সূর্য সেন শহিদ দিবস

প্রতি বছর ১২ জানুয়ারি আমরা স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিবস পালন করি। কিন্তু খুব কম লোকই এই দিনটিকে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আপসহীন ধারার বীরযোদ্ধা মাস্টারদা সূর্য সেনকে স্মরণ করেন। তাঁর আত্মোৎসর্গ দিবস উদযাপন করেন। বস্তুত যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন, শাসকের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে চান, প্রতিবাদ করেন, তাঁদের কাছে এই অনন্যসাধারণ মানুষটির জীবনবোধ অতুলনীয় শিক্ষা রেখে গেছে। চাইলে তাঁর জীবনী চর্চার মধ্যে দিয়ে নিজেকে গড়ে তোলার সঠিক উপাদানগুলো অর্জন করতে পারা যায়। সূর্য সেন কঠোর বাকসংযমী শুধু ছিলেন না, তাঁর সংযম ছিল আহারে-বিহারে-জীবনধারণের প্রতিটি স্তরে। শুধু বত্তৃতায় নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর অনন্যসাধারণ সংগ্রাম। যাঁরা প্রতিনিয়ত তাঁর সঙ্গে থেকেছেন, মিশেছেন, তাঁরা জানতেন যে তিনি নিজেকে তৈরি করার পথে কী কঠোর সংযমই না পালন করতেন। একদিনের কথা। তাঁর সহকর্মী বিনোদ দত্ত লিখছেন, দাদার সঙ্গে আছি। আমার নোংরা কাপড়খানা সাবান-কাচা করব, দাদার গেঞ্জিটাও সে-সঙ্গে কাচবার জন্য সাবান জলে ডুবিয়েছি। দূর থেকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে ঝট করে দাদা তার ভিজে গেঞ্জিটা তুলে নিলেন। ধুতে দিলেন না। বললেন, আমি মহন্ত নই। তুই, আমি এবং দলের প্রত্যেকে আমরা এক, আমরা বিপ্লবী। আজকে আমার গেঞ্জি ধুবি, কাল পা টিপবি– এসব চলবে না। এ করতে চাইলে আমার ধারে কাছেও আসতে দেব না। এতে মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়, দাস স্বভাব মাথাচাড়া দেয় । এ করবি না, কখনও না। প্রয়োজনে সবই করতে হয়, করবিও। যেমন মানুষকে সুস্থ করতে গিয়ে মলমূত্র হাতে তুলে ফেলতে হয় । ‘ভক্তি’ দেখানোর জন্য কিছু করতে হয় না। … আমি দাদাকে হৃদয়ের মধ্যে নিবিড় করে পেলাম। ভক্তি আমার নিশ্চয়ই বেড়ে গেল কর্তব্য পালনের মধ্যে, বাহ্যিক প্রকাশে নয়। মাস্টারদার তৎকালীন সহযোগী অনন্ত সিং লিখেছেন, এক অসাধারণ সংগঠক হিসেবে সংগঠন ও পস্তুতির পথে জটিল সমস্যার সমাধান, গুরুতর প্রশ্নের মীমাংসা ও সংকটজনক মুহূর্তে নির্দেশ দান প্রভৃতি ছিল মাস্টারদার জীবনের আড়ম্বরহীন, প্রকাশহীন গভীরতম দিক। …বহু তিক্ত অভিজ্ঞতা ও নিদারুণ ক্ষয়ক্ষতি থেকে শিক্ষা নিয়ে উপযুক্ত নেতৃত্ব দিয়ে মাস্টারদা যদি তাঁর নিজস্ব বিশেষ ধারায় সংগঠন পরিচালনা না করতেন, তবে ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিত। তিনি কোনও ব্যক্তি বা গৃহ বিশেষের লোক ছিলেন না। অন্তরের অন্তহীন ভালোবাসা দিয়ে তিনি কর্মীদের আগলে রাখতেন। কর্মীরা তাঁর কাছে পেয়েছে ভালবাসা, পায়নি আশকারা। বিভিন্ন কর্মীর মধ্যে কোনও তারতম্য করার অভ্যাস থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন। সর্বোপরি একজন সফল বিপ্লবী নেতার মতোই ‘আপনি আচরি ধর্ম’ তিনি তাঁর কর্মীদেরশেখাতেন। বর্তমান সময়ে যাঁরা নানা অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাইছেন, লড়াই গড়ে তুলতে চাইছেন, সেই লড়াইকে ধারাবাহিক ও দীর্ঘস্থায়ী করে সমাজ পরিবর্তনের পরিপূরক করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, তাঁদের অবশ্যই এই মহান বিপ্লবীর জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি সত্যিকারের আদর্শকে গ্রহণ এবং তার প্রয়োগ যদি নিখুঁত না হয় তাহলে সমস্ত লড়াই বিপথে চালিত হতে পারে। আর এক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় একটি যোগ্য নেতৃত্বের। সেই নেতৃত্বের মধ্যে ‘ভিতর’ ও ‘বাহির’ নামক আলাদা কোনও প্রকোষ্ঠ থাকলে চলে না। তাই মাস্টারদা আজও অনুসরণীয়, কারণ তাঁর ভিতর-বাহির ছিল অভিন্ন। পরিশেষে আশা রাখি, শাসকের বিভেদমূলক চক্রান্তের বিরুদ্ধে যে লড়াই-আন্দোলন শুরু হয়েছে তা যেন এক সত্যিকারের আদর্শভিত্তিক যোগ্য নেতৃত্বের পরিচালনায় সংযোজিত এবং সংগঠিত হয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। হঠকারিতা করে এমন কোনও কার্যকলাপ যেন সংঘটিত না হয়, যা আন্দোলনকে বিপথগামী করে ।

গৌতম দাস, মালদা

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৫ সংখ্যা)