হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কি নেতাজিকে সম্মান জানাতে পারে

 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আপসহীন ধারার শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। এ বছর ২৩ জানুয়ারি থেকে তাঁর ১২৫তম জন্মবর্ষ শুরু হতে চলেছে। এই উপলক্ষে দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষ তাঁদের প্রিয় নেতাকে স্মরণ করবেন গভীর আবেগে। শহরে-গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে এখন থেকেই। সাধারণ মানুষ নিজেরা উদ্যোগী হয়ে গড়ে তুলছেন নেতাজির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন কমিটি। এই রকম পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ঘোষণা করেছে, তারা নেতাজির জন্মজয়ন্তী সাড়ম্বরে পালন করবে। তার জন্য তারা কমিটি গড়বে, মাথায় থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

দেশে আজ রাজনীতির নামে চলছে চুরি, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, জনগণের সম্পত্তি আত্মসাৎ, শিল্পপতি-পুঁজিপতিদের জন্য দেশের সম্পদ অবাধ লুঠতরাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া, বিনিময়ে তাদের অনুগ্রহ লাভ করা, অন্য দিকে মানুষের ঐক্যকে ভেঙে দিতে তাদের জাত-ধর্ম-বর্ণে বিভাজিত করা, সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে মাতিয়ে দেওয়া। বাড়ছে অর্থ, ক্ষমতা প্রভৃতির লোভে দলবদলের হিড়িক। এই রকম একটি সময়ে যখন দেশের মানুষ ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলির এই কুৎসিত রূপ দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে পড়ছেন, যখন তারা একান্ত মনে আজ আবার নেতাজির মতো একজন জননায়ককে নেতা হিসাবে চাইছেন তখন তাঁর জন্মজয়ন্তী শ্রদ্ধার সঙ্গে উদযাপন করাই তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সাড়ম্বর অনুষ্ঠানের সাথে আদৌ নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধজ্ঞাপনের কোনও সম্পর্ক আছে কি? নেতাজির আদর্শ, লক্ষ্য, চরিত্র, জীবন-সংগ্রাম কোনও কিছুর সাথেই তো বিজেপি দল এবং তার নেতাদের কোনও মিল নেই।

স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর আপসহীন ভূমিকার জন্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় নেতা হিসাবে জনমনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের জন্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। সুভাষচন্দ্রের লক্ষ্য ছিল দেশকে সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্ত করে একটি শোষণহীন, সুখী সমাজ গড়ে তোলা। তার জন্য তিনি জীবন পণ করেছিলেন। তাঁর শোষণহীন সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্য পূরণ করার জন্যই কি বিজেপি নেতারা তাঁকে স্মরণ করছেন? এই স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে বিজেপির পূর্বসূরিদের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল? সুভাষচন্দ্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র কি বিজেপি নেতারা অনুসরণীয় মনে করেন? নেতাজি জন্মজয়ন্তী পালনের আগে এ সব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর হওয়াটা জরুরি। না হলে স্মরণ করার ছলে মহান এই নেতাকে অপমানই করা হবে।

বিজেপি যে আরএসএসের মতাদর্শে পরিচালিত, তার যিনি নীতি নির্ধারক সেই এম এস গোলওয়ালকরের লেখাগুলি পড়লেই যে কেউ দেখবেন এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরএসএস স্বীকারই করেনি। ব্রিটিশ বিরোধিতাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেছে। তাঁদের দৃষ্টিতে নেতাজি সহ স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা-কর্মী এবং বিপ্লবীরা ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল। বিজেপির বর্তমান নেতারা কি গোলওয়ালকরের বক্তব্যকে ভুল বলে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন? সুভাষচন্দ্র যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করছেন, তখন বিজেপির আর এক প্রাণপুরুষ সাভারকর ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য দেশের যুবকদের ডাক দিচ্ছেন। এই সময় হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বলেছিলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও প্রয়োজনই নেই। আমরা এমনিতেই স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছি। স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশকে সহযোগিতার জন্য কি তাঁরা দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন?

সুভাষচন্দ্র রাজনীতিকে সব সময় ধর্মীয় চিন্তা থেকে দূরে রাখার কথা বলেছেন। তিনি মনে করতেন দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক সমস্যাগুলি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জনগণকে একই রকম ভাবে জর্জরিত করছে। এর মোকবিলাও করতে হবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভাবে। বর্তমান বিজেপি নেতারা কি সামাজিক জীবনের তীব্র সংকটগুলিকে এ ভাবেই দেখেন? তাঁরা কি তার মোকাবিলা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভাবে করার কথা ভাবেন? সকলেই জানেন, ভাবা দূরের কথা ধর্মীয় বিভেদ তৈরিই বিজেপি রাজনীতির মূল কথা। সাম্প্রদায়িকতাই তাদের মূলধন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, কোনও দিক থেকেই যদি বিজেপির সাথে নেতাজির চিন্তার কোনও মিল না থাকে, বরং উভয়ের চিন্তা পরস্পরের বিপরীতই হয় তবে বিজেপি নেতারা নেতাজি জন্মজয়ন্তী উদযাপনের কথা ভাবলেন কেন?

কারণ, বিজেপি নেতারা ভালভাবেই জানেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেদের ভূমিকার জন্য জনমনে তাঁরা নিন্দিত। তাঁদের দলের এমন কোনও নেতা নেই যাঁকে তাঁরা আদর্শ হিসাবে দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে কংগ্রেসের এক দক্ষিণপন্থী নেতা, যিনি ছিলেন সুভাষচন্দ্রের চরম বিরোধী এবং গান্ধীহত্যার পর আরএসএসকে দেশজোড়া গণরোষের হাতে থেকে নানা কায়দায় রক্ষা করেছিলেন, তাঁর বিশাল মূর্তি স্থাপন করে তাঁকেই পুজো করছেন। তেমনই তাঁরা জানেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন নেতা হিসাবে জনমানসে আজও শ্রদ্ধার সবচেয়ে বড় আসনটি রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্রেরই। বাঙালি মানসেও সুভাষচন্দ্রের আসন আজও সবার উপরে। বিজেপি এই মুহূর্তে বাংলার ক্ষমতা দখল করতে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাতে বিরোধী দল ভাঙানো, দেদার অর্থ ছড়ানো, এনআরসির ভয় দেখানো, সাম্প্রদায়িক প্রচার প্রভৃতির সাথে নেতাজিকে তাঁরা কত শ্রদ্ধা করেন তা দেখাতে পারলে ভোটে বাঙালি মন জয় করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে তাঁরা মনে করছেন।

তা হলে নেতাজির মতো অনন্যসাধারণ এক চরিত্রের থেকে কোনও কিছুই গ্রহণ না করে, তাঁর স্বপ্নকে সফল করার কোনও চেষ্টা না করে শুধু মাত্র ভোটের জন্যই বিজেপির এই ভণ্ডামির আশ্রয় নেওয়া। এ যেমন গোটা দেশবাসীর সাথে প্রতারণা, তেমনই নেতাজির প্রতিও চরম অসম্মান। আজ যদি নেতাজির প্রতি সরাসরি কেউ অসম্মান প্রদর্শন করত, দেশের মানুষ কি মেনে নিত? তা হলে এই যে, শুধুমাত্র ভোটের জন্য নেতাজিকে ব্যবহার করা, নেতাজির আদর্শ, জীবন-সংগ্রাম, তাঁর লক্ষ্য সব কিছুকে বাদ দিয়ে শুধু তাঁর ছবিটিকে সংকীর্ণ ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করা, এটাও কি নেতাজির প্রতি চরম অসম্মান নয়? এটা কি দেশের মানুষ নীরবে মেনে নেবে? এটা মেনে নিয়ে কি আমরা কেউ তাঁর ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে সম্মান জানাতে পারব? জানালে তা কি যথার্থ সম্মান জানানো হবে?

নেতাজির প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো যেতে পারে একমাত্র তাঁর অপূরিত স্বপ্নকে সফল করার সংগ্রামের মধ্যে আত্মনিয়োগ করার মধ্য দিয়ে। সেই স্বপ্ন ছিল এমন একটি স্বাধীন ভারত গড়ে তোলা যেখানে শোষণ থাকবে না, নিপীড়ন থাকবে না, ধর্ম-বর্ণের বিভেদ থাকবে না, বেকারি-অনাহার থাকবে না। সমস্ত মানুষের স্বাধীন বিকাশ ঘটবে। এর জন্য তিনি স্বাধীনতার পর আরও একটি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তা হল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। বিজেপির সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কি নেতাজিকে যথার্থ সম্মান জানাতে পারে?

(গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১৫ সংখ্যা_১ জানুয়ারি, ২০২১)