হিজাব বিতর্ক: ছকে রাখা চিত্রনাট্য ব্যবহারের চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীদের

কর্ণাটকের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিজাব বিতর্ক সম্প্রতি সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। ভোট ব্যাঙ্ক ভরানোর স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে তুলতে বিজেপি কতদূর নামতে পারে, এই ঘটনায় তা আবার স্পষ্ট হল। পাশাপাশি এই বিতর্ক ভারত রাষ্ট্রটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণের অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সর্বোপরি সংখ্যালঘু সমাজের কন্যাদের পড়াশোনার প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল।

বিতর্কের সূচনা

ঘটনার শুরু জানুয়ারি মাসে। কর্ণাটকে উদুপির একটি প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজে ছয় ছাত্রীকে হিজাব পরে ক্লাসে ঢুকতে বাধা দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢোকার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না–এই দাবিতে ওই ছাত্রীরা ধরনায় বসেন। অন্য কলেজেও প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে উদুপি ও চিকমাগালুরে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি হিজাব পরে কলেজে আসা চলবে না বলে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। তারা গেরুয়া উত্তরীয় ও পাগড়ি পরে পাল্টা ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে কলেজে। একটি কলেজে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষও হয়। সংবাদে প্রকাশ, গেরুয়া হামলার এই ঘটনা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এমনকি রাজ্যের বিজেপি সরকারের এক মন্ত্রীপুত্রকে উত্তরীয় ও পাগড়ি জোগান দিতেও দেখা গেছে। কর্ণাটকের বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, হিজাব ধর্মীয় পোশাক হওয়ায় তা সমতা, অখণ্ডতা ও আইনশৃঙ্খলা ব্যাহত করে। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরা যাবে না। অন্যদিকে হিজাব পরা তাদের অধিকার–এই দাবি জানিয়ে মুসলিম ছাত্রীরা হাইকোর্টে মামলা করে। সেই মামলা এখনও চলছে।

ধর্মনিরপেক্ষতার ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে ভারত রাষ্ট্র

হিজাব পরা ভাল কি মন্দ, তা নারীস্বাধীনতার অন্তরায় কি না ইত্যাদি বিষয়গুলি দূরে সরিয়ে রেখে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে আসে, তা হল–হঠাৎ হিজাবে নিষেধাজ্ঞা কেন? এ কথা ঠিকই যে সংবিধান অনুযায়ী ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সঙ্গে সঙ্গে কেউ বলতে পারেন, ধর্মীয় চিহ্নবাহী পোশাকও তাই সেখানে চলবে না। এমন একটি দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় আচরণ কোনও ভাবেই আসা উচিত নয়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার এই রীতি সবক্ষেত্রে কতখানি মেনে চলা হয় এ দেশে?

প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সমস্ত রকম অপার্থিব বিষয়ের অস্বীকৃতিকে বোঝায়। আঠারো শতকে যে সমস্ত মূল্যবোধ বুর্জোয়া বিপ্লবকে প্রভাবিত করেছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল তার অন্যতম। সামন্ততন্ত্রকে উৎখাত করে ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতার চিন্তাকে ভিত্তি করে সেই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিসরের সমস্ত ক্ষেত্রকে ধর্মের স্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। কেবল ব্যক্তিগত ভাবে পালনীয় আচরণ হিসাবে গণ্ডি টেনে দেওয়া হয়েছিল ধর্মের চারধারে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে এ দেশে কায়েম হয়েছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। গোটা বিশ্বে পুঁজিবাদ তখন তার বিকাশের যুগ পার করে ফেলেছে। বুর্জোয়া শাসক শ্রেণি শোষণের জন্য, শোষিত মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিভাজিত করার জন্য ধর্ম, কুসংস্কার ও গোঁড়ামিকে হাতিয়ার করেছে। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ে আপসহীন সংগ্রামী ধারার ঊজ্জ্বল উপস্থিতি সত্ত্বেও মূল ধারাটি ছিল আপসমুখী। কংগ্রেসের গান্ধীবাদী নেতৃত্ব জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের কর্মসূচিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মসূচিতে যুক্ত করেননি। ফলেসমাজ জীবনে জাতপাতের ভেদাভেদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি থেকেই গেছে। তাই সংবিধানে যাই লেখা থাক, এ দেশের শাসকরা ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে কার্যত সমস্ত ধর্মকে উৎসাহ প্রদান হিসাবেই দেখেছে। ফলে এদেশের সামাজিক পরিসরে ধর্মীয় আচরণ পালন বা ধর্মীয় পোশাক পরিধান খুবই সাধারণ বিষয়। সরকারি মন্ত্রী ও আমলাদের অহরহ নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখা যায়। এমনকি ইসরোর মতো সরকারি বিজ্ঞান সংস্থাতেও মহাকাশে রকেট উৎক্ষেপণের আগে নারকেল ভেঙে হিন্দু মতে পূজার্চনার ব্যবস্থা করেন কর্তৃপক্ষ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রাথমিক শর্ত বিসর্জন দিয়ে প্রবল আড়ম্বরে অযোধ্যায় নব রূপে সজ্জিত রামমন্দির উদ্বোধন করতে দেখা গেল। এই সেদিন বেনারসে গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে স্তোত্র আউড়ে হিন্দু দেবতার আরাধনাও করলেন তিনি। আর একজন তো গেরুয়া পরেই মুখ্যমন্ত্রীত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন।

পিছনে ছিল ভোটের স্বার্থ

এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ কলেজে হিজাব নিষিদ্ধের ডাক কেন? বিবাহিতা হিন্দু ছাত্রী-অধ্যাপিকারা তো সিঁদুর সহ বিবাহের সমস্ত রকম ধর্মীয় চিহ্ন শরীরে বহন করেই বিনা বাধায় চিরকাল ক্লাস করে আসছেন! কোথাওই তো তাতে আপত্তি জানানো হয় না! শিখ ধর্মাবলম্বীরা পাগড়ি পরে, খ্রিস্টানরা ক্রস ধারণ করে সামাজিক পরিসরে অবাধে বিচরণ করে থাকেন। যাঁরা হিজাব পরার বিরোধিতা করছেন, তাঁরা যদি সমস্ত ধর্মীয় চিহ্নের বিরোধিতা করতেন এবং একটা নীতিগত অবস্থান নিতেন, তা হলেও না হয় ব্যাপারটা যুক্তিগ্রাহ্য হত। তা তাঁরা করেননি।

জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে আপসমুখী নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে ভারতের জাতীয়তাবাদ মূলত হিন্দু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ হিসাবেই দাঁড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কেন্দে্র শাসনক্ষমতায় থেকেছে যে কংগ্রেস, ভোটের স্বার্থে, মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়াতে আওড়াতেই তারা চিরকাল নরম হিন্দুত্বের চর্চা করে চলেছে। আর এখন সরকারে আছে যে বিজেপি, তা তো পরিচালিতই হয় হিন্দু সাম্প্রদায়িক আরএসএস-এর মতাদর্শে। ফলে আজ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা যথেষ্ট চাপের মুখে দাঁড়িয়ে। কে কী খাবেন, কী পরবেন, তার নিদান হাঁকছেন শাসক বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা। নির্বাচনের আগে এলাকায় এলাকায় দাঙ্গা বাধানো, গোমাংসের ধুয়ো তুলে সংখ্যালঘু মানুষকে পিটিয়ে হত্যা–এসব এখন সাধারণ ঘটনা। হয় কথায় নয় কথায় অন্য ধর্মের মানুষকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলেছেন বিজেপি-আরএসএসের নেতারা। দিনে দিনে বাড়ছে সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রকাশ্যে বিরূপতা প্রকাশ, নিগ্রহ, লুটপাট, সম্পত্তি ভাঙচুরের মতো নানা নিপীড়ন। আর হিন্দুভোট একজোট করার লক্ষে্য এসবে প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে মদত দিয়ে চলেছে শাসক দলের বড়কর্তারা। সংখ্যালঘু নিপীড়নের যে সব ঘটনায় দেশ জুড়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে মানুষ, এমনকি সে-সব ঘটনা নিয়েও কোনও নিন্দাসূচক বাক্য শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহচরদের মুখ থেকে। ফলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে মেরুকরণ করে ফায়দা লোটার উদ্দেশ্যেই হিজাব বিতর্ক উস্কে তুলেছিল হিন্দুত্ববাদীরা। তাদের ছক অনুসরণ করেই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে হিজাব বিতর্ক নিয়ে উত্তরপ্রদেশে ভোটের ময়দানে ঝাঁপ দিয়েছিলেন সংখ্যালঘু মৌলবাদী সংগঠন ‘মিম’-এর নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি। হিজাবের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তাঁর বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রচার তুলে হিন্দু ভোট গুছিয়ে নিয়েছে বিজেপি। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, অনেক আগে থেকেই ছকে রাখা ছিল হিজাব-কাণ্ডের চিত্রনাট্য। কর্ণাটকের মুসলিম মেয়েদের সেই ছকেই ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নারীমুক্তির লড়াই লড়তে হবে নারীদেরই

কর্ণাটকের এই ঘটনা নিয়ে অন্য একটি দিক থেকেও একদল মানুষ হিজাবের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, কাপড়ের এই আচ্ছাদন পরিধান আসলে ধর্মের মোড়কে আধিপত্যবাদী পুরুষতন্ত্রেরই চিহ্ন। নারীকে এই পোশাক পরার বিধান দেওয়ার পিছনে রয়েছে, তাদের ভোগ্যবস্তু হিসাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, সেই কারণেই হিজাব বর্জনের ডাক দেওয়া উচিত মেয়েদের।

হিজাব সম্পর্কে তাঁদের মূল্যায়নের সঙ্গে সহমত হয়েও একটা কথা বলাই যায় যে, কোনও ধর্মই আজ নারীকে ভোগ্যবস্তুর চেয়ে উন্নততর কিছু ভাবে না। হিজাবের মতোই হিন্দুদের শাঁখা-সিঁদুর, লোহার চুড়ি– এসবও যে পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া শৃঙ্খল, ইতিহাস তা-ই বলে। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে দাসত্বের এ সব চিহ্ন বর্জন করার সংগ্রামে অবশ্যই সামিল হতে হবে আধুনিক নারীকে। কিন্তু সে সংগ্রামে তো নারীদের ঠেলে পাঠিয়ে দিতে পারবেন না নারীমুক্তিকামী মানুষজন! পুরুষতন্ত্রের শেকল ভাঙার প্রেরণা আসবে মেয়েদের নিজস্ব জাগ্রত চেতনা থেকে। সেই চেতনার জন্ম হবে যথাযথ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক আন্দোলনগুলিতে সামিল হয়ে লড়াই করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার জন্য তো সর্বাগ্রে প্রয়োজন পড়াশোনার সুযোগ। বহু আলোচিত সাচার কমিশনের রিপোর্টেই রয়েছে গোটা সংখ্যালঘু সমাজের সার্বিক পিছিয়ে পড়ার করুণ ছবি। সেখানে মুসলিম মেয়েদের বড় অংশটাই তো রয়ে গেছে গভীর অন্ধকারে। এই অবস্থায় ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ স্লোগান দেওয়া সরকারের তো উচিত এই মেয়েদের শিক্ষাঙ্গনে টেনে আনার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করা। তা না করে শাসক বিজেপির কার্যকর্তারা ভোটের ক্ষুদ্র স্বার্থে হিজাব নিয়ে শোরগোল তুলে মেয়েদের যে অংশটুকু বাইরে বেরিয়ে পড়াশোনার সুযোগ করে নিয়েছিলেন, তাঁদেরও আটকে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

নারীচেতনার উত্তরণই ছুঁড়ে ফেলবে সংস্কারের চিহ্নগুলিকে

সত্যিই যদি কোনও সরকার চায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় পরিচয়বাহী পোশাক বর্জিত হোক, তাহলে প্রথমেই যা প্রয়োজন তা হল যথাযথ শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার ঘটানো। বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের পোশাক নিয়ে বিতর্ক তুলে ঘোলা জলে মাছ ধরতে না নেমে পিছিয়ে পড়া অংশ সহ সমস্ত মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া দরকার শিক্ষার আঙিনা। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আরও বেশি করে সামিল হতে উৎসাহিত করা দরকার নারীদের। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে পুরুষের পায়ে পা মিলিয়ে কদম কদম এগোতে এগোতেই তো একদিন খসে পড়বে হিজাব, ছিঁড়ে পড়বে সিঁদুর-শাঁখা-ঘোমটার বন্ধন। পুরুষের সম-উচ্চতায় দাঁড়িয়ে সূর্যের অপার আলোর নিচে সেদিন মাথা উঁচু করে হাঁটবে নারী। একুশ শতকে নারীর এই উত্তরণই তো কাম্য!