দেশের সম্পদ বেচে দিচ্ছে সরকার, ধর্মঘটে জবাব দিতে তৈরি মানুষ

দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের টাকা, প্রচার এবং সমর্থনে ক্ষমতায় বসেই তাদের ঋণ শোধ করতে বিজেপি সরকার ব্যাঙ্ক, বিমা, খনি, প্রতিরক্ষা শিল্প প্রভৃতি একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি তাদের হাতে তুলে দিতে শুরু করে।

দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় বসে বিজেপি সরকার ‘ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন’ প্রকল্প ঘোষণা করে জানিয়েছে, রেল, জাতীয় সড়ক, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পরিবহণ, তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন, ২৫টি বিমানবন্দর, জাহাজবন্দর, স্টেডিয়ামের মতো এমন অজস্র সম্পদ তুলে দেবে পুঁজিপতিদের হাতে। বিনিময়ে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে। পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যের জাতীয় সড়কের বিভিন্ন অংশে টোল আদায় ও দেখাশোনার দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। রেলের ৪০০টি স্টেশন, ৯০টি দূরপাল্লার ট্রেন, দার্জিলিং সহ পাঁচটি টয় ট্রেন, ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর, কোঙ্কণ রেলওয়ে কলোনি ও রেলের স্টেডিয়াম বেসরকারি সংস্থা ব্যবহার করে মুনাফা তুলবে। হাওড়া সহ ১২টি ক্লাস্টারের ১০৯ জোড়া ট্রেন চালাবে বেসরকারি সংস্থা।

যদি রাজস্ব বাড়ানোই সত্যি বিজেপি সরকারের লক্ষ্য হত, তবে ঋণের নামে ব্যাঙ্কগুলির যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পুঁজিপতিরা গায়েব করে দিয়েছে সেগুলি উদ্ধারে তারা উদ্যোগী হত। যে বিপুল পরিমাণ কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতি দেশে চলছে, সেই টাকা উদ্ধারে নামত। বড় বড় শিল্পপতি-পুঁজিপতিরা যে হাজার হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়ে চলেছে, হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাচ্ছে, সে-সব আটকানোর চেষ্টা করত। দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দিত। কয়লা, টু-জি স্পেকট্রাম, কমনওয়েলথ গেমস, রাফাল প্রভৃতি অজস্র বড় বড় দুর্নীতিতে জনগণের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে রাঘব বোয়ালেরা। এদের কাউকেই ধরার এবং শাস্তি দেওয়ার ধারকাছ দিয়েও যাচ্ছে না সরকার। বরং এমন সব দুর্নীতি এবং লুঠতরাজ অবাধে চলতে দিচ্ছে।

ফলে, রাজস্ব বাড়ানোর কথাটা এখানে অজুহাত মাত্র। আসল উদ্দেশ্য, দেশের মানুষের এই সব সম্পদ পুঁজিপতিদের হাতে মুনাফা লুঠের উদ্দেশ্যে তুলে দেওয়া।

নয়ের দশকের গোড়ায় বিশ্বায়ন-উদারিকরণের নামে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ঢালাও বেসরকারিকরণ শুরু হয়। ফল হিসাবে আম্বানি-আদানিদের মতো শিল্পপতিদের রকেট গতিতে উত্থান ঘটে। দেশের বিপুল পরিমাণ সম্পদ এবং সম্পত্তির দখল নিয়ে নেয় তারা। উৎপাদনের বিরাট অংশে এই সব শিল্পপতিদের একচেটিয়া দখলদারি কায়েম হওয়ায় তাদের বিপুল মুনাফার খেসারত হিসাবে সাধারণ মানুষের উপর চাপতে থাকে বিপুল মূল্যবৃদ্ধির বোঝা।

মনিটারি পাইপলাইনের মধ্যে দিয়ে নতুন করে যে সব রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ এই সব মালিকদের হাতে যাচ্ছে সেগুলিতে অতি দ্রুত ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি এবং পরিষেবা ব্যয় বাড়বে। ট্রেন, মেট্রোর ভাড়া বাড়বে, সড়ক পরিবহণের ব্যয় বাড়বে, তেল-বিদ্যুতের দাম বাড়বে, ফোনের খরচ সহ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে ব্যয় করতে হবে আগের থেকে অনেক বেশি। মূল্যবৃদ্ধি আরও ব্যাপক আকার নেবে। চাকরির ক্ষেত্রে ছাঁটাই আরও তীব্র হবে। বিজেপি নেতাদের এই প্রকল্প পুঁজিপতি-কর্পোরেটদের বিপুল মুনাফা দেবে, তার বিনিময়ে সাধারণ মানুষের জীবনে চরম সর্বনাশ নামিয়ে আনবে। সমাজের একটা বড় অংশ এই সব পরিষেবাগুলি থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে। দেশে সম্পদের কোনও অভাব না থাকলেও তার কোনও কিছুতেই সাধারণ মানুষের কোনও অধিকার থাকবে না।

এস ইউ সি আই (সি) একক প্রচেষ্টায় সর্বশক্তি দিয়ে প্রথম থেকে এই সর্বনাশা নীতির বিরোধিতা করে এসেছে। বামপন্থী হিসাবে পরিচিত অন্য দলগুলি যদি বিশ্বায়ন-উদারিকরণে সামিল না হয়ে যেত, যদি ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের কোটি কোটি শোষিত-বঞ্চিত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলত তবে আজ এত সহজে পুঁজিপতিরা এই নীতিকে কার্যকর করতে পারত না। আজও যদি এই সর্বনাশা বেসরকারিকরণের নীতিকে প্রতিহত করতে হয় তবে শোষিত-বঞ্চিত জনসাধারণকে সংগঠিত করে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বনধ। যারাই বিজেপি সরকারের এই সর্বনাশা পদক্ষেপে উদ্বিগ্ন তাদের সকলকেই এই বনধে সামিল হতে হবে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৮ সংখ্যা