হায় রে গণতন্ত্র! জামিন পেতেও যেতে হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে

ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ বিক্রান্তকে জলে ভাসিয়ে যে-দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘আত্মনির্ভরশীল ভারত’-এর গর্বে ছাতি ফোলালেন, ঠিক সেই দিনই সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদকে দু’মাস জেলে কাটানোর পর জামিন পেতে সুপ্রিম কোর্টের শরণ নিতে হল। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, তিস্তাকে দুমাস জেলে আটকে রাখার কোনও কারণ ছিল না। নিম্ন আদালত, বিশেষত উচ্চ আদালতের উচিত ছিল তাঁকে জামিন দেওয়া। অথচ তা তারা দেয়নি। কেন দেয়নি? তার জন্য হাইকোর্টকে তীব্র ভৎর্সনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট।

একজন মহিলা সমাজকর্মী, যিনি গুজরাট দাঙ্গায় আক্রান্ত এবং নিহতদের সুবিচারের জন্য লড়াই করে চলেছেন, তাঁকে বিনা কারণে দু’মাস জেলে আটকে রাখাটা দেশের পক্ষে গৌরবের কি না, সে-বিষয়ে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর মত জানা যায়নি। তবে দীর্ঘ এই দু-মাসে তাঁর নীরবতা থেকে প্রমাণ হয় একে তিনি কোনও অন্যায় বলে মনে করেন না। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী যা-ই মনে করুন, দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ, সভ্য নাগরিকরা সরকারের এই চরম অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী মনোভাবে লজ্জিত। তাঁরা মনে করেন, বিজেপি সরকারের এই মনোভাব ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে চরম অগৌরবের, লজ্জার। তাই তিস্তার গ্রেফতারির প্রতিবাদ উঠেছে সমস্ত গণতান্ত্রিক মহল থেকে। বহু আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, প্রাক্তন আমলা, শিক্ষাবিদ, মানবাধিকার কর্মী শীর্ষ আদালত এবং রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখে এর প্রতিবাদ করেছেন। এস ইউ সি আই সি-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ তিস্তার গ্রেফতারির তীব্র নিন্দা করে তাঁর মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে এগিয়ে আসার জন্য জনসাধারণের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন।

কোন অপরাধে তিস্তাকে গ্রেফতার করেছিল গুজরাট সরকার? ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় খুন হওয়া প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরির স্ত্রী জাকিয়া জাফরি এবং সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদ যৌথ ভাবে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে আর্জি জানান, ওই দাঙ্গায় গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া ক্লিনচিট খারিজ করুক আদালত। গত ২৪ জুন সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের আবেদন খারিজ করে এবং এই আবেদনের পিছনে ‘অন্য কোনও উদ্দেশ্য’ থাকার কথা বলে।

এর পরেই গুজরাটের বিজেপি শাসিত সরকার তিস্তার বিরুদ্ধে আমেদাবাদ থানায় এফআইআর দায়ের করে। গুজরাট দাঙ্গার সাক্ষ্যপ্রমাণ জাল করার অভিযোগে গুজরাটের এটিএস মুম্বই থেকে গ্রেফতার করে তিস্তাকে।

শুনানিতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তিস্তাকে জামিন না দেওয়ার কোনও কারণ হাইকোর্টের ছিল না। প্রধান বিচারপতি শুনানিতে বলেন, এই মামলায় এমন কোনও অপরাধের উল্লেখ নেই, যে কারণে তিস্তাকে জামিন দেওয়া যায় না। উপরন্তু তিস্তা যেহেতু একজন মহিলা, তাই তাঁর জামিনে হাইকোর্টের তৎপরতা আবশ্যক ছিল। কোন নথিপত্র তিস্তা জাল করেছেন, এটিএস-এর করা এফআইআরে তারও কোনও উল্লেখ নেই। তা হলে কেন তিস্তার জামিন এ ভাবে আটকে রাখা হল?

পুরো ঘটনা থেকে স্পষ্ট, তিস্তাকে জেলে আটকে রেখে ‘শিক্ষা’ দেওয়াই এখানে সরকারের মূল উদ্দেশ্য। গুজরাট দাঙ্গার সময়ে নরেন্দ্র মোদি ছিলেন সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী। দাঙ্গার সময়ে সংখ্যালঘু মানুষকে রক্ষা করার তাঁর যে সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্ব, তিনি তা পালন করেননি। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তাঁর বিস্ময়কর নিষ্ক্রিয়তা প্রকারান্তরে দাঙ্গায় অংশগ্রহণ ছাড়া কিছুই ছিল না। তাঁর নিষ্ক্রিয়তা দেশে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এতটাই ঝড় তুলেছিল যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকেও আপাত নিরপেক্ষতা দেখিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে রাজধর্ম পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছিল প্রকাশ্যে। নরেন্দ্র মোদির এই জঘন্য ভূমিকা বিশ্ব জুড়ে নিন্দিত হয়।

সেদিনের মুখ্যমন্ত্রী আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী। স্বাভাবিক ভাবেই প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর দল বিজেপির লক্ষ্য গুজরাট দাঙ্গার রক্তের দাগ গা থেকে মুছে ফেলা। আর এই দাগ মুছে ফেলতে সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ, বিরোধিতাকে তারা লোপাট করতে চেয়েছে। যাঁরা দাঙ্গার পিছনের ষড়যন্ত্রকে উদঘাটন করতে চেয়েছেন, দাঙ্গাকারীদের শাস্তি চেয়েছেন, তাঁদের কেউ এখন সাজানো মামলায় জেলে, কেউ খুন হয়ে গেছেন। এই অবস্থায় নতুন করে প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙুল তোলার স্পর্ধা শাসকের দম্ভে আঘাত করেছে। তাই তিস্তাকে জেলে ভরে দৃষ্টান্ত তৈরি করে সমস্ত প্রতিবাদীদের সহবত শেখানোর জন্য ষড়যন্ত্রে নামে গুজরাট সরকার। এটিএস তিস্তাকে গ্রেফতার করে যে অভিযোগে তা এতই মিথ্যা যে তারা এফআইআরে তার উল্লেখও করতে পারেনি।

প্রধান বিচারপতি গুজরাট হাইকোর্টের ভূমিকারও যে ভাবে তীব্র ভৎর্সনা করেছেন তাতে বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকে না। তিনি বলেছেন, একজন মহিলার জামিনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাট সরকারকে বক্তব্য জানানোর জন্য ছয় সপ্তাহ সময় দেওয়াটা নজিরবিহীন। স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রশ্ন উঠছে যে, এটা যে নজিরবিহীন তা কি হাইকোর্টের বিচারপতির অজানা? তা যদি না হয় তবে কেন তিনি এমন ভূমিকা নিলেন? জনমনে এই সন্দেহ যে দৃঢ় হয়েছে, এটা শাসকের অন্যায় চাপের কাছে ন্যায়ালয়ের নতি স্বীকার, কথাটা তো উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল।

সরকারি ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সব স্তম্ভগুলিকে গ্রাস করার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চালাচ্ছেন বিজেপি নেতারা। বিচার ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করে নিজেদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা, সেই ষড়যন্ত্রেরই অঙ্গ। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ এই ষড়যন্ত্রকেই স্পষ্ট করেছে। এই ঘটনায় আরও স্পষ্ট হল, গণতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ যে ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, বিরোধিতার অধিকার, গায়ের জোরে, সরকারি ক্ষমতার জোরে এই সবগুলিকেই আজ লঙ্ঘন করছে, সেগুলির টুঁটি চেপে ধরছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল। প্রধানমন্ত্রী যতই সংবিধানে মাথা ঠেকান, সংবিধানের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যের চিহ্নমাত্র তাঁর আচরণে নেই। না হলে একজন মহিলাকে কি এ ভাবে জামিনের জন্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়! এ তো পুরোপুরি স্বৈরাচার।

কিন্তু আজ সময় এসেছে দেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলকে সহবত শেখানোর। প্রধানমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, তিনি যে বিক্রান্তকে দেশের গৌরব বলেছেন, তা যদি প্রতিরক্ষা বাহিনীর হাতে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হয়, তবে তা কার প্রতিরক্ষার জন্য? দেশের জন্য তো? দেশ মানে কি শুধু দেশের জমি, পাহাড়, জল আর জঙ্গল? দেশের মানুষ নয়? সেই মানুষ যদি এ ভাবে বে-আইনের দ্বারা, ক্ষমতাসীনদের দ্বারা, প্রতিহিংসার দ্বারা পদে পদে লাঞ্ছিত হয়, শৃঙ্খলিত হয়, তবে শুধু শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজের দ্বারা দেশের গৌরব রক্ষা হতে পারে কি? পারে না। তাই দেশের সত্যকার গৌরব রক্ষার জন্য, দেশের প্রতিটি নাগরিককে এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে।