হোমগুলির কার্যকলাপ খতিয়ে দেখতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তৈরি করুক কেন্দ্রীয় সরকার — প্রধানমন্ত্রীকে সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষের চিঠি

সম্প্রতি বিহার ও উত্তরপ্রদেশের হোমগুলির যে নারকীয় চেহারা সামনে এসেছে, সে বিষয়ে গত ১৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠিপাঠিয়েছেন এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ৷ চিঠিটির বয়ান নিচে দেওয়া হল :

দেশ জুড়ে মহিলাদের উপর বিপুল হারে অপরাধের ঘটনায় আমরা গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন৷ ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণ করে হত্যা, পণের জন্য হত্যা, পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে হত্যার মতো বর্বর আক্রমণ যে ভয়ানক হারে মহিলাদের উপর হয়ে চলেছে, তা থেকেই স্পষ্ট স্বাধীন ভারতে এ দেশের নারীসমাজ কতখানি বিপন্নতা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে৷ সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী,  ভারতে প্রতিদিন গড়ে ১০৬ জন মহিলা ধর্ষিতা হন৷ সরকারি সমীক্ষা দেখাচ্ছে, দেশের ৪২ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার এবং নাবালিকা কন্যা ধর্ষণের ঘটনা ৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ উত্তরপ্রদেশে এক কিশোরীকে টেনে নিয়ে গিয়ে একদল যুবকের যৌন নিপীড়নের ভিডিও কয়েকদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে৷ এই ঘটনার আগে বিহারে ৮টি বালক মিলে এক নাবালিকাকে নিপীড়ন ও তার পোশাক খুলে নেওয়ার চেষ্টার জঘন্য ছবি দেখা গেছে৷ এমনকী শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী নারীরাও অনেক সময় এইসব বর্বর ধর্ষণকারীদের পাশবিক লালসার শিকার হচ্ছে, যা আরও অমানবিক৷

কয়েক মাস আগে দেশের মানুষের সামনে এসেছে ধর্ষণের আরও একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা৷ এক্ষেত্রে অত্যাচারের ঘটনাটির থেকেও জঘন্যতর হল এই পাশবিক কাণ্ডে অভিযুক্তকে আড়াল করতে সরকারি প্রশাসনের ঘৃণ্য ভূমিকা৷ উত্তরপ্রদেশে উন্নাওয়ের মাখি গ্রামের ১৭ বছরের এক কিশোরী অভিযোগ করে, কাজ জুটিয়ে দেওয়ার নাম করে তাকে অপহরণ করা হয় এবং শাসক দলের এক বিধায়ক, তার ভাই ও সাঙ্গোপাঙ্গোরা তাকে আটকে রেখে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ধর্ষণ করে৷ অত্যাচারীর নাম জানিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেনি, উল্টে অভিযুক্তই মেয়েটি ও তার পরিবারকে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে চলে৷ এরপর ন্যায়বিচারের অদ্ভুত প্রহসনে পুলিশ অভিযোগকারীর বাবাকেই বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে৷ কয়েকদিন বাদে পুলিশি হেফাজতে অভিযোগকারীর বাবার মৃত্যু হয়৷ দেখা যায়, মৃতের সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত৷ অথচ পুলিশের বয়ান অনুযায়ী তাঁর মৃত্যুর কারণ নাকি ‘অন্ত্রে ছিদ্রের কারণে রক্তে বিষক্রিয়া’৷ প্রধান অভিযুক্ত শাসক দলের বিধায়কটি এখনও অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷

ব্যাপক হারে নারী নির্যাতনের ঘটনার এখানেই শেষ নয়৷ গত জানুয়ারি মাসে জম্মুর কাঠুয়ায় ৮ বছরের এক বালিকার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা নৃশংস পাশবিকতার আরও একটি উদাহরণ যা লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট করে দেয়৷ এই ঘটনায় সাম্প্রদায়িক রঙ চড়ানোর যে অপচেষ্টা হয়েছে, তা আরও লজ্জাজনক৷ ধর্ষণের এই বর্বর ঘটনাকে কী করে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টিতে এমনভাবে ব্যবহার করা হল, ভেবে হতবাক হতে হয়৷ অভিযোগ উঠছে, বালিকাটির অপহরণ,  তার উপর নৃশংস অত্যাচার,  বারংবার ধর্ষণ এবং শেষপর্যন্ত হত্যার  ঘটনার যারা সাক্ষী,  অভিযুক্তের পরিবারের সদস্য ও সাঙ্গোপাঙ্গোরা তাদের হুমকি দিয়ে চলেছে৷ জম্মুর কাঠুয়া এবং উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ের ঘটনায় গোটা দেশ জুড়ে সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রের মানুষের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনরা ধর্ষণকারী বা ধর্ষণে অভিযুক্তদের আড়াল করছে, তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে– যেন মধ্যযুগের সেইসব অন্ধকার দিন আবার ফিরে এসেছে স্বঘোষিত ধর্মগুরুরা তাদের আশ্রমের ভিতরে নানা অজুহাতে কীভাবে আশ্রিতা নারীদের উপর ধর্ষণ সহ যৌন নির্যাতন চালায়, তা–ও আজ দেশের মানুষের সামনে এসে গেছে৷ দুই নির্যাতিতা ঘটনা প্রকাশ করে দেওয়ার সাহস না দেখালে এই অত্যাচার এভাবেই মানুষের চোখের আড়ালে বিনা বাধায় চলতে থাকত দিনের পর দিন৷ নির্যাতিতারা অত্যাচারের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা শিউরে ওঠার মতো৷ জানা গেছে, স্বঘোষিত এই ধর্মগুরুরা আশ্রমের অসহায় মেয়েদের ওপর দিনের পর দিন শুধু যৌন নির্যাতন চালাত তাই নয়, প্রতিবাদ করলে বা ঘটনা প্রকাশ করে দেওয়ার কথা বললে তাদের তো বটেই, এমনকী তাদের মা–বাবা সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের খুন করে ফেলার হুমকি দিত৷ ২০১২ সালে নির্ভয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল৷ ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে তার জন্য সমস্ত দিক খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি, বরং পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে চলে যেতে দেওয়া হয়েছে৷

রাজধানী শহরের যে নৃশংস ঘটনা দেশবাসীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সম্প্রতি সামনে আসা বিহারের ঘটনা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর৷ সে রাজ্যের মুজফফরপুর জেলায় রাজ্যের সমাজ উন্নয়ন দপ্তরের অধীনে থাকা একটি এনজিও পরিচালিত হোমের ৩৪টি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ আরও ভয়ঙ্কর হল, এই যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিল যে অসমসাহসী মেয়েটি, তাকে খুন করে হোম চত্বরের মধ্যে পুঁতে ফেলা হয়৷ জেলা পুলিশের সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্টও এ ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন৷ পুলিশ জানিয়েছে, ধর্ষণের আগে মেয়েগুলির চেতনা আচ্ছন্ন করার জন্য মৃগী রোগের ওষুধ সহ ৬৭ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হত৷ প্রশ্ন উঠেছে, এই ভয়ঙ্কর অপরাধ আড়াল করে রেখেছিল কারা? সরকারের সমাজ কল্যাণ দপ্তর কি ঘটনার কথা জানত না? সন্দেহ আরও দৃঢ় হয় যখন জানা যায় যে, ওই হোমটির মালিক হলেন স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা যিনি আবার কয়েকটি স্থানীয় সংবাদপত্রেরও মালিক৷ এই মালিক এনজিও–টির জন্য নিজের পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে আর্থিক সাহায্য সংগ্রহ করতেন৷ আশ্চর্যের হলেও সত্য, পাঁচ বছর আগে মুজফফরপুরের সমাজ কল্যাণ দপ্তর এঁর বিরুদ্ধে রিপোর্ট দেওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার তাঁর পাঁচটি হোমের জন্য বারবার নানা প্রকল্প অনুমোদন করে গেছে এবং বছরে ১ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে৷ এবারের অডিট রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব একটি বেসরকারি সংস্থার উপর থাকায় এই ঘটনা সামনে আসে৷ এ কথা স্পষ্ট যে, ওই হোমের মালিক এবং প্রধান অভিযুক্ত এই ধরনের আরও নানা অসাধু কার্যকলাপ ও অকল্পনীয় বর্বরতার সঙ্গে জড়িত৷ পুলিশ তদন্তে ধরা পড়েছে, মুজফফপুরের পতিতাপল্লির যে হোম থেকে ১১জন মহিলা ও ৪টি শিশু নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, সেই হোমটিরও মালিক ওই একই ব্যক্তি৷

বিহারের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরে পরেই জানা যায়, উত্তরপ্রদেশের দেওরিয়া শহরের একটি হোমেও আবাসিক মহিলাদের ওপর একই ধরনের নির্যাতন চলছে৷ এই হোম থেকে পালিয়ে আসা এক নাবালিকা পুলিশের কাছে ফাঁস করে দেয় যে, প্রতি রাতে আবাসিকদের যৌন–ব্যবসায়ে কাজে লাগানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরদিন সকালে আবার তাদের হোমে ফিরিয়ে আনা হয়৷ এ থেকেই হোমের মহিলা আবাসিকদের যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহার করার মর্মান্তিক ঘটনাটি সামনে আসে৷ এই হোমের ৪২ জন মহিলা আবাসিকের মধ্য থেকে মাত্র ২৪ জনকে উদ্ধার করা গেছে, বাকি ১৮ জনের কোনও হদিশ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি৷ ২০০৭ সালে এক সিবিআই তদন্তে এই হোমের কাজকর্মে কিছু গরমিল ধরা পড়ার পর হোমটির লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়৷ কিন্তু তার পরেও হোমটির কাজ চলতে থাকে৷ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, তারা নাকি কোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছে৷ অথচ উত্তরপ্রদেশের মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী স্বয়ং জানিয়েছেন যে, দেওরিয়ার হোমটি বেআইনি ভাবে চলছিল৷ প্রশাসনের পক্ষ থেকে হোমটির আবাসিকদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ আসা সত্ত্বেও তা কার্যকর হয়নি৷ হোমটির লাইসেন্স নেই জেনেও পুলিশ অসহায় মেয়েদের সেখানেই পাঠাত!

এ হল কেবল হিমশৈলের চূড়ামাত্র৷ গোটা দেশে যে প্রায় ৯ হাজার শিশু আশ্রয়কেন্দ্র আছে, মানসিক ভারসাম্যহীনদের জন্য সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত আশ্রয়স্থল আছে, সেগুলিতে কী ঘটে চলেছে, কে তার খবর রাখে!

বিহার ও উত্তরপ্রদেশে সহায়হীন নারীদের আশ্রয়স্থল হোমগুলির ভেতরকার ভয়ঙ্কর চেহারা সামনে চলে আসায় প্রশাসনের অপদার্থতা প্রকট হয়ে পড়েছে৷ এ কথাও প্রমাণিত হয়েছে যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরনের ভয়ঙ্কর ঘটনায় অভিযুক্তরা হয় শাসকদলের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক গুন্ডা, অথবা ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, এমনকী বিধায়ক, যারা সহজেই আইনি শাস্তির খাঁড়া এড়িয়ে যেতে সক্ষম৷ এই অবস্থায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে দ্রুত বিচার শেষ করে অবিলম্বে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন৷ অথচ সে বিষয়ে কোনও উদ্যোগ চোখে না পড়ায় প্রমাণ হচ্ছে, পুলিশ–প্রশাসনের সঙ্গে হয় আঁতাত করে অথবা তাদেরই মদতে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলি ঘটে চলেছে৷

এই পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আইনজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী, মহিলা সমাজকর্মী এবং সম্মাননীয়বুদ্ধিজীবী নিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা প্রয়োজন, যার দায়িত্ব হবে কোনও রকম সরকারি বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই, এই ধরনের আশ্রয়নিবাস, হোম, উন্মাদাগারগুলির কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করে সেগুলির প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে সত্যাশ্রয়ী রিপোর্ট তৈরি করা ও উদ্বিগ্ন দেশবাসীর সামনে তা পেশ করা৷ এই কমিটি পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করবে যেগুলি একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সরকার কার্যকর করবে যাতে এই ধরনের হোমগুলির অসহায় আবাসিকদের ভবিষ্যতে আর কখনও দুর্ব্যবহার কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার না হতে হয়৷ আশা করি, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আপনি আমাদের পরামর্শগুলির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করবেন এবং সেই মতো অগ্রসর হবেন৷

(৭১ বর্ষ ৪ সংখ্যা ২৪ আগস্ট, ২০১৮)