কংগ্রেস বিরোধী বুলি আওড়ে নরেন্দ্র মোদি জরুরি অবস্থার পথেই

মাত্র ক’দিন আগেই জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খুব বড় গলা করে বলেছিলেন, ভারত হল গণতন্ত্রের জননীস্বরূপা। গণতন্ত্র নাকি এখানে শিরায় শিরায় প্রবাহিত। প্রধানমন্ত্রীর এই কথাগুলি যে শুধুই বাকচাতুর্য, তা মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে তিনি নিজেই প্রমাণ করে দিলেন গণর চতুর্থ স্তম্ভ বলে কথিত সংবাদমাধ্যমের উপর হামলা চালিয়ে।

দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে নিউজক্লিক সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক ও কর্মীদের বাড়ি বাড়ি একযোগে হানা দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন বিজেপির শিরাতে আসলে বইছে স্বৈরতন্ত্র। পুলিশ এই সব সংবাদকর্মীদের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করেছে, পুলিশের স্পেশাল সেলের দফতরে তুলে নিয়ে গিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, কাউকে কাউকে গ্রেফতার করে সন্ত্রাসবিরোধী কঠোর আইন ইউএপিএ ধারায় মামলা করেছে। যদিও নিউজক্লিক জানিয়েছে, কোথায়, কী ভাবে তারা সন্ত্রাসে মদত দিচ্ছে তার কোনও প্রমাণ পুলিশ দেয়নি। কোনও সংবাদমাধ্যমের এবং তার সম্পাদকের বিরুদ্ধে এই ধারায় মামলা এর আগে কখনও হয়নি।

স্বাভাবিক ভাবেই এই তল্লাশি এবং কঠোর আইনে গ্রেফতারকে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন সহ গণতান্ত্রিক মানুষ, বুদ্ধিজীবীরা তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন এবং ঘটনাটিকে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ হিসাবেই দেখছেন। এস ইউ সি আই কমিউনিস্ট তীব্র ভাষায় এই আক্রমণের নিন্দা করেছে। সর্বত্রই প্রশ্ন উঠেছে, একটি সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে এমন একটা মারাত্মক আক্রমণ মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতর করল কেন?

কেন্দ্রে গত দু’দশকের বিজেপি শাসনের পর আজ আর কারও জানতে বাকি নেই যে, শুরু থেকেই এই সরকার কোনও রকম সমালোচনা বা বিরোধিতাকে সহ্য করে না– তা সে কোনও ব্যক্তি, সংগঠন বা সংবাদমাধ্যম, যে-ই করুক না কেন। আর এখন তো– যখন সরকারের পাহাড়-প্রমাণ ব্যর্থতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছে, নানা ভাবে তা সামনে এসে যাচ্ছে এবং এখানে সেখানে বিক্ষোভ-আন্দোলনের আকারে ফেটে পড়ছে, তখন একের পর এক বিধানসভা, লোকসভা নির্বাচনের সামনে সেই ক্ষোভকে আড়াল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার। ইতিমধ্যেই মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ বৃহৎ পুঁজির মালিকরা অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমকে কিনে নিয়ে দেশ জুড়ে মোদি-ভজনার স্রোত বইয়ে দিচ্ছে এবং জনমনে গোদী-মিডিয়া (সরকারের কোলে বসা) হিসাবে কুখ্যাতি কুড়িয়েছে। বাকি মিডিয়াগুলি যারা মোদি সরকারের কীর্তনের বিরুদ্ধে গিয়ে সত্য তুলে ধরতে চেয়েছে, তাদের সহবত শেখাতে তাই এ ভাবে ‘ঝিকে মেরে বউকে শেখানো’র চেষ্টা।

বাস্তবে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পাওয়ার মতো কোনও কাজ মোদি সরকারের দশ বছরের ইতিহাসে নেই। মূল্যবৃদ্ধি কিংবা বেকারিতে লাগাম পরানো, চাষিদের আয় বৃদ্ধি থেকে কালো টাকা উদ্ধার– কোনও একটি প্রতিশ্রুতিও এই সরকার রক্ষা করতে পারেনি। বরং মোদি জমানায় এই প্রতিটি সমস্যা আরও তীব্র আকার নিয়েছে। অন্য সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের মতোই ভারতের অবস্থাও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক সমস্ত দিক থেকে মোদি শাসনে শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। এবং সেই দুরবস্থা এমনই মাত্রাছাড়া যে, কোনও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি কিংবা কথার চমক, কিছু দিয়েই আর তা চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে মানুষের ক্ষোভ আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।

গত লোকসভা নির্বাচনের আগে গণবিক্ষোভ প্রবল হয়ে উঠলে মোদি সরকার পুলওয়ামা হামলার ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের একাংশের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ঢেউ তুলতে পেরেছিল, যা সেই বিক্ষোভকে খানিকটা হলেও চাপা দিতে সক্ষম হয়েছিল। এ বার বিক্ষুব্ধ মানুষকে চমকে দিয়ে তাদের জীবনের সমস্যাগুলি থেকে দৃষ্টিকে সরিয়ে দিতে গোপনীয়তার ছলনায় লোকসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে তড়িঘড়ি মহিলা বিল নিয়ে এল। কিন্তু দেশের এমনকি সাধারণ মানুষেরও ধরতে অসুবিধা হয়নি যে, বিল পাশ করানোর আসল উদ্দেশ্য মানুষকে চমকে দেওয়া, তা কার্যকর করা নয়। স্বাভাবিক ভাবেই জনমনে তা কোনও আলোড়নই তৈরি করতে পারেনি।

এই অবস্থায় একটি স্বৈরাচারী সরকারের সামনে আর একটি রাস্তাই খোলা থাকে। তা হল, গায়ের জোরে সমালোচনার মুখ বন্ধ করে দেওয়া। দেশে এখনও যে অজস্র সংবেদনশীল মানুষ, চিন্তাশীল গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন বিভিন্ন পেশার মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে যে সমালোচনাগুলি প্রকাশ পাচ্ছে, সেগুলি যাতে আরও বড় হয়ে দেখা না দেয়, সেই জন্য বিজেপির কাছে সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করাটা খুবই জরুরি। আজ সরকারের নীতির বিরোধিতাকে– যে নীতির একমাত্র লক্ষ্য দেশের একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করা– সরকারের সমালোচনাকে আটকাতে সেগুলিকে দেশবিরোধিতা হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা তাদের অন্যতম কৌশল হয়ে উঠেছে। এর আসল লক্ষ্য, সব ধরনের সমালোচককে ভয় দেখানো, সমঝে দেওয়া, বুঝিয়ে দেওয়া যে, আমার বিরুদ্ধে মুখ খুললে দুর্গতি আছে। দেখো কী করতে পারি। আমার বিরুদ্ধে বললেই ইউএপিএ দিয়ে লাইফ হেল করে দেব। জেলে পচতে হবে। অর্থাৎ সারা দেশে এমন একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করো যাতে যে কেউ সরকারের সমালোচনা করতে ভয় পায়। এটা অবশ্য কোনও নতুন বৈশিষ্ট্য নয়, যে কোনও স্বৈরশাসকেরই রূপ এটি।

 সে জন্য বিজেপি শাসনে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা তলানিতে পৌঁছেছে। ২০২৩-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারত নামতে নামতে ১৬১তম স্থানে এসেছে। ২০২২-এও ভারত ১৫০তম স্থানে ছিল। গত তিন দশকে ভারত এত নিচে কখনও নামেনি। এর একমাত্র কারণ, গোটা সংবাদমাধ্যমকে বিজেপির দলীয় মুখপত্রে পরিণত করার অপচেষ্টা।

বিরোধিতা দমন করতে বিজেপি সরকার যে ‘ডাইনি খোঁজা’ চালাচ্ছে তার আর একটি হাতিয়ার হল যে কোনও বিরোধীকে ‘আরবান নকশাল’ বলে দেগে দেওয়া। নকশালরা তাদের কাজের জন্য দাগী হয়ে গিয়েছে বলে, (নকশাল রাজনীতিকে সমথর্ন না করেও বলা যায়) কাউকে দমন করতে তার গায়ে নকশাল, উগ্রপন্থী বা দেশবিরোধী ছাপ লাগিয়ে দিলেই তার বিরুদ্ধে যে কোনও ধারা দেওয়া যায়, যে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ঠিক যেমন সংখ্যালঘুদের ভয় দেখাতে গোমাংস রাখার অভিযোগ তুলে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কিংবা হাথরসের মতো ঘটনায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে লেখা সমাজে বিভেদের প্ররোচনা তৈরি করতে পারে এমন উদ্ভট অভিযোগ তুলেই কোনও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ইউএপিএ দিয়ে তাঁকে বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখা যায়। স্বাভাবিক ভাবেই শাসক শিবিরের এই সব কার্যকলাপ নিয়ে যত দিন যাবে ততই আরও কথা উঠবে। আর সেই কথা যাতে না ছড়ায় তাই মিডিয়াকে দুর্বল করার, মানুষের কথা বলার, মত প্রকাশের অধিকারকে কেড়ে নেওয়ার লক্ষ্য থেকেই সংবাদমাধ্যমের উপর এমন হামলা।

আজ যে কোনও বিরোধিতাকে দমন করতে প্রধানমন্ত্রী যে ইউএপিএ-কে ব্যবহার করছেন সেই দানবীয় আইনটি– প্রধানমন্ত্রী থেকে অন্য বিজেপি নেতারা হয় কথায় নয় কথায় যে কংগ্রেসের বিরোধিতা করেন, সেই কংগ্রেসেরই তৈরি করা। আজ নিজেদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে দমন করতে যে অঘোষিত জরুরি অবস্থা প্রধানমন্ত্রী দেশজুড়ে জারি করেছেন তা-ও তো তাঁর এক পূর্বসূরি কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঠিক একই রকম ভাবে তাঁর সম্পর্কে বিরোধিতাকে দমন করতেই দেশে জারি করেছিলেন। পেরেছিলেন নাকি বিরোধী স্বরকে দমন করতে? হ্যাঁ, সাময়িক কিছু মানুষকে তিনি জেলে ভরে হেনস্থা করতে পেরেছিলেন, কিন্তু মানুষ সুযোগ পেয়েই তাঁকে ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। এই দেওয়াল লিখনটি মোদি-অমিত শাহদের জানা উচিত।

পুঁজিবাদ যত সংহত হয়, একচেটিয়া রূপ নেয় তত সে স্বৈরতন্ত্রী, আগ্রাসী ফ্যাসিস্ট রূপ নেয়। ততই সে গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরে। বিজেপি ঠিক সেই কাজই আজ করছে। এই অবস্থায় দেশে আজ যদি গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করতে হয়, মানুষের মত প্রকাশের অধিকারকে রক্ষা করতে হয় তবে বিজেপি সরকারের এমন একের পর এক আক্রমণের বিরুদ্ধে এখনই সরাসরি প্রতিবাদ করে রাস্তায় নামতে হবে। নির্বাচনে সিটের হিসেব কষে, কিংবা ঘরে বসে ফেসবুকে, টুইটারে মন্তব্য করে তা হবে না।

সমাজমাধ্যমে প্রতিবাদের প্রয়োজন আছে। কিন্তু ওতেই সীমাবদ্ধ থাকলে আজ আর হবে না। প্রতিবাদকে সংগঠিত রূপ দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আক্রমণটা বিজেপির হাত দিয়ে এলেও আক্রমণটা আসলে মুমূর্ষু, প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদের। এই পুঁজিবাদ যতদিন টিকে থাকবে, তার সেবক দলগুলি কঠোর ভাবে গণতন্তে্রর কণ্ঠরোধ করবেই। সরকার আজ এমনই স্বৈরতন্ত্রী হয়ে উঠেছে যে, যে কোনও সময় যে কারও দরজায় হানা দিতে পারে। তাই আজ ঘরে বসে প্রতিবাদের দিন শেষ। এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে। নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে হামলার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ সংগঠিত করেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশপুতুল পুড়িয়েছে। একজন গণতন্ত্রপ্রিয়, সচেতন মানুষ হিসাবে আপনিও প্রতিবাদে সামিল হোন।