সর্বাত্মক ধর্মঘটে অচল গোটা দেশ, সংগ্রাম জারি রাখার শপথে সোচ্চার মেহনতি মানুষ

কেরালা

২৬ নভেম্বর সন্ধ্যার পর গুটিকয় বাস আর ট্যাক্সি সারা দিন পর নেমেছে কলকাতার রাস্তায়। এ দিন দেশ জুড়ে খেটেখাওয়া মানুষ পালন করেছেন ধর্মঘট। কথা হচ্ছিল ওয়েলিংটন মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সি চালক পুষ্পেন্দ্র কুমারের সাথে। কেমন হল ধর্মঘট? জিজ্ঞাসা করতেই বলতে শুরু করলেন, ‘এ হরতাল হোনা চাহিয়ে থা’। তীব্র ভাষায় উগরে দিলেন ক্ষোভ। এই মোদি সরকার আমাদের সকলের রোজগার কেড়ে নিয়েছে। একটু ডাল-ভাত- সবজি খাব সে উপায়ও নেই। সব দাম আকাশছোঁয়া। আমি আজ সারাদিন গাড়ি বার করিনি, এই এখন একটু বেরিয়ে দাঁড়িয়েছি, রাস্তাঘাট দেখতে। এখনই ফিরে যাব। দুপুরে একই সুর শোনা গিয়েছিল চাঁদনিচক, তালতলা বাজার, কোলে মার্কেটের মুটিয়া মজদুর, হকার, ভ্যানচালকদের থেকে। এক দিনের রোজগার হারাতে ক্ষোভ নেই তাঁদের? প্রায় এক সুরে তাঁরা জবাব দিয়েছে, পুরো রোজগারটাই তো কেড়ে নিচ্ছে সরকার। এই একটা দিনের লোভ দেখিয়ে লড়াইকে দুর্বল করবে ওরা? তা হতে দেব না।

দেশ জুড়ে সর্বাত্মক স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সারা দেশের উৎপাদনের চাকা। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা জুড়ে খেটে-খাওয়া মানুষ উৎপাদনের চাকাকে স্তব্ধ করে দিলেন। খনি, ব্যাঙ্ক, বিমা, ভারি শিল্প, পরিবহণ, অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রেই ধর্মঘটে সামিল হয়েছিলেন কোটি কোটি শ্রমিক। দেশের প্রায় সব রাজ্যেই আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল প্রভৃতি স্কিম ওয়ার্কাররা সমস্ত হুমকি অস্বীকার করে ধর্মঘট পালন করেছেন। সারা দেশের শ্রমজীবী মানুষ সোচ্চার কণ্ঠে একচেটিয়া মালিকদের পদলেহী কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়ে দিলেন, এই সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে আমাদের শ্রমের ওপর ভর করে। মালিকের মুনাফার স্বার্থে আমাদের জীবনের ওপর একের পর এক নৃশংস আঘাত আমরা মেনে নেব না।

এ আই ইউ টি ইউ সি সহ ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলির ডাকা সারা ভারত ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছিল এস ইউ সি আই (সি)। এস ইউ সি আই (সি) দল এবং তার গণসংগঠনগুলি সক্রিয়ভাবে নেমেছিল ধর্মঘটের প্রচারে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চালিয়েছে নিবিড় প্রচার। গ্রামে শহরে গঞ্জে, কারখানার গেটে হয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট সভা। ২৬ নভেম্বর তাঁরা শ্রমিক কর্মচারীদের সাথেই সংগঠিত করেছেন পিকেটিং, রাস্তা অবরোধ, রেল রোকো। পশ্চিমবঙ্গে পিকেটিং এবং অবরোধ করতে গিয়ে ২০৫ জন এস ইউ সি আই (সি) কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশের আক্রমণে আহত ৩৬ জন। বিজেপি শাসিত আসামের শিলচরে ধর্মঘট করতে গিয়ে ২ হাজার বনধ সমর্থক গ্রেপ্তার হয়েছেন। ত্রিপুরায় ধর্মঘট এতটাই গভীর প্রভাব ফেলেছে যে ক্ষিপ্ত বিজেপি দুষ্কৃতীরা আগরতলার এস ইউ সি আই (সি) অফিসে হামলা চালিয়েছে। হামলায় আহত হয়েছেন দুজন পার্টি কর্মী। সিটু এবং সিপিআই অফিসেও তারা হামলা করেছে। দিল্লিতে ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিল করতেই বাধা দেয় পুলিশ। দীর্ঘক্ষণ রেল আটকে থেকেছে, রাস্তা বন্ধ হয়েছে। ধর্মঘটের প্রতি তবু সমর্থন জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। কারণ তাঁরা মনে করেছেন পিঠ যখন দেওয়ালে ঠেকে যায়, ঘুরে দাঁড়াতে হলে প্রতিপক্ষকে দিতে হয় তীব্র আঘাত, যে আঘাত হল সর্বাত্মক ঘর্মঘট।

কেন এই ধর্মঘট? করোনা অতিমারিতে বিপর্যস্ত দেশ। জীবিকা খুইয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। ব্যবসাপত্রে নিদারুণ মন্দার ছায়া। বন্ধ অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা। রোগ সংক্রমণের হার কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দেশের মানুষের এই চরম দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে পুঁজিপতি শ্রেণির ধূর্ত ও কৌশলী রাজনৈতিক ম্যানেজার কেন্দে্রর বিজেপি সরকার ঠিক এই সময়টাকেই বেছে নিয়েছে তাদের ওপর মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, অতিরিক্ত কাজের বোঝা, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তির বেসরকারিকরণের মতো জনস্বার্থবিরোধী কার্যক্রম চাপিয়ে দেওয়ার জন্য। পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করে তুষ্ট করে চলেছে দেশের পুঁজিপতি-শিল্পপতিদের। এই চরম জনবিরোধী সরকারের সর্বনাশা নীতিগুলির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া মেহনতি বাঁচার পথ কোথায়!

এই দুঃসময়়ের সুযোগে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার র়াষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে বেসরকারি পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার পুরনো ষড়যন্ত্র কার্যকর করছে। রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা, বিদ্যুৎ, তৈলক্ষেত্র, বিমান, খনি ইত্যাদি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে একে একে পুঁজিমালিকদের কাছে বেচে দেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে। মুনাফা-লুটেরা মালিকরা এবার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রমিকদের অর্জিত অধিকারগুলি ছিনিয়ে নেবে। বেকার সমস্যা নেবে আরও ভয়ঙ্কর রূপ। চাকরির নিরাপত্তা বলে আর কিছু থাকবে না।

মানুষের মতামতের তোয়াক্কা না করে, সংসদীয় রীতিনীতিকে দু’পায়ে মাড়িয়ে মোদি সরকার পাশ করিয়ে নিয়েছে ভয়ঙ্কর কৃষি আইন। কৃষিক্ষেত্রকে তুলে দিয়েছে কৃষিপণ্যের একচেটিয়া মালিকদের হাতের মুঠোয়। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের অবাধ মজুতদারির সুযোগ ও যথেচ্ছ দাম বাড়াবার অধিকার দিয়েছে মজুতদার-কালোবাজারিদের।

শ্রম আইনগুলিকে পাল্টে মোদি সরকার অবাধ ছাঁটাইয়ের অধিকার তুলে দিয়েছে মালিকদের হাতে। কাজের সময় আট ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা করতে চলেছে। সরকারি দপ্তরেও তিন মাসের নোটিশে কর্মীদের ছাঁটাই করা যাবে। মালিকদের স্বার্থে যারা এত দ্রুত এই আইনগুলিকে পাস করিয়ে দিল, সেই বিজেপি সরকারই কিন্তু এতগুলি বছরে কোটি কোটি অসংগঠিত শ্রমিকের নূ্যনতম মজুরিটুকুও নিশ্চিত কর়েনি। নিশ্চিত করেনি দেশের সমস্ত মানুষের দু’বেলা অন্ন, কিংবা রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার।

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ এনে মালিকদের অবাধ মুনাফা লুটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে মোদি সরকার। ফলে লেখাপড়া শেখার চড়া দাম মেটাতে না পেরে শিক্ষার আঙিনা থেকে ক্রমে আরও দূরে সরে যাবে গরিব, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা।

এই সব সর্বনাশা আইন বাতিলে সরকারকে বাধ্য করার একমাত্র রাস্তা ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী, লাগাতার গণআন্দোলন। সেই পথেই এসেছে ২৬ নভেম্বরের ধর্মঘট। সর্বশক্তি উজাড় করে ঘাম-ঝরানো শ্রমে উৎপাদনের চাকা ঘুরিয়ে দেশকে সচল রাখেন যাঁরা, এদিন সর্বশক্তি উজাড় করেই তাঁরা স্তব্ধ করে দিয়েছেন সেই চাকা।

এই ধর্মঘট দেখিয়ে দিল, বিজেপি সরকারকে জনবিরোধী নীতি প্রত্যাহারে বাধ্য করতে পারে একমাত্র ঐক্যবদ্ধ বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলন। আরও দেখাল, নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন কোনও বিকল্প নয়। শক্তিশালী গণআন্দোলনই একমাত্র বিকল্প। ধর্মঘটের এই সাফল্যের উপর দাঁড়িয়েই আন্দোলনকে আরও বৃহত্তর রূপে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের শক্তিশালী গণকমিটি আজ জরুরি।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১১ সংখ্যা_২৭ নভেম্বর, ২০২০)

স্বরূপনগর, উত্তর ২৪ পরগণা
পূর্ব মেদিনীপুর
কলকাতা
জয়নগর
কোচবিহার
বাঁকুড়া
বহড়ু
তামিলনাড়ু
গুনা, মধ্যপ্রদেশ
ভূবনেশ্বর, উড়িষ্যা
মুজফ্ফরপুর
উত্তর প্রদেশ
মাদুরাই
কেরালা
কর্ণাটক
জামশেদপুর
গোয়ালিয়র
দিল্লি
বাঙ্গালোর
অন্ধ্রপ্রদেশ