সরকার ও তেল কোম্পানিগুলি দেশবাসীকে অবাধে লুঠ করছে : পেট্রল-ডিজেলের দামে রেকর্ড বৃদ্ধি

পেট্রল–ডিজেলের দামের ঊর্ধ্বগতি প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার ভোজবাজিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷  এটা শুধু দাম বৃদ্ধি নয়, দেশবাসীকে  অবাধে  লুঠতরাজ৷ এই লুঠতরাজ চালাচ্ছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার৷ 

২০ মে ডিজেলের দাম সর্বকালীন রেকর্ড ছাড়িয়ে হয়েছে ৭০.১২ টাকা, আর পেট্রল ৭৯.৯১ টাকা৷ গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন দাম বাড়ছে৷ এর পরেও প্রতিদিন দাম বাড়তেই থাকবে৷ এই দাম বৃদ্ধির পিছনে খাড়া করা হয়েছে বস্তাপচা দু’টি অজুহাত৷ প্রথমটি, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির গল্প, আর দ্বিতীয়টি, ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়ে যাওয়া৷ অথচ, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি, যারা তেল আমদানি–নির্ভর, সেই দেশগুলিতে এখনও তেলের দাম ভারতের তুলনায় অনেক কম৷ ১৪ মে ২০১৮–তে যেখানে ডলারের হিসাবে (১ ডলার = ৬৮ টাকা) ডিজেলের দাম মায়ানমারে ০.৬৪, শ্রীলঙ্কায় ০.৬৯, বাংলাদেশে ০.৭৭, নেপালে ০.৮৩, পাকিস্তানে ০.৮৫ ডলার, সেখানে ভারতে তার দাম ১.০১ ডলার৷ আর টাকার দামে পতনের জন্য তো জনসাধারণ দায়ী নয়, তার দায় মোদি সরকারের৷ টাকার দামে পতনের সুফল আত্মসাৎ করছে শিল্পপতিরা রপ্তানিতে সুবিধা নিতে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এদেশের শেয়ার বাজারে ও অন্যত্র বিনিয়োগ করতে৷ আর তার কুফলের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তেলের দাম বৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের উপর৷

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির যে অজুহাত তোলা হচ্ছে তা একটি ধাপ্পা৷ পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের ধারাবাহিকতায় মোদি সরকার ক্ষমতায় এসে বলেছিল আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ওঠাপড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এদেশে তেলের দাম ওঠানামা করবে৷ এর গালভরা নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ট্রেড প্যারিটি প্রাইসিং মেথডলজি’৷ তখন এর উদ্দেশ্য ছিল তেলের জন্য আর কোনও রকম ভরতুকি না দেওয়া৷ কারণ, সরকারি কর্তারা তখন ধরেই নিয়েছিলেন যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তেই থাকবে এবং তার আর্থিক দায় পুরোটাই জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে৷ কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমতেই থাকে৷ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তেলমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের রাজ্যসভার বয়ান অনুযায়ী, ২০১৪–র যে মাসে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় বসেন, সেই মাসে তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ১০৬.৮৫ ডলার৷ আর তা কমতে কমতে ২০১৬–র ফেব্রুয়ারি মাসে দাঁড়ায়২৯.৮০ ডলারে৷ প্রাইস প্যারিটিকে নীতি হিসাবে ধরলে যেদিন মোদি ক্ষমতায় বসেছিলেন সেদিন পেট্রলের দাম ৭১.৪১ টাকা হলে যখন তেলের দাম কমে ২৯.৮০ ডলার হয়েছিল তখন নানা রকম ট্যাক্স সহ পেড্রলের দাম হওয়া উচিত ছিল ৩০.০০ টাকার মতো৷ অথচ মোদি সরকার দাম বেঁধে দিল ৫৯.৯৫ টাকায়৷ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৬৬ শতাংশ কমলেও এদেশে দাম কমানো হল মাত্র ১৬ শতাংশ৷ মূল্যহ্রাসের কোনও সুফল জনসাধারণকে না দিয়ে বিপুল হারে এক্সাইজ ডিডটি ও সেন্ট্রাল ট্যাক্স বাড়িয়ে বিশাল পরিমাণে টাকা আত্মসাৎ করল  সরকার৷ মোদি ক্ষমতায় আসার সময় পেট্রলের উপর লিটার প্রতি যে এক্সাইজ ডিডটি ছিল ৯.৪৮ টাকা, তা বাড়াতে বাড়াতে করা হল ২১.৪৮ টাকা৷ ডিজেলে লিটার প্রতি এক্সাইজ ডিডটি ৩.৫৬ টাকা থেকে বাড়ানো হল ১৭.৩৩ টাকা, (তথ্য : the times of india.indiatimes.com/business)৷ এর সাথে সেলস ট্যাক্স, এন্ট্রি ট্যাক্স, ভ্যাট ও পলিডশন সেস মিলিয়ে বিভিন্ন রাজ্য সরকার ২০ থেকে ৩৭ শতাংশ ট্যাক্স আদায় করছে৷ তাহলে কোথায় গেল তাদের সাধের ‘ট্রেড প্যারিটি প্রাইসিং মেথডলজি’? এ কি দেশের মানুষকে অবাধে লুট করা নয়?

পেট্রল–ডিজেল নিয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের লুটপাট, প্রতারণা ও ধাপ্পার এখানেই শেষ নয়৷ সম্প্রতি কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে সুবিধা দিতে কোনও নোটিস না দিয়েই ১৯ দিনের জন্য আন্তর্জাতিক দামের সাথে প্রাইজ প্যারিটি স্থগিত করে দেওয়া হল৷ যেই নির্বাচন পর্ব শেষ হল, আবার প্রাইজ প্যারিটি চালু হয়ে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে এবং ২০ মে  তা রেকর্ড করে পেড্রল ৭৮.৯১ টাকা এবং ডিজেল ৭০.১২ টাকায় পৌঁছেছে৷ কিন্তু যে ১৯ দিন দাম বাড়েনি, সেই ক’দিনের জন্য কি সাধারণ মানুষ কোনও সুবিধা পেয়েছে? না, সে–গুড়েও বালি সংবাদে প্রকাশ, ‘কোটাক ইনস্টিটিডশনাল ইকুইটিজ’–এর দাবি ওই ১৯ দিন তেলের দাম এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকায় তেল সংস্থাগুলির গড় লাভ লিটারে ৫০–৭০ পয়সায় নেমে এসেছিল৷ সংস্থাগুলি সাধারণভাবে লাভ করে লিটারে ২.৭০ টাকা৷ এই সময়ে নাকি সংস্থাগুলির ৫০০ কোটি টাকা লাভ কম হয়েছে৷ এখন কোম্পানিগুলি সেই ৫০০ কোটি টাকা তুলতে চাইছে ডিজেলে সাড়ে তিন থেকে চার টাকা এবং পেট্রলে চার থেকে সাড়ে চার টাকা দাম বাড়িয়ে৷ 

যখন ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেলে ১০৬.৮৫ ডলার ছিল তখন যদি পেট্রলের দাম হয় প্রতি লিটার ৭১.৪১ টাকা, তাহলে আজ সেই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৭ ডলার কম হওয়া সত্ত্বেও অর্থাৎ তেলের দাম ব্যারেলে ৮০ ডলারের কাছাকাছি যেতেই পেট্রলের দাম লিটার প্রতি ৮০ টাকা হয় কোন হিসাবে?

এখন সরকারি ক্ষমতায় আসীন দলগুলি এতটাই নির্লজ্জ, যখন দেশে কোনও রকম রাজনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির ঘটনা ঘটে, জনসাধারণের দৃষ্টি সেই দিকে থাকার সুযোগে তখনই তাদের উপর তীব্র আর্থিক আক্রমণ নামিয়ে আনছে৷ রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, বা যে কোনও ধরনের সামাজিক অস্থিরতার সময়কেও পুঁজিপতিরা মানুষের উপর তাদের  শোষণকে তীব্র করে ভোটবাজ দলগুলির কাজে  লাগাচ্ছে৷

দেডলিয়া রাজনীতির চেহারা দেখে তার প্রতিক্রিয়ায় জনসাধারণের মধ্যে অরাজনৈতিক মনোভাব, সামাজিক–রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ গ্রহণে অনীহা  শাসকদের আরও বেশি সুবিধা করে দিচ্ছে এই আক্রমণ শানাতে৷ আর সেই আক্রমণেই মানুষ আরও বেশি দিশেহারা হয়ে পড়েছে৷ অর্থাৎ শাসক শ্রেণির দলগুলিকে সঠিকভাবে চিনতে না পেরে যেমন প্রতারিত হচ্ছে, তেমনি তা প্রতিরোধ করতে না পেরে আরও কঠিন আর্থিক আক্রমণের মুখে পড়ছে৷ জনসাধারণকে বুঝতে হবে যত দিন যাবে ততই এই আক্রমণ আরও বাড়তে থাকবে৷

তেলের এই দামবৃদ্ধি জনজীবনের উপর মারাত্মক আক্রমণ নামিয়ে আনবে৷ পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহ প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়বে, গণপরিবহণের ভাড়া বাড়বে, যা সংকটজর্জরিত জনগণের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে৷ ইতিমধ্যেই এ রাজ্যে পরিবহণে ভাড়া বাড়ানোর দাবি উঠেছে৷ এই আক্রমণকে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করার জন্য জণগণকে এগিয়ে আসতে হবে৷ দাবি তুলতে হবে কর্পোরেটের মুনাফা কমিয়ে তেলের দাম কমাও৷

(৭০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা ২৫ মে, ২০১৮)