২২ মার্চ মানুষের ঢল শিলিগুড়িতেও

২২ মার্চ। এস ইউ সি আই (সি)-র আহ্বানে বিক্ষোভ মিছিলের ডাকে সাড়া দিয়ে দুপুর ১২টার আগে থেকেই দেখা গেল শিলিগুড়ির বাঘাযতীন পার্কে ঢল নেমেছে প্রতিবাদী মানুষের। প্রখর রোদের মধ্যেই সমবেত হয়েছেন তাঁরা। সাড়ে বারোটা নাগাদ শুরু হল সভা। সভাপতির দায়িত্ব তুলে নিলেন দলের রাজ্য কমিটির সদস্য ও দার্জিলিং জেলা সম্পাদক কমরেড গৌতম ভট্টাচার্য। শ্রমিক, মহিলা, ছাত্র, যুব গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ একে একে তাঁদের বক্তব্য রাখলেন।

উত্তরবঙ্গের আটটি জেলা থেকে পাঁচ হাজারেরও বেশি পুরুষ-নারী, ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক-কর্মচারী-মেহনতি মানুষ ক্রমাগত আসছেন। কেউ এসেছেন নিজের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে। মা এসেছেন সন্তানকে কোলে আঁকড়ে। খেতমজুর তাঁর দৈনিক হাজিরা কাজ বন্ধরেখে এসেছেন। আছেন চা বাগানের শ্রমিকেরা। চোখে তাঁদের দিনবদলের স্বপ্ন। মঞ্চের সামনে বসে মন দিয়ে বক্তব্য শুনছেন এক বৃদ্ধ। কলেজ ছাত্রী নাতনিকে হাত ধরে শেখাচ্ছেন প্রতিবাদের ভাষা। বহু দূরের পথ পাড়ি দিয়ে আসার সময় অনেকে বেঁধে এনেছেন সামান্য কটা রুটি কিংবা খানিকটা মুড়ি। উত্তরবঙ্গে লোকালট্রেন চলাচলের অবস্থা খুবই খারাপ। তাই এলাকা থেকে গাড়ি ভাড়া করে একসঙ্গে আসতে হয়েছে। গাড়ির ভাড়া তাঁরা নিজেরাই তিল তিল করে সংগ্রহ করেছেন।

সভায় প্রস্তাব পেশ হয় অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং নতুন করে পেট্রোপণ্য এবং গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে। তখনও আসছে মানুষের স্রোত। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন দার্জিলিং জেলার সঙ্গীত গোষ্ঠী। বক্তব্য রাখেন এস ইউ সি আই (সি)-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রাক্তন সাংসদ কমরেড তরুণ মন্ডল। প্রথমেই তিনি শিলিগুড়ি শহরবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়েই এই মিছিল। শিক্ষায় পি পি পি মডেলে স্কুল-কলেজ বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, দুয়ারে মদ প্রকল্প বন্ধ করার দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেন তিনি। হাসপাতালে ওষুধ কমানোর প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, রাজ্যের তৃণমূল সরকার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মতোই জনবিরোধী নীতি নিয়ে চলছে। চা বাগানের শ্রমিক-কর্মচারীদের নূ্যনতম বেতন বৃদ্ধি না করা, মানুষের অজ্ঞাতসারে ডানকান-এর মতো বহু কোম্পানির চা বাগান বিক্রি হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গের চা শ্রমিকদের দুর্দশা দিনের পর দিন বেড়েই চলছে।

দুপুর আড়াইটে। শুরু হল বিক্ষোভ মিছিল। সামনের সারিতে কমরেড তরুণ মণ্ডল, কমরেড শিশির সরকার, কমরেড তপন ভৌমিক, কমরেড নভেন্দু পাল, কমরেড অসিত দে, কমরেড সুজিত ঘোষ প্রমুখ রাজ্য নেতৃবৃন্দ। লাল ঝান্ডা, ব্যানারে সুসজ্জিত স্লোগানে মুখরিত মিছিল এগিয়ে চলল শিলিগুড়ি জংশনের দিকে। মিছিলে ছাত্র-যুব এবং মহিলাদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো।

মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে আলিপুরদুয়ারের শালকুমার থেকে আসা যুবক অমিতাভ বললেন, বেকারদের চাকরি নেই, দুয়ারে মদ দিতে চায় সরকার! আমরা বাঁচব কী ভাবে? বাঁচার ঠিকানা পেতেই আজকের মিছিলে এসেছি। মেখলিগঞ্জের ছবিনা বেগম বললেন, গরিব বাড়িতে তো এমনিতেই অশান্তি, তারপরে আবার দুয়ারে মদ! কাজ-কাম নেই। হাসপাতালে গেলে ওষুধ নেই। কী করে বাঁচবো? তাই এসেছি মিছিলে। দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর থেকে আসা সত্তর ছুঁইছুঁই দুলো পাহানও একই কারণে মিছিলে হাঁটছেন।

মালদার বুলবুল চণ্ডীর ছাত্র হেমন্ত মাহাতো হাঁটছেন শিক্ষার বেসরকারিকরণ রুখতে। মুজনাই চা বাগানের মনোজ মুন্ডা মিছিলে স্লোগান তুলে কিছুক্ষণের বিরতিতে বললেন, চা বাগানে মজুরি ঠিকমতো দিচ্ছে না, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাতে পারছি না। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাই। মালবাজারের ছাত্রী সাবেরা উড়াও চাকরির দাবিতে মিছিলে হাঁটলেন।

মিছিলের মাথা যখন মহানন্দা ব্রিজের উপরে, তার শেষ প্রান্ত তখন হাসপাতাল থেকে ভেনাস মোড়ের দিকে এগিয়ে চলছে। শিলিগুড়ি জংশনে মিছিল পৌঁছালে পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে গ্যাস সিলিন্ডারের প্রতিরূপে অগ্নিসংযোগ করেন রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড তপন ভৌমিক। দাবি সনদ নিয়ে কমরেড তরুণ মণ্ডলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল উত্তরকন্যায় গিয়ে স্মারকলিপি দেন।