সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ কৃষকদের দাবির ন্যায্যতারই প্রমাণ

আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে, ঘোষণা কৃষকদের

সংগ্রামী কৃষকদের দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন এবং ইস্পাত-কঠিন মনোভাবের সামনে পিছু হঠার রাস্তা খুঁজতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সুপ্রিম কোর্ট তিনটি কৃষি আইনে আপাতত স্থগিতাদেশ দিয়ে আইনগুলির বৈধতা খোঁজার জন্য কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে। রায় শুনে কৃষক আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের এই স্থগিতাদেশ কৃষকদের দাবির ন্যায্যতাই প্রমাণ করল। একই সাথে তাঁরা জানিয়েছেন, কোনও কমিটির কাছে কৃষকরা যাবেন না। আইনে কোনও স্থগিতাদেশ কৃষকদের দাবি পূরণ করবে না। আইন সম্পূর্ণ বাতিলই কৃষকদের একমাত্র দাবি। সুপ্রিম কোর্ট যে চারজনকে নিয়ে কমিটি গঠন করেছে তাঁরা সকলেই বিজেপি সরকারের কালা কৃষি আইনের সমর্থক। এতে সুপ্রিম কোর্ট এবং সরকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। আন্দোলনের অন্যতম নেতা, এআইকেকেএমএস-এর সভাপতি ও সম্পাদক যথাক্রমে কমরেড সত্যবান ও কমরেড শঙ্কর ঘোষ ১২ জানুয়ারি এক প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। কৃষক নেতৃত্ব আন্দোলনকে আরও তীব্র করতে লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। চূড়ান্ত কর্মসূচি হিসাবে আগামী ২৬ জানুয়ারি লক্ষ লক্ষ ট্রাক্টর নিয়ে দিল্লির রাস্তায় মার্চ করে কৃষক প্রজাতন্ত্র উদাযাপনই তাঁদের লক্ষ্য। এই কর্মসূচিকে সফল করতে দেশজুড়ে কৃষকরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি চালাচ্ছেন।

যে অসীম বীরত্বে দিল্লিতে কৃষকরা সংগ্রাম করছেন, ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসে বোধ করি তার তুলনা নেই। শৌর্যে, বীর্যে, মহত্ত্বে, আত্মবলিদানের ক্ষমতায় এই সংগ্রাম অনন্য, অসাধারণ। বিজেপি সরকার ভেবেছিল, বশংবদ মিডিয়ার প্রচারের জোরে তারা মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করতে পারবে, করোনার এই দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে তারা এই কথা কৃষকদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারবে যে, যা করা হচ্ছে তা কৃষকদের স্বার্থেই করা হচ্ছে। ওদের এই পরিকল্পনা সফল হয়নি। কৃষকরা ওদের চালাকি ধরে ফেলেছেন। তাঁরা বিজেপি সরকারের সমস্ত দমনপীড়ন অগ্রাহ্য করে, প্রবল শীত উপেক্ষা করে দিল্লির রাজপথে বসে আছেন এবং ঘোষণা করেছেন যত দিন তিনটি কালা কানুন ও বিদ্যুৎ বিল-২০২০ প্রত্যাহার না করা হবে ততদিন তাঁরা রাজপথে বসে থাকবেন। এ জন্য যত মূল্য দিতে হোক– তাঁরা প্রস্তুত।

বিজেপি সরকার ভেবেছিল, কৃষকরা খুব বেশি দিন বসে থাকতে পারবে না। বসে থেকে থেকে হতাশ হয়ে ওরা ঘরে ফিরে যাবে। এই জন্য ওরা কালহরণের কৌশল নিয়েছিল। ওরা কৃষকদের আলোচনায় ডেকেছে, আইনের নানা সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছে। কৃষকরা বরাবরই একটা কথা বলেছেন। কোনও সংশোধনীতে কাজ হবে না। আইনের উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁদের আপত্তি। এই আইন আম্বানি, আদানি প্রমুখ কর্পোরেটদের স্বার্থে রচিত হয়েছে। এই আইনে কৃষকদের সর্বনাশ হবে। তাই এই আইনকে সংশোধন করে কোনও মতেই কৃষকদের স্বার্থবাহী করা যাবে না। একে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কিছুই কৃষকরা মানবেন না। আইন সম্পূর্ণ প্রত্যাহৃত হলেই কৃষকরা ঘরে ফিরে যাবেন, না হলে নয়। তার জন্য যতদিন পথে বসে থাকতে হয়, তাঁরা থাকবেন।

বিজেপি সরকারের এই কাল হরণের কৌশল সফল হল না। অষ্টম রাউন্ডের বৈঠকে তারা তাই তূণীর থেকে বের করে অন্য তীর প্রয়োগ করলেন। কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর বললেন, আসুন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আমরা মেনে নেব– এই প্রশ্নে দু‍’পক্ষই একমত হই। সরকার সরাসরি ‘সুপ্রিম কোর্ট’ কার্ড খেলে আন্দোলনকারী কৃষকদের হতোদ্যম করতে চাইল। কৃষকদের জবাব– কোনও কানুনি প্রশ্ন নিয়ে তাঁরা এতদিন ধরে সংগ্রাম করছেন না। তাঁরা সংগ্রাম করছেন রুটি-রুজি জীবন-জীবিকার জন্য, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং এই কারণেই তাঁরা এই সব আইনের প্রত্যাহার চাইছেন। তাঁরা কোনও কোর্টে যাননি এবং যাওয়ার সামান্য ইচ্ছাও তাঁদের নেই। মধ্যস্থতাকারী হিসাবে সুপ্রিম কোর্টকে গ্রহণ করার কোনও পরিকল্পনাও তাঁদের নেই। তাঁরা সরকারের কাছে এসেছেন এবং আশা করেন, জনমতের প্রতি উপযুক্ত সম্মান দেখিয়ে সরকার এই আইন প্রত্যাহার করে নেবে।

এটাই ঘটনা– সাম্প্রতিক অতীতে জনমনে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। জনমনে এই বিশ্বাস ক্রমাগত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে– দেশের কানুনি ব্যবস্থা শাসক দল ও কর্পোরেটদের মুখপাত্র ছাড়া কিছু নয়। কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করাই তাদের কাজ। আন্দোলনের ময়দানে তাই এই আওয়াজ ক্রমাগত জোরদার হচ্ছে, কোর্ট যে রায়ই দিক, দাবি না মেটা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এর কোনও ব্যত্যয় হবে না।

বহু দিক দিয়েই এই আন্দোলন অনন্য। কৃষকবিরোধী এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য যে কর্পোরেট প্রভুদের স্বার্থ রক্ষা করা, তা এই আন্দোলন যেমন বুঝতে পেরেছে অতীতে এ দেশে তা কখনও দেখা যায়নি। বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের আর একটা স্তম্ভ কানুনি ব্যবস্থাও যে আমজনতার স্বার্থ রক্ষা করে না এই অনুভবও এই আন্দোলনের একটা বড় প্রাপ্তি।

অনেকেই ভাবছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট যদি আন্দোলনের বিপক্ষে রায় দেয় তা হলে কী হবে‍‍‌‌ ? কৃষকরা প্রথম থেকেই ঘোষণা করেছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সুপ্রিম কোর্টকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলন ধ্বংস করার যে পরিকল্পনা বিজেপি সরকার করেছে তা সফল হবে না।

এই জন্য কৃষকরা আন্দোলন আরও শক্তিশালী করার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ২৬ জানুয়ারি লক্ষ লক্ষ ট্রাক্টর নিয়ে কৃষকরা দিল্লির বুকে তাঁদের প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করবেন। পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে চলছে তার জোর প্রস্তুতি। দেশের সমস্ত রাজ্যে সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নামবেন। সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায় সেদিন রচিত হবে।

এই আন্দোলন এখন দাঁড়িয়ে আছে রাষ্টে্রর সশস্ত্র দমন যন্তে্রর মুখোমুখি। যে কোনও মুহূর্তে রাষ্ট্রশক্তি এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সংগ্রামী কৃষকরা তাঁদের ক্ষমতার শেষ বিন্দু দিয়ে লড়ছেন এবং লড়বেন। এই লড়াইয়ে তাঁদের পাশে আছে দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের সমর্থন, আছে ছাত্র-যুব-কন্যা-জায়া-জননীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। সমস্ত আক্রমণ অগ্রাহ্য করে এই আন্দোলন জয়যুক্ত হবেই। একে পরাজিত করবে সাধ্য কার!

(গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১৭ সংখ্যা_১৫ জানুয়ারি, ২০২১)