কর্পোরেটী মুনাফার ব্যবস্থা কৃষক জীবনকে জেরবার করে দেবে (পাঠকের মতামত)

দেশের কৃষককে ‘সুসংবাদ’ শুনিয়েছেন মাননীয়া অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। কৃষকের কল্যাণে তিনটি সংস্কারের কথা বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে। তাতে (১) নিয়ন্ত্রণমুক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য আইনের সংশোধন, (২) কৃষিপণ্যের আন্তঃরাজ্য অবাধ বাণিজ্য এবং (৩) চুক্তিভিত্তিক চাষের ব্যবস্থার উল্লেখ করে মাননীয়া অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চাষিরা চাষের আগেই পণ্যের দাম নিশ্চিত করে নিতে পারবেন এখন থেকে। অর্থাৎ চুক্তিভিত্তিক চাষ। তাঁর বক্তব্য, এটি কার্যকরী হলে চাষি সবচেয়ে বেশি মুনাফা পেতে পারেন। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ খুব খুশি হয়েছেন। বলেছেন চাষিদের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেওয়া হল দেশে ইত্যাদি। এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। কিছু অধ্যাপক রাজনৈতিক দলের কর্মী দূরদর্শনের ক্যামেরার সামনে, দিল্লিকেন্দ্রিক প্রচারমাধ্যমগুলো এমন একটি সাংঘাতিক (?) উদ্যোগের সফলতা নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বিতর্কে নেমে পড়েছেন।

ইতিহাসে নীল চাষিদের দাদন দেওয়ার কথা বাঙালিদের নিশ্চয়ই মনে আছে। অমিত শাহ, নির্মলা সীতারামনদের সেই ভাবে মনে থাকার কথা নয় যেমন দেখেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। নীল বিদ্রোহে বাঙালিরাই রক্ত ঝরিয়েছিল বেশি। দাদন দেওয়া চুক্তি অনুযায়ী চাষ করতে বাধ্য হত চাষিরা। এটা ঠিক, তখন ব্রিটিশরা দাদন দিয়েছিল, আর এখন দেবে কর্পোরেটরা। কিন্তু মুনাফার প্রশ্নে উভয়েই তো এক। সেদিন নীলের দাদনের ধাক্কায় শয়ে শয়ে সুখী বাঙালি পরিবার শ্মশানে পরিণত হয়েছিল, ভিটেমাটি হারিয়েছিল অগুনতি। আজকের করর্পোরেটদের ভূমিকা সেই দাদনদারদের মতোই। গোটা বিশ্ব আজ দেখছে এই ভুবনমনোমোহিনী দেশে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকপ্রাণরক্ষার তাগিদে নিরন্ন বুভুক্ষু অবস্থায় দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হাজার হাজার হাজার মাইল পদব্রজে প্রাণ রক্ষায় কর্পোরেটের রক্ষক পুলিশের তাড়া খেয়ে ছুটছে। এক ধরনের দাসত্বের পরিচিতি কারা তাদের ওপর চাপিয়ে দিল? জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য করেছে কে? এরাই তো অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গে সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে, পঞ্জাব-বোম্বাই-গুজরাটে কর্পোরেটদের কাছে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। এ দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে শ্রমের রসে বেঁধে রেখেছে তো তারাই। কর্পোরেটদের হাতে এই ক্ষমতা অর্পণ চাষের চুক্তিতে বেঁধে কৃষককে সেই দিকেই নিয়ে যাচ্ছে না তো?

এ ছাড়াও আরও দুটি বিষয় ভাবাচ্ছে। এক, জমিতে কর্পোরেটের ইচ্ছে অনুযায়ী বিশেষ দ্রব্য উৎপন্ন হবে, না রাজ্যের অর্থাৎ স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন হবে? দুই, চাষির নিষ্ঠা ও উপযুক্ত শ্রম থাকা সত্ত্বেও বিফলতা এলে চাষির সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচিত হবে কি না? এই প্রশ্নোত্তর পর্ব চাষির হাতে দাম নির্ধারণের ক্ষমতা যাওয়ার বিরোধিতা করে না। চাষি যথার্থ দাম পাক। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তাকে যেন আত্মহত্যা করতে না হয়– এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করা দরকার।

সংশয়ের কারণ মাননীয় অর্থমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অধিকর্তা শাহজি বোধহয় একটা বিশেষ সত্যকে হয় গোপন করতে চাইছেন নতুবা চাষির বিপর্যয়গুলো অনুভব করে দেখেননি। এই পোড়া দেশে কৃষিতে চাষির সফলতা দেশের আইন পরিবর্তনের ওপর যত না নির্ভর করে তার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভর করে এখনও প্রকৃতির উপর। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর, বন্যা-খরার ওপর, জলসেচ ব্যবস্থা, বিদ্যুতের সহজলভ্যতা, চাষের উচ্চমান সম্পন্ন বীজের এবং সার ও কীটনাশকের সহজলভ্যতার উপর। এই শেষোক্ত ক্ষেত্রে চলে আরেক দল কর্পোরেটের মুনাফার পারদের ওঠানামার আধিপত্য। এর সঙ্গে তো রয়েছেই গোটা দেশের মূল অর্থব্যবস্থায় যে চূড়ান্ত সংকট তার প্রভাব। কৃষিতে এগুলো যদি চাষের বিফলতার কারণ হয়ে যায়, নিষ্ঠা ও শ্রম থাকা সত্ত্বেও চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করতে না পারে তখন তাকে আদালতের সামনে অপরাধী হতে হবে না তো! যে আদালত অদূরদর্শী সরকারি সিদ্ধান্তের পরিণতিতে নিহত অসহায় শ্রমিকের পথক্লান্তিকেই খানিকটা দুষছেন। একবারও জানতে চাননি কেন রেলপথ ধরে পা ফেলতে বাধ্য হয়েছিল ওরা? এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে বিফল চাষির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করবে কে? চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনে বিফলতার বিষয়টি কি কৃষি-আইনের মধ্যে যুক্ত হচ্ছে? সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা থাকছে কি? মাননীয় অর্থমন্ত্রী কি সেটি বিচার করে দেখেছেন? এমনটা ঘটলে চাষির দুরবস্থার দায় কে নেবে? সেখানে কি আইনি সুরক্ষা থাকবে? দেখুন শ্রমিকের অধিকার খর্ব করে দেওয়া হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। কেন্দ্রও কি নতুন শ্রমআইন আনবে?

বাংলার চাষিদের মনে থাকবে আশির দশকের টুংরো ভাইরাসের সংকট। মাঠের চাষ মাঠেই শুকিয়ে গিয়েছিল। আয়লার পরিণতিতে কী দুর্দশা হয়েছিল সাধারণ মানুষের? আটাত্তরের বন্যা? মাননীয় অমিত শাহ বলেছেন এটা নাকি একটা অভূতপূর্ব ঘটনা। শব্দের উৎপত্তির বিচারে এটি সত্যিই অ-ভূতপূর্ব। এই অ-ভূতপূর্ব ব্যবস্থাটি কর্পোরেটের না কৃষকের কল্যাণে? দেশের মানুষ লক্ষ্য করেছেন গত প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা, শিক্ষা অর্থাৎ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্পোরেটের মুনাফার দাপট কেমন জাঁকিয়ে বসেছে। শুধু কি তাই? কর্পোরেট এখন তো মন্দির ব্যবস্থাতে ইনভেস্ট করতে চাইছে। চুক্তিভিত্তিক চাষ কি তারই এক্সটেনশন? হাসপাতালে গিয়ে যেমন রোগী ও রোগীর পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, স্কুল-কলেজের ছায়ায় যেমন যেতে ভয় পাচ্ছে সাধারণ, শ্রমিককে হাজার দেড়হাজার মাইল হেঁটে পাড়ি দিতে বাধ্য করছে, চাষে এই নতুন কর্পোরেটী মুনাফার ব্যবস্থার দ্বারোদঘাটন নীল চাষিদের মতো গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারের জীবনকে জেরবার যে করে দেবে না, এর কোন গ্যারান্টি দিতে পারবেন কি সরকার?

বলেছেন নিয়ন্ত্রণমুক্ত কৃষিপণ্য সঞ্চয়ের আইন আর অবাধ আন্তঃরাজ্য কৃষিপণ্য সরবরাহ নাকি আরেক দিগন্ত উন্মোচন করবে। এ দুটোকে যুক্ত করে বিচার করা দরকার। প্রথমত পণ্যটি যদি রাজ্যের মানুষের প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে উৎপাদন করা হয় আর কর্পোরেটের হাতে যদি থাকে যোগানের ব্যবস্থা এবং তারই হাতে থাকে সঞ্চয়ের চাবিকাঠি তাহলে সাধারণের সমূহ বিপদ। কোল্ড স্টোরেজে আলু-পেঁয়াজের ওপর কর্পোরেটের আধিপত্যে ভুক্তভোগী এদেশের মানুষ। কর্পোরেট তার অধিক মুনাফা লাভের জন্য আইনসম্মতভাবেই নানা পথ নেবে। এক রাজ্যের প্রয়োজন উপেক্ষা করে অধিক মুনাফার লোভে বাধাহীনভাবে পণ্য অন্য রাজ্যে সরবরাহ করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এটি নাকি উদারতা! রাজ্যের প্রয়োজনীয় আলু পেঁয়াজ সবজি ধান-চাল কর্পোরেট তার নিজের স্টোরেজে জমিয়ে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করবে। সরকার কিছু করবে না এটা কতখানি কাম্য? এছাড়াও স্টোরেজ ব্যবস্থাটি সংশ্লিষ্ট রাজ্যে হবে এমনটা নাও হতে পারে। এগুলি বিচার করার দায় থাকবে কার হাতে? কর্পোরেট দাম বাড়িয়ে এই রাজ্যের কৃষকের পণ্যই রাজ্যের কৃষককেই তো চড়া দামে বিক্রি করবে। একইসঙ্গে অন্য রাজ্যে গিয়েও একই উদ্যোগে অধিক মুনাফা করতে থাকবে। এই ব্যাপারটাকে কি আটকাতে পারবেন কেউ? এখনই কর্পোরেটের হয়ে শ্রমিককে দিনরাত খাটিয়ে নেওয়ার আইন তৈরি করছে সরকার। সেই ভাবেই কি কর্পোরেটের হয়ে কৃষককে মুনাফার যাঁতাকলে ফেলে দিতে চাইছে এই উদ্যোগ ঘুরপথে? ঘুরপথে এরপর এতো গ্যাট চুক্তির নতুন এক রূপ।

সাধারণ চাষি হিসেবে দেশের মানুষ মনে করেন আমরা আর কী করব? কোনও রকম হাতের কাছে যা পাই তাই নিয়ে বেঁচে থাকি। এটিও যেমন সত্য তেমনি তাঁদের ভেবে দেখতে বলব এই যুক্তিতে ঘনায়মান অন্ধকারের যে দিনগুলো সামনের দিক থেকে এগিয়ে আসছে তা নিয়ে ভাবতে হবে আমাকে-আপনাকেই। দেখছেন না পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের একদল চিঠি-চাপাটির লড়াই করছে সরকারে বসে, আর শ্রমিকার মরছে না খেতে পেয়ে রাস্তায় পডে, বাসের চাকার নিচে, ট্রেনের চাকার তলায়! গোরুর গাড়ির জোয়াল কাঁধে নিয়ে সপরিবারে গোরুর পায়ের ছন্দে মিলিয়েছে পা।

মহীদাস ভট্টাচার্য, কলকাতা-৮৪