আর্থিক বৃদ্ধির হিসাবও ভুয়ো

কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের আরও একটি ঠগবাজির পর্দা ফাঁস হয়ে গেল৷ দেশের যে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অর্থাৎ জিডিপি বৃদ্ধির হার নিয়ে অবিরাম লম্ফঝম্প করতে দেখা যায় বিজেপি নেতা–মন্ত্রীদের, তার হিসাবে রয়েছে অসংখ্য মিথ্যা৷ এই ঠগবাজি এবার ফাঁস করে দিয়েছে খোদ সরকারি সংস্থা ‘ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন’ বা এনএসএসও৷

অনেকেরই হয়ত মনে আছে, সরকারে বসেই কেন্দ্রের মোদি সরকার দেশের জিডিপি মাপার পদ্ধতিটাই এমন ভাবে বদলে দিয়েছিল যে আর্থিক বৃদ্ধির হারে ভারত প্রায় বিশ্বসেরার পর্যায়ে পৌঁছেছিল৷ পরে সেই ফাঁকি ধরা পড়ে৷ সম্প্রতি এনএসএসও–র সমীক্ষা দেখাল শুধু পদ্ধতির বদলই নয়, জিডিপির হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে রীতিমতো ভুয়ো  সব তথ্য এবং সেই ভুয়ো তথ্যের ভিত্তিতেই ভারতকে বিশ্বের দ্রুততম গতিতে বাড়তে থাকা অর্থনীতিগুলির অন্যতম বলে ঘোষণা করে প্রচারের ঢাক পেটাচ্ছে বিজেপি৷

কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের তালিকায় রয়েছে যে সব কর্পোরেট সংস্থা, জিডিপি হিসাব করা হয় তাদের তথ্য নিয়ে৷ এনএসএসও–র সমীক্ষা বলছে, এই সংস্থাগুলির ৩৬ শতাংশেরই কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না৷ অর্থাৎ হয় এইসব কর্পোরেট সংস্থাগুলি ভুয়ো, অথবা এদের কোনও অস্তিত্বই নেই৷ জিডিপি মাপতে ব্যবহার হওয়া এই ধরনের সংস্থার সংখ্যা প্রায় ৪ হাজারের মতো৷ ফলে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, জিডিপি–র মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যা দিয়ে একটি দেশ অর্থনৈতিক ভাবে এগোচ্ছে না পিছোচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করেন অর্থনীতিবিদরা, তার হিসাবে রীতিমতো জল মেশানো হয়েছে৷ কে জোগায় জিডিপি পরিমাপের জন্য প্রয়োজনীয় এইসব পরিসংখ্যান? এই দায়িত্ব রয়েছে সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিকস অফিস বা সিএসও–র উপর৷ বোঝাই যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের নেতা–মন্ত্রীদের নির্দেশেই এই কারচুপি করেছে সিএসও, যাতে জিডিপি বৃদ্ধির হার বড় করে দেখানো যায়৷

কেন এমন করতে হল নরেন্দ্র মোদিদের? বাস্তবে এদেশে অর্থনৈতিক অবস্থার হাল কেমন, তার জন্য জিডিপির হিসাব কষার দরকার পড়ে না, মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা দিয়েই হাড়ে হাড়ে সে কথা বোঝে৷ নেতা–মন্ত্রীদের ভাষণেই শুধু অর্থনীতির উজ্জ্বল ছবির ঢাক পেটানো হয়, বাকি সর্বত্রই সে ছবিতে গাঢ় কালি মাখানো৷ দেশ জুড়ে বেকারির হাহাকার৷ ঋণের ফাঁদে পড়ে ছটফট করতে থাকা চাষির সংখ্যা, আত্মঘাতী চাষির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে৷ নতুন কারখানা তৈরি হওয়া দূরে থাক, ছোট ও মাঝারি শিল্প কল–কারখানা একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ মূল্যবৃদ্ধির আঁচে ঝলসে যাচ্ছে দরিদ্র মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন৷ বাজারে জিনিসের অভাব না থাকলেও ব্যাপক অভাব রয়েছে মানুষের কেনার সামর্থ্যের৷ অতি সাম্প্রতিক এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এমনকী অতি সাধারণ ভোগ্যপণ্যগুলির বিক্রিও অনেকটা কমে গেছে৷ এদেশের এই চেনা অন্ধকারের ছবির মুখে নরেন্দ্র মোদির পাঁচ বছরের শাসন আরও গাঢ় কালির ছোপ লাগিয়েছে৷ ফলে ভোটের মরশুমে মুখরক্ষা করতে হিসেবে কারচুপি করার সহজ পথটাই বেছে নিয়েছে বিজেপি সরকারের কর্তারা৷ কয়েক মাস আগে এই এনএসএসও–রই তৈরি করা বেকারি সংক্রান্ত সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করতে দেয়নি নরেন্দ্র মোদির সরকার৷ প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন পরিসংখ্যান কমিশনের সদস্যরা৷ পরে জানা যায়, গত ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি হয়েছে মোদির আমলে এবং সেই কারণেই রিপোর্ট চেপে দেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছিল সরকার৷ দেশ জুড়ে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল৷ এবারে ফাঁস হয়ে গেল মোদি সরকারের ঠগবাজির আরও বড় কীর্তি৷

ভোটের এই মরশুমে রেডিও–টিভিতে রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি৷ বিজেপির এমনই একটি বিজ্ঞাপনে ‘ইমানদার নরেন্দ্র মোদি’র প্রচারে সোচ্চার অভিনেতারা৷ ‘ইমানদার’ শব্দের অর্থ বিশ্বাসযোগ্য তথা সৎ মানুষ৷ কর্মহীনের সংখ্যা লুকোতে কিংবা জিডিপির মান বাড়িয়ে তুলতে নরেন্দ্র মোদির সরকার বারবার যেভাবে মিথ্যাচার আর ধোঁকাবাজির আশ্রয় নিচ্ছে, তাতে এর পরে শব্দটির মানেই না পাল্টে যায়!

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪০ সংখ্যা)