাদী দার্শনিক ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার, বিপ্লবী ধারার একজন ভলান্টিয়ার। সেই ধারার অন্য বিপ্লবীদের মধ্যে প্রায় সকলের আগে কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখতে পেয়েছিলেন, ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার পরে স্বাধীন ভারতে কী ঘটতে চলেছে। স্বাধীন ভারত একটি পুঁজিবাদী দেশ হতে চলেছে এবং ব্রিটিশ শোষকদের স্থলাভিষিক্ত হবে ভারতীয় শোষক পুঁজিবাদী শ্রেণি। আজ এটি একশো শতাংশ সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে আপসহীন ধারা, তা শুধু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই নয়, সামন্তবাদের বিরুদ্ধেও আপসহীন ভাবে লড়াই করেছে। সেখানে কোনও আপস ছিল না। কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা কী, গান্ধী এবং তাঁর মতবাদ, যা বিপ্লববাদকে মূলধারায় পরিণত হতে দেয়নি, সেই অহিংসবাদের সঙ্গে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার পার্থক্য কোথায়, সে সব আপনারা জানেন। গান্ধীজি ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ছিলেন, যদিও তাঁর মত ও পথ ভুল ছিল। এটি শেষ পর্যন্ত বুর্জোয়া শ্রেণিকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল। এই ছিল মার্কসবাদের ভিত্তিতে কমরেড শিবদাস ঘোষের ভবিষ্যদ্বাণী, বিশ্লেষণ। তিনি বলেছিলেন, আর কিছু নয়, সর্বহারা বিপ্লবের প্রতি বুর্জোয়াদের ভয় থেকেই অহিংস মতবাদের জন্ম। বিপ্লবভীতি গান্ধীজির মানসিক জটিলতায় অহিংস তত্তে্বর রূপ নিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, গান্ধীজি সামন্ততন্ত্র, সামন্তী সংস্কৃতি, ধর্ম, বর্ণ, সব কিছুর সাথে আপস করেছিলেন। কমরেড, আজ আমরা সেই আপসের পরিণতি প্রত্যক্ষ করছি। কমরেড শিবদাস ঘোষ সেই শুরুর দিনেই বলেছিলেন, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে দার্শনিক নেতৃত্বে ছিল গান্ধীবাদ। নিঃসন্দেহে আমরা রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা পেয়েছি। তবে সাংস্কৃতিক ভাবে, সামাজিক ভাবে আমাদের দেশ ১০১টি বিষয়ে বিভক্ত– ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত, সম্প্রদায়, জাতি-উপজাতি এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ে। ভাষাগত ভাবে এটি একটি বহুভাষিক দেশ। আমরা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি। এটি থেকে গিয়েছে, কারণ আমাদের দেশে কোনও সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়নি। সাংস্কৃতিক-সামাজিক বিপ্লবের পতাকা ফেলে দেওয়া হয়েছে।

কমরেডস, আজ আমি কমরেড শিবদাস ঘোষের মহান শিক্ষার কথা স্মরণ করছি। দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা চলছে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে আজ মণিপুরে যা ঘটছে, তাও আমরা দেখছি। গোটা দেশ শুধু নয়, গোটা বিশ্বের নজর আজ মণিপুরের দিকে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কী চলছে, কী ধরনের বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, কীভাবে মহিলাদের উপর অত্যাচার চলছে, সব আমরা প্রত্যক্ষ করছি। এ প্রসঙ্গে কমরেড শিবদাস ঘোষের বিশ্লেষণ দেখুন। অত্যন্ত বেদনার সাথে তিনি দেখিয়েছেন যে, ধর্মের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দর্শন আপস করায় দেশের তিনটি বড় শক্তি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে পারেনি। একটি হল মুসলিম সম্প্রদায়। অপর একটি হল দলিত সম্প্রদায়। আর তৃতীয় শক্তি হল মহিলারা। এরা ছিল সমাজের সবচেয়ে নিপীড়িত অংশ। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যাপকভাবে যোগ দিতে পারেনি, কারণ গান্ধীর অধীনে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ছিল ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে হিন্দুধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, উচ্চবর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এই কারণেই এই তিনটি অংশ নিপীড়িত থেকে গেছে এবং আজও দেশ সেই পথেই হাঁটছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় শাসক ব্রিটিশ পুঁজিপতি শ্রেণি এই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি নিয়ে চলেছিল। ব্র্রিটিশরা ভারতে এটাই করেছে। স্বাধীনতার পরে ভারতীয় শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি সেই ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছিল এবং বর্তমানে শাসক পুঁজিবাদী শ্রেণি আরও বেশি করে বিভাজন এবং শাসন করার পথ গ্রহণ করছে। শুধু মণিপুর নয়, সমগ্র দেশকে বিভক্ত করা হয়েছে।

তাই, কমরেডস, আমরা সারা দেশে একত্রিত হচ্ছি, জোট বাঁধছি। আমরা কমরেড শিবদাস ঘোষের ছাত্র, আজ দায়িত্ব আমাদের কাঁধে। আমরা পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অগ্রণী সৈনিক। আজ আমরা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তার মশালবাহক। কমরেড শিবদাস ঘোষ চেয়েছিলেন পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়াদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে মানুষের দ্বারা মানুষের সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্ত শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে।

এই ক’টি কথা বলে আমি আমাদের প্রিয় নেতা, শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক, মহান মার্ক্সবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষকে আমার বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানাই। আমরা আবারও আমাদের দেশে পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধন করতে এবং তাঁর চিন্তাভাবনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নের প্রতিজ্ঞা করছি।

পুঁজিবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!