হিন্দুত্ববাদী টেররিস্টকে প্রার্থী করল বিজেপি

বাপ রে অভিশাপের কী তেজ যার জেরে একজন ডাকসাইটে আইপিএস অফিসারের পর্যন্ত জীবন চলে যেতে পারে! এই ঘোর কলিকালে উপস্থিত কোন মহাতপস্বী তিনি? ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমের দৌলতে সারা দেশের মানুষ জেনে গেছে যে, তিনি বিজেপির শেষ ভরসা আগুনখোর হিন্দুত্ববাদী ব্র্যান্ডের অন্যতম– ভোপালে দলের প্রার্থী, প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর বা সাধ্বী প্রজ্ঞা৷ তিনি সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, মহারাষ্ট্র পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম স্কোয়াড (এটিএস)–এর প্রধান হেমন্ত কারকারে তাঁর অভিশাপেই মুম্বই হামলার দিনে সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন৷ অবশ্য পরে একটু ঢোক গিলে নামকাওয়াস্তে ‘কথা প্রত্যাহার করছি’ বললেও তিনি বা তাঁর দল কিংবা তাঁর পূজিত প্রধানমন্ত্রী কোথাও ক্ষমা চাননি৷

ভোটারদের কাছে প্রজ্ঞার কোন মহৎ কর্মটি তুলে ধরতে চায় বিজেপি? তিনি ২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওতে বিস্ফোরণ এবং নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত৷ এই বিস্ফোরণে ৬ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন, ১০০–র বেশি মানুষ গুরুতর আহত হয়েছিলেন৷ মহারাষ্ট্র সরকারের পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে দেখে ‘অভিনব ভারত’ নামে আরএসএস ঘনিষ্ঠ উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এর পিছনে আছে৷ সনাতন সংস্থা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইত্যাদি সংগঠনের নামও নানা ভাবে এই ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে৷ বিজেপি এবং শিবসেনা প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে এই মামলায় অভিযুক্তদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে একাধিকবার৷ এই মামলা লড়ার জন্য তারা সমস্ত অভিযুক্তদের আর্থিক দায়িত্বও নিয়েছে৷ এ হেন দাগী সন্ত্রাসবাদী সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের সেই ভাবমূর্তিতেই ভরসা রেখেছে বিজেপি৷

কিছুদিন আগে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, নীতি–ফিতি দেখার দরকার নেই– ভোটে জেতাটাই আসল কথা (আনন্দবাজার পত্রিকা ১৩ মার্চ ২০১৯)৷ তাঁর দিক থেকে এ– কথার কোনও অন্যথা হয়েছে, এমন অপবাদ তাঁর অতিবড় শত্রুও দিতে পারবে না৷ নীতি–নৈতিকতা–আদর্শের বালাই বিজেপির কোনও দিন ছিল না, থাকার কথাও নয়৷ কিন্তু দলের শুরুর দিকে নীতিনিষ্ঠতার একটা ভড়ং ছিল, এখন সে আলখাল্লাটুকুও আর গায়ে রাখতে পারছে না তারা৷ ভোটের মুখে তারা বলবেই বা কী বেকারদের কাজ, কৃষকের ফসলের দাম, ঋণের জাল থেকে কৃষকের মুক্তি, নারী নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য–শিক্ষার উন্নতি, দেশের মানুষের অন্নসংস্থান, এসব নিয়ে কোনও কথা উচ্চারণ করাও নরেন্দ্র মোদির দলের পক্ষে সম্ভব নয়৷ যেমন সম্ভব নয় কালোটাকার রমরমার বিরুদ্ধে কিছু বলা, কিংবা নোট বাতিলে কী কী সুফল দেশ পেল, তা নিয়ে কোনও কথা উচ্চারণ করা৷ তাই এখন তাদের একমাত্র হাতিয়ার, জঙ্গী হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে ধর্ম–সম্প্রদায়ভিত্তিক মেরুকরণ সৃষ্টি করা৷ তথাকথিত হিন্দুত্বের চ্যাম্পিয়ন সেজে উগ্র ধর্মান্ধতার ভিত্তিতে দেশে বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরি করে ভোটে লড়া ছাড়া বিজেপির আর কোনও পুঁজি নেই৷ সেনা জওয়ানদের ছবি টাঙিয়ে, বালাকোটে বিমান হামলা থেকে শুরু করে নানা বিষয়কে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক লড়াকু যোদ্ধা সেজে ভোটের মঞ্চে নামতে চেয়েছিল বিজেপি৷ ট্র্যাজেডি হল, সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্তরাই এখন তাদের ভোট প্রচারের হাতিয়ার৷ সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারক যথার্থই বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদের কোনও জাত–ধর্ম হয় না’৷ আইসিস, লস্কর–ই–তৈবাও ধর্মের নামে মানুষকে মারে, সাধু কিংবা সাধ্বী সাজা প্রজ্ঞা সিং, অসীমানন্দরাও তাই করেন৷ পার্থক্য কোথায়?

মালেগাঁও বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে পুলিশ দেখে বোমা বিস্ফোরণে ব্যবহৃত মোটর বাইকটির মালিক আরএসএস–বিজেপির ছাত্র শাখা এবিভিপির প্রাক্তন নেত্রী সাধ্বী প্রজ্ঞা৷ পুলিশি তদন্তে পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসে, এই সন্ত্রাসবাদী হামলায় মূল চক্রীদের অন্যতম হলেন প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর, যিনি সাধ্বীর খোলস ধারণ করে থাকেন৷ বস্তুত ২০০৬–এ মালেগাঁওতে প্রথম বিস্ফোরণ, ২০০৭–এ হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদে বিস্ফোরণ, ওই একই বছরে সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ, আজমের শরিফে বিস্ফোরণে বহু মানুষকে হত্যার ঘটনার সাথেও সাধ্বী প্রজ্ঞার নাম জড়িয়ে আছে৷ প্রজ্ঞা, অসীমানন্দ সহ তাঁর এবং তাঁর সহযোগীদের লক্ষ্যই ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করে তথাকথিত ‘ইসলামিক জেহাদে’র পাল্টা ‘হিন্দু জেহাদ’ করা৷ একথা তাঁরা প্রকাশ্যে বারবার বলেছেনও৷ সমঝোতা এক্সপ্রেস মামলায় বিচারক পর্যন্ত এক সাক্ষীকে উদ্ধৃত করে রায়ে একথা উল্লেখ করেছেন৷

কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের কাজের একটু খোঁজ রাখলেই জানা যায় যে জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) বাস্তবে চলে তিনটি লোকের অঙ্গুলি হেলনে৷ তার মধ্যে একজন সরকারের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা তথা এনআইএ প্রধান নিজে৷ আর দু’জন হলেন প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি৷ সেই এনআইএ বিজেপি ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে আদালতে কেমন মামলা লড়তে পারে তা সহজেই অনুমেয়৷ তাই সমঝোতা এক্সপ্রেস থেকে শুরু করে মক্কা মসজিদ সহ কোনও মামলাতেই ‘কট্টর হিন্দুত্ববাদের জ্বলন্ত প্রতীক’ এই সাধ্বী প্রজ্ঞা, অসীমানন্দদের বিরুদ্ধে তারা কিছু প্রমাণের চেষ্টাই কখনও করেনি৷ বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরেই ২০১৫ সালে এনআইএ, সাধ্বী প্রজ্ঞাকে ক্লিন চিট দিয়ে দিয়েছিল৷ বলেছিল, তদন্তে কিছুই পাওয়া যায়নি৷ কিন্তু এনআইএ বিশেষ আদালতের বিচারক তাদের সাথে একমত হতে পারেননি৷ তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, ‘এ কথা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, আসামী নম্বর–এক জানত না তার মোটর সাইকেলটি কোন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে৷’ শুধু তাই নয় বিচারক রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা কম হওয়াতে তিনি (প্রজ্ঞা) অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন৷ ফলে আসামী নম্বর–এক বর্তমান অপরাধের সাথে কোনওভাবে যুক্ত ছিল না, এনআইএ–র এই যুক্তি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়’ (ফার্স্ট পোস্ট, ১৮ এপ্রিল ২০১৯)৷ এমন ঘটনা সমঝোতা এক্সপ্রেস এবং হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ সহ সবগুলি মামলার ক্ষেত্রেই ঘটেছে৷ বিজেপি সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশে এনআইএ কিংবা সিবিআই কোনও প্রমাণ পেশ করেনি৷ মক্কা মসজিদ মামলায় সরকারি তদন্ত সংস্থার অসহযোগিতায় সকলকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বিচারক৷ তাই রায় ঘোষণা করেই তিনি বিচারকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন৷ সমঝোতা এক্সপ্রেস মামলায় বিচারক গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, সব কিছু বোঝা গেলেও তদন্তকারীদের অনিচ্ছার জন্য অপরাধীকে শাস্তি দিতে না পারাটা বিচারক জীবনের এক গভীর দুঃখের অধ্যায়৷

সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিহত পুলিশ অফিসার হেমন্ত কারকারেকে নিয়ে সাধ্বী প্রজ্ঞা অতি কুৎসিত এবং অমানবিক মন্তব্য করলেও দলগতভাবে বিজেপি তার নিন্দাটুকুও করেনি৷ প্রধানমন্ত্রী বুক বাজিয়ে কত কথাই না বলেন, অথচ এই নিয়ে তাঁর নীরবতাই আসলে সবচেয়ে বেশি বাঙ্ময়৷ ২৬ নভেম্বর, ২০০৮ মুম্বই হামলার কিছুক্ষণ আগে কারকারে টিভি সাক্ষাৎকারে জানান, হিন্দুত্বের নাম করে এই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জাল গুটিয়ে আনা হচ্ছে, আরও কিছু প্রভাবশালী লোক এই মামলায় গ্রেপ্তার হবেন খুব শীঘ্রই৷ কিন্তু তিনি আর সময় পাননি৷ মুম্বই হামলার খবর পেয়েই তিনি কর্মক্ষেত্রে চলে যান৷ সেখানে বন্দুকবাজদের হামলায় তিনি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান৷ এই মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, কারণ হেমন্ত কারকারের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটি নাকি খুঁজেই পাওয়া যায়নি৷ প্রশ্ন ওঠে আসলের বদলে একটি নকল জ্যাকেট দিয়েই তাঁকে লড়তে পাঠানো হয়েছিল কিনা? অরক্ষিত অবস্থায় তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল কারা? এই প্রশ্নটাকে কংগ্রেস–বিজেপি–শিবসেনার মতো দলগুলি চিরকালই চাপা দিতে চেয়েছে৷ কারণ তাদের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক হারানোর আশঙ্কা এর সাথে যুক্ত৷ ২০০৮–এর অক্টোবরে সাধ্বী প্রজ্ঞা সহ অন্যদের গ্রেপ্তারের পর থেকেই যে তাঁর উপর চাপ আসছিল কারকারে সেটা মুম্বই পুলিশের তৎকালীন কমিশনার জুলিও রিবেইরোকে জানিয়েছিলেন৷ কারকারে তাঁকে বলেছিলেন, মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারের এক ক্যাবিনেট মন্ত্রী এবং নানা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী তাঁকে এই মামলা দুর্বল করতে চাপ দিচ্ছে৷ রিবেইরো স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, সরকারি উকিল নিজেই আদালতে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেছিলেন যে, মামলা নিয়ে ধীরে চলার জন্য সরকারপক্ষ থেকেই চাপ আসছে (ইকনমিক টাইমস, ২০ এপ্রিল ২০১৯)৷

কারকারের মৃত্যুর পর বিস্ফোরণ মামলাগুলি পুরোপুরি গতি হারায়৷ সেই সময় যিনি মালেগাঁও মামলার পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন, সেই রোহিনী সালিয়ান এনডি টিভির এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি জানিয়েছেন, ২০১৫–তে মামলা দুর্বল করার জন্য এনআইএ তাঁকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকলে তিনি মামলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন৷ তিনি আরও বলেছেন, প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে যে কোনও চাপ দিয়ে, অত্যাচার করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়নি, এ বিষয়ে আদালত এবং তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত (এনডি টিভি, ২১ এপ্রিল ২০১৯)৷ অর্থাৎ প্রজ্ঞা সিংকে বাঁচাতে এনআইএ–কে সরাসরি কাজে লাগিয়েছে বিজেপি৷ বিশেষ স্বার্থ রক্ষার জন্যই হেমন্ত কারকারে–কে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, প্রজ্ঞা সিংয়ের অভিশাপ তত্ত্ব আরও একবার সেই সন্দেহকেই জোরদার করল৷ মুখোস খসে গিয়ে আরও একবার প্রকট হল প্রজ্ঞা সিংদের মতো বিজেপির আসল মুখ৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা)