সম্পদ উপচে পড়া আমেরিকাতেও লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন

কনকনে শীতের রাতেও খোলা রাস্তাই আস্তানা প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ মানুষের৷ না, এ দেশে নয়৷ ভারতে এ দৃশ্য তো অতি পরিচিত৷ এ ঘটনা আর্থিক সম্পদে বিশ্বের ‘সুপার পাওয়ার’ আমেরিকার ভাবতে আশ্চর্য লাগে, তাই না?

২০১৬ সালে মার্কিন সরকারি দপ্তর ঘরহারা মানুষের এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে৷ বাস্তবে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা সেখানে আরও অনেক বেশি৷ নিজের ঘর না থাকার কারণে যাঁরা আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু–বান্ধবের বাসায় রাত কাটান, কিংবা থাকার জন্য কোনও হোস্টেল খুঁজে নেন বা যা হোক করে মাথার ওপরে অস্থায়ী হলেও একটা ছাদ জুটিয়ে নেন, তাঁদের হিসাবের মধ্যে ধরে না সরকারি ফাইল৷ গত বছরের এক হিসাবে শুধু শিকাগো শহরে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৮২ হাজার৷ লস এঞ্জেলেসের মতো প্রাচুর্যে ঝলমল শহরে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা কত জানেন? ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭–র ‘লস এঞ্জেলেস টাইম’–এর রিপোর্ট অনুযায়ী– ৫৭ হাজারেরও বেশি সমস্ত বড় শহরেরই এই হাল৷ ঝাঁ–চকচকে হাইরাইজ বিল্ডিং, চোখ–ধাঁধাঁনো শপিং মল আর উড়ালপুলে সাজানো আলোয় আলোময় মার্কিন শহরগুলির রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গেলেই অন্ধকারে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা এইসব ঘরহারা ছন্নছাড়া মানুষের দিকে চোখ পড়ে যাবে আপনার৷ মানুষের সঙ্গে মানুষের বীভৎস বৈষম্যের কুৎসিত চেহারা নজর এড়াতে পারবে না৷

প্রবল গরম অথবা প্রচণ্ড শীতের দাপট সহ্য করার পাশাপাশি গৃহহীন এই মানুষগুলিকে প্রতিমুহূর্তে মুখোমুখি হতে হয় পুলিশের হামলা কিংবা বিকৃতরুচি অপরাধমনস্ক্দের হাতে যৌন হেনস্তার৷ টিবি, হেপাটাইটিস, এইডসের মতো ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপও এদের মধ্যে বেশি৷ গত বছর দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় ঘরহারা মানুষদের মধ্যে মহামারির মতো ছড়িয়েছিল হেপাটাইটিস–এ রোগ৷ সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের গড় আয়ু যেখানে ৭৮ বছর, সেখানে পথবাসী এই মানুষগুলি গড়ে মেরেকেটে বাঁচে ৪৭ বছর বয়স পর্যন্ত৷

আমেরিকার মতো প্রাচুর্যের দেশে কেন এত মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই? সংসদীয় রাজনীতির নেতারা– ভোটের আগে গালভরা প্রতিশ্রুতি বিলানোই যাঁদের প্রধান কাজ, এবং তাঁদেরই তল্পিবাহক প্রচারমাধ্যম হতভাগ্য গৃহহীন মানুষগুলিরই ঘাড়ে এর দোষ চাপাতে চায়৷ এরা নাকি অলস, রোজগারপাতি করে নিজের ঘর বানিয়ে নেওয়ার মতো উদ্যমই নাকি নেই এদের৷ কথাগুলি দু–একজনের ক্ষেত্রে খাটলেও মোটের ওপর একেবারেই সত্য নয়৷ বাস্তবে মার্কিন ঘরহারাদের অধিকাংশেরই আর্থিক সামর্থ্য নেই মাথার ওপরে একটা ছাদের বন্দোবস্ত করার৷ পথবাসী এইসব মানুষের একটা বড় অংশ কল–কারখানা থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক–কর্মচারী৷ বাড়তে থাকা ঘরভাড়া জোগাবার ক্ষমতা নেই এঁদের৷ আবার কাজকর্ম করেন এমন বহু মানুষও রাস্তায় থাকতে বাধ্য হন৷ ভাবছেন, কেন? আসলে মজুরি তাঁদের এত কম যে বাড়ি বানিয়ে ফেলা দূর অস্ত, একটা ঘর ভাড়া নেওয়ারও উপায় থাকে না৷ আশ্চর্যের হলেও এ কথা দিনের আলোর মতো সত্য যে, সম্পদ উপছে পড়া এই আমেরিকায় শ্রমিক–কর্মচারীদের রোজগার, মাথা গোঁজার ছোটখাটো একটা ঠাঁই জোটানোর জন্য যথেষ্ট নয় অথচ এদেরই কঠোর মেহনতের ফল হিসাবে বিপুল সম্পদ জমা হচ্ছে মার্কিন ধনপতিদের সিন্দুকে৷ ‘ন্যাশনাল লো–ইনকাম হাউজিং কোয়ালিশন’–এর ২০১৭ সালের এক সমীক্ষা দেখাচ্ছে, আমেরিকায় পূর্ণ সময়ের কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি যা, তাতে কোনও বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা অথবা ভাড়া নেওয়া সম্ভব হয় না৷ খোদ আমেরিকার নাগরিক শ্রমিক–কর্মচারীদের্ যদি এই দুরবস্থা হয়, তাহলে অভিবাসী মানুষদের হাল কী, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ আগে সমাজকল্যাণমূলক খাতে মার্কিন সরকার যে টাকা খরচ করত, ক্রমেই তার পরিমাণ কমছে৷ ফলে ক্রমশ অদৃশ্য হচ্ছে কম খরচে থাকার জায়গাগুলি৷ বেড়ে চলেছে গৃহহীনতা৷

অথচ সরকারের কাছে খরচ করার মতো অর্থ নেই, তা নয়৷ যে মার্কিন সরকার সামরিক খাতে ৭০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় করার সামর্থ্য রাখে, দেশের মানুষের জন্য সস্তায় বাড়ি বানানোর ক্ষমতা তার নেই– এ কথা বিশ্বাস করা যায় কি? আসলে সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি আমেরিকা নাগরিকদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করাটাকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলেই মনে করে না৷ কোনও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই তা মনে করে না৷ তার একমাত্র দায় পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করা৷ তাই পৃথিবীর যেখানেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে, সেখানেই গৃহহীনতার সমস্যা কমবেশি রয়েছে৷ কারণ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে ঘরবাড়িকে মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন হিসাবে দেখা হয় না৷ পুঁজিবাদী দৃষ্টিতে মাথা গোঁজার আশ্রয়ও হল ব্যবসার একটি পণ্য, যা থেকে মুনাফা লোটা যায়৷ দেশের খেটে–খাওয়া মানুষের জন্য থাকার জায়গার ব্যবস্থা করার দ্বারা তো মুনাফা লোটার বিশেষ সুযোগ মেলে না ফলে ’৯০–এর দশক থেকে মার্কিন সরকার জায়গাগুলিকে ক্রমাগত বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছে৷ দেখা যাচ্ছে৷ সেসব জায়গায় প্রমোটাররা বানিয়ে চলেছে একের পর এক বিলাসবহুল বাংলো, যেগুলি বিপুল দামে বিক্রি করা হচ্ছে সম্পদশালীদের কাছে৷ ফলে কোটি কোটি ডলার দামের চোখ–ধাঁধাঁনো প্রাসাদের অভাব না থাকলেও বিশ্বের আর পাঁচটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মতোই, সম্পদ ও অস্ত্রের শক্তিতে বলীয়ান ‘পুঁজিবাদের স্বর্গরাজ্য’ আমেরিকাতেও মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলে না লক্ষ্য লক্ষ্য সাধারণ মানুষের!

(৭০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৭জুন, ২০১৮)