সাম্রাজ্যবাদী শোষণের নতুন জালে বাঁধা পড়তে চলেছে আফ্রিকা

 

লকডাউন পর্বে গোটা দুনিয়া জুড়েই ব্যবসা–বাণিজ্যের হাল খারাপ৷ আবার এই লকডাউন–ই ফেসবুক, গুগল (ইউ টিউবের বর্তমান মালিক), মাইক্রোসফট ইত্যাদি কোম্পানির সামনে খুলে দিয়েছে মুনাফা লুটের বিপুল সুযোগ৷ তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়ার দানব হিসাবে পরিচিত এই সংস্থাগুলির সব ক’টিই মার্কিন সংস্থা৷

করোনা অতিমারির এই সময়ে এদের দেওয়া পরিষেবা এতটাই অপরিহার্য হয়ে উঠছে যে ফেসবুককে এখন আর শুধু সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে নয়, অভিহিত করা হচ্ছে ‘ইকো সিস্টেম’ বা বাস্তুতন্ত্র হিসাবে, যার ছাতার তলায় একে অপরের সঙ্গে সংযোগ রেখে বাস মনুষ্য প্রজাতির৷ ফেসবুক কোম্পানিই এখন হোয়াটস্যাপ, ইন্সটাগ্রাম ও মেসেঞ্জার সংস্থাগুলির মালিক৷ সব মিলিয়ে এগুলির ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতি মাসে ৩০০ কোটিরও বেশি৷ ব্যবসার রমরমা আরও বাড়াতে এই অতিমারির সময়েই ফেসবুক নতুন একটি পরিকল্পা করেছে৷ সমুদ্রের তলা দিয়ে ৩৭ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ কেবল বা তার নিয়ে গিয়ে গোটা আফ্রিকা মহাদেশ ঘিরে ফেলে তার সঙ্গে উত্তরে ইউরোপ ও পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সংযোগ স্থাপন করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা৷

প্রাথমিক ভাবে ২৩টি দেশ বাঁধা পড়বে এই নেটওয়ার্কে৷ ব্রিটেন থেকে শুরু করে নেটওয়ার্ক পৌঁছবে পর্তুগালে৷ এরপর সেনেগাল, আইভরি কোস্ট, ঘানা, নাইজিরিয়া, গ্যাবন, দুই কঙ্গো, দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, ম্যাডাগাস্কর, তানজানিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া, জিবুতি, সুদান, ইজিপ্টকে পাক দেবে এই নেটওয়ার্ক৷ তারপর ওমান ও সৌদি আরবকে যুক্ত করে ভূমধ্যসাগরের ওপারে ইটালি পৌঁছবে নেটওয়ার্ক এবং সেখান থেকে যাবে ফ্রান্স ও স্পেনে৷

কেন এমন অতিবৃহৎ প্রকল্প নিল ফেসবুক? তারা বলছে, এর দ্বারা আফ্রিকায় ইন্টারনেটের বিপুল বিস্তার ঘটবে এবং ব্যবসা–বাণিজ্য বাড়বে৷ কারণ, ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা যেখানে থাকে, সেখানেই ব্যবসা–বাণিজ্য বাড়ে৷ কথাগুলি শুনতে ভালই৷ কিন্তু যখন জানা যায়, সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে থাকা আফ্রিকার বিরাট অংশটিতে জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৬০ কোটি মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগই নেই, তখন তাদের মতলব সম্পর্কে সন্দেহ না জেগে পারে না৷ এই যদি আফ্রিকার বিরাট অংশের হাল হয় তাহলে ফেসবুক কোম্পানি ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করছে কাদের জন্য? আসলে আফ্রিকার বৃহৎ পুঁজিপতি শ্রেণি, যাদের সঙ্গে মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলির মালিকদের দহরম–মহরম, তাদের জন্যই এই ব্যবস্থা, যাতে আমেরিকায় থাকা মূল কোম্পানিগুলির সাথে এদের যোগাযোগের সুবিধা হয়৷

শুধু এটাই নয়, উদ্দেশ্য আরও আছে৷ ওয়াশিংটনে ‘আটলান্টিক কাউন্সিল’ নামে একটি প্রভাবশালী ও তথাকথিত ‘রাজনীতি নিরপেক্ষ’ সংস্থা আছে, যার কাজ হল তাদের নিজের ভাষায়– ‘বিশ্বে সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে মার্কিন নেতৃত্ব ও তার ক্রিয়াকলাপকে উৎসাহিত করা’৷ ২০১৮ সালে এই আটলান্টিক কাউন্সিলের অংশীদার হয় ফেসবুক৷ কেন তারা আটলান্টিক কাউন্সিলের অংশীদার হতে গেল? উত্তরে তারা জানিয়েছে, তাদের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নাকি, ‘বিশ্বজুড়ে যে নির্বাচনগুলি হয়, সেখানে ভুল তথ্য প্রচারিত হচ্ছে কি না তা দেখা এবং নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপের ওপর নজরদারি চালানোর মধ্য দিয়ে নাগরিক ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে শিক্ষিত হতে সাহায্য করা’৷

ঘোষিত উদ্দেশ্য মহৎ সন্দেহ নেই৷ কিন্তু আফ্রিকায় অত্যন্ত সক্রিয় এই আটলান্টিক কাউন্সিলকে অর্থ সাহায্য যারা দেয়, তাদের নামগুলি দেখলে ফেসবুকের মতলব নিয়ে সন্দেহ না হয়ে যায় না যে কারা সাহায্য করে আটলান্টিক কাউন্সিলকে? সাহায্যদাতাদের প্রকাশিত তালিকাতেই রয়েছে মার্কিন সামরিক সংস্থা পেন্টাগন, যুদ্ধজোট ন্যাটো, লকহিড মার্টিন সহ বেশ কয়েকটি অস্ত্র ব্যবসায়ী সংস্থা, এক্সন–মোবিলি ও অন্য কয়েকটি বহুজাতিক, ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা ও আরও কয়েকটি আর্থিক সংস্থা এবং রকিফেলার ও সোরোস ফাউন্ডেশনের মতো সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থবাহী সংগঠন৷

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্বাধীন ন্যাটোর সদস্য ৫টি ইউরোপীয় দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দুই সহযোগী দেশের সঙ্গে আফ্রিকার ১৬টি দেশকে যুক্ত করে ফেসবুকের এই নেটওয়ার্ক শুধু বৃহৎ ব্যবসায়ীদের মুনাফা লুটের সুবিধা করে দেবে তাই নয়, রাজনৈতিক ও রণকৌশলগত বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে৷ আটলান্টিক কাউন্সিলের ডিজিটাল গবেষণাগার প্রতি মুহূর্তে আফ্রিকার প্রচারমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে সুবিধাজনক খবর ও তথ্যগুলি প্রচার করার ব্যবস্থা করবে৷ হস্তক্ষেপ করবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এবং পছন্দসই সরকার গঠনে৷ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের যে সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য প্রতি মুহূর্তে সংগ্রহ করে এবং তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি চালায়, তা সাম্রাজ্যবাদ ও তার স্যাঙাতদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলি ভাঙতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে কাজে লাগানো যাবে৷ এইভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযোগী শক্তিগুলি আফ্রিকাকে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে শোষণ–নিয়ন্ত্রণের নতুন জালে জড়িয়ে ফেলবে৷ করোনা অতিমারি জনিত সংকটে গোটা দুনিয়া যখন ছটফট করছে, তখন ৩৭ হাজার কিলোমিটার লম্বা কেবল বিছিয়ে আফ্রিকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শোষণ–লুন্ঠন আরও জবরদস্ত করার ছক কষছে ফেসবুক৷

এই ফেসবুকই গত মে মাসে ভারতে রিলায়েন্স জিও–র সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ৫০ হাজার কোটি টাকা লগ্নি করেছে রিলায়েন্স জিও প্ল্যাটফর্মে৷ উদ্দেশ্য ভারতের কৃষিপণ্যের বাজারটির দখল নেওয়া৷ নিজেদের বিশাল নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে দেশের প্রান্ত প্রত্যন্তে পৌঁছবে তারা, সরাসরি ফসল কিনবে ছোট–বড় চাষিদের কাছ থেকে৷ রিলায়েন্স জিও আর ফেসবুকের সম্মিলিত পুঁজির সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো আর কেউ যে দেশে নেই, তা বলাই বাহুল্য৷ ফলে অচিরেই দেশের কৃষিপণ্যের বাজারে একচেটিয়া দখল কায়েম করবে তারা৷ ফসলের দাম একাই নিয়ন্ত্রণ করবে৷ ক্ষমতার রাজনীতির কারবারিরা যে এদের সামনে নতজানু হয়েই থাকবে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের তড়িঘড়ি কৃষিপণ্য আইনে পরিবর্তন ঘটিয়ে ইচ্ছে মতো মজুতদারিকে বৈধ করে দেওয়া দেখে৷ সব মিলিয়ে দেশীয় কর্পোরেট সংস্থা রিলায়েন্স জিও আর বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি যে আরও বড় মাপের লুটপাট চালানোর ছক কার্যকর করতে চলেছে ভারতেও, তা স্পষ্ট৷