নারোডা গাম হত্যাকাণ্ডঃ সবাই যদি নির্দোষ তবে হত্যাকারী কারা

চোখের সামনে ১১ জন প্রতিবেশীকে পুড়ে মরতে দেখা ইমতিয়াজ কুরেশি, শরিফ মালেক কিংবা আবিদ পাঠানরা অভিযুক্তদের শাস্তির মরিয়া আশায় বুক বেঁধে ছিলেন। কিন্তু ২০ এপ্রিল গুজরাটের বিশেষ আদালত যেভাবে নারোডা গাম মামলার অভিযুক্ত ৬৮ জন হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাকারীকে বেকসুর খালাস করে দিল, তাতে তাঁদের সেই আশা শূন্যে মিলিয়ে গেছে। যদিও বহুঘোষিত এই ‘স্বাধীনতার অমৃতকালে’ বার বারই যে ভাবে ক্ষমতাসীন শাসককে ন্যায়বিচারের গলা টিপে ধরতে দেখা যাচ্ছে, তাতে এই রায়ে দেশের মানুষ অবাক হননি। গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত মামলার পরিণতি দেখে, বিশেষ করে বিলকিস বানো মামলায় দণ্ডিত ১১ জন গণধর্ষণকারী খুনিকে মহা-সমারোহে মুক্তিদানের ঘটনার পর এ কথা সকলের কাছেই যেন পরিষ্কার যে, ক্ষমতাবান শাসকের মুঠোয় ন্যায়বিচার আজ বন্দি। নারোডা গাম মামলার রায় সেই ধারণাতেই আরও একবার সিলমোহর দিল।

২০০২ সালে গুজরাট যখন সংখ্যালঘু মানুষের রক্তে ভাসছে, সেই সময় আমেদাবাদ শহরের মুসলিম অধ্যুষিত নারোডা গাম এলাকায় নির্মম গণহত্যা সংঘটিত করেছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজরা। গোধরায় ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর ২৮ ফেব্রুয়ারি গুজরাট জুড়ে যখন বনধ চলছে, সেই সময় এই দাঙ্গাবাজরা জড়ো হয়েছিল নারোডা গামের বাজার এলাকায়। প্রত্যক্ষদর্শী আক্রান্তদের দাবি, বিজেপি সহ উগ্র হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠনের নেতারা সেখানে উত্তেজক ঘৃণা-ভাষণ দিয়ে এলাকায় লুটপাট ও গণহত্যা চালাতে উস্কানি দেয়। তার পরেই শুরু হয়ে যায় উন্মত্ত তাণ্ডব। ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে খুন করা হয় ১১ জন মানুষকে। ১০০ মিটার দূরেই নারোডা থানা। কিন্তু সেদিন সারা দিন পুলিশের দেখা পাননি আক্রান্ত আতঙ্কিত বাসিন্দারা।

সুপ্রিম কোর্ট গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) কুখ্যাত গুজরাট গণহত্যার ভয়ঙ্করতম যে ৯টি ঘটনার তদন্ত করে, নারোডা গাম তার অন্যতম। তদন্তে ৮৬জন অভিযুক্ত হন, যাঁদের অন্যতম হলেন প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক, পরবর্তীকালে গুজরাটে বিজেপি সরকারের মন্ত্রী মায়া কোদনানি, বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গী, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা জয়দীপ প্যাটেল, নারোডা থানার তৎকালীন পুলিশ ইন্সপেক্টর ভিএস গোহিল প্রমুখ। ২০১০ সালে গুজরাটে বিশেষ আদালতে মামলা শুরু হয়। ইতিমধ্যে গুজরাট গণহত্যা সংক্রান্ত আরও একটি মামলায় ২০১২ সালে কোদনানি ও বজরঙ্গীর কারাদণ্ড হয়। কোদনানিকে ২৮ বছর কারাবাসের নির্দেশ দেয় বিশেষ আদালত। কিন্তু কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৮ সালে গুজরাট হাইকোর্ট ‘বেনিফিট অফ ডাউট’-এ তাঁকে মুক্তি দিয়ে দেয়। কোদনানির পক্ষে সাক্ষ্য দেন বিজেপির তৎকালীন জাতীয় সভাপতি স্বয়ং অমিত শাহ। এবার নারোডা গাম মামলাতেও বিশেষ আদালত খালাস করে দিল কোদনানিকে।

২০১০-এ বিশেষ আদালতে নারোডা গাম মামলা শুরু হওয়ার পর গত ১৩ বছরে একটি দিনের জন্যও আদালতে শুনানিতে হাজিরা দেওয়া বন্ধ করেননি মামলার সাক্ষী ইমতিয়াজ কুরেশি, শরিফ মালেকরা। মামলা চলতে চলতেই মারা গেছেন ১৮ জন অভিযুক্ত। গত ২০ এপ্রিল রায় ঘোষণার দিন নিরাপত্তার কারণে পুলিশ কুরেশিদের আদালত-কক্ষে বসতে দেয়নি। বাইরে বসেই আদালতের ভিতর থেকে আসা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের উল্লাসধ্বনি কানে যেতে তাঁরা বুঝতে পারেন, রায় তাঁদের পক্ষে যায়নি। ভেবেছিলেন, কোদনানি, প্যাটেল বা বজরঙ্গির মতো রাঘব-বোয়ালরা যদি রেহাই পেয়েও যান, অন্তত অন্য অভিযুক্তদের শাস্তি হবে। কিন্তু আদালত যেভাবে সমস্ত অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দিল, তাতে তাঁদের বুক ভেঙে গেছে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, তা হলে ২০০২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি নারোডা গামের ১১ জন বাসিন্দা মারা গেলেন কী ভাবে? তাঁরা কি তাহলে নিজেরাই নিজেদের পুড়িয়ে মেরেছিলেন!

এই মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী ১৮২ জন সাক্ষীর অন্যতম ইমতিয়াজ কুরেশি সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ‘‘আমি নিজে ১৭ জন অভিযুক্তকে চিহ্নিত করেছিলাম। এঁদের মধ্যে ছিলেন ভিএইচপি নেতা ও পৌরসভার তৎকালীন দুই সদস্য। আমি দেখেছি তাঁরা বাজারের ভিড়ের সামনে উত্তেজক ভাষণে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন, মসজিদ পুড়িয়ে দিতে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিতে উস্কানি দিচ্ছেন। আমি দেখেছি, পরিবারের সমস্ত মানুষকে পুড়িয়ে মেরে দিতে– আমার চোখের সামনে পাঁচজনকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হল– আমি তাদের চিনতাম। খুনিদের জামার রঙ পর্যন্ত আমার মনে আছে। আদালতের সামনে আমি সমস্ত প্রমাণ তুলে ধরেছি।” কুরেশি বলেছেন, ‘‘এই অপরাধীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হওয়া উচিত ছিল। তার বদলে এমন রায়ে বিচারব্যবস্থার উপরে আমাদের বিশ্বাসই তো উঠে যেতে বসেছে! আমাদের কাছে এ হল একটা কালা-দিবস।”

আরও এক সাক্ষী শরিফ মালেক, যিনি মায়া কোদনানি ও জয়দীপ প্যাটেল সহ ১৩ জন অভিযুক্তকে আদালতে চিহ্নিত করে বয়ান দিয়েছিলেন, সংবাদমাধ্যমের সামনে মন্তব্য করেছেন, ‘‘এই রায় ইঙ্গিত করছে যে, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় যারা সন্ত্রাস চালাবে, তাদের গায়ে কেউ হাত ছোঁয়াতে পারবে না। দেশের সমস্ত মানুষের কাছেই এই রায় পরোক্ষে একটা বার্তা পৌঁছে দিল।” তিনিও মন্তব্য করেন, ‘‘এই রায়ে বিচারব্যবস্থার উপরে আমাদের আস্থা কমে গেল এবং এই ব্যবস্থার অন্যায় নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল।”

এই মামলায় আক্রান্তদের পক্ষের আইনজীবী শমশাদ পাঠান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘কোদনানি ও প্যাটেল যে সেদিন দাঙ্গাকারীদের গণহত্যায় প্ররোচিত করেছিলেন, তার রাশি রাশি প্রমাণ ও সাক্ষী আছে। শুধু তাই নয়, মোবাইল টাওয়ারের রেকর্ড থেকেও পরিষ্কার যে, ঘটনার দিন গণহত্যার সময়ে প্যাটেল ও কোদনানি নারোডা গামেই ছিলেন।”

অর্থাৎ নারোডা গামে ১১ জন সংখ্যালঘুর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা সত্য ছিল। তা নিয়ে সিটের তদন্তে অভিযুক্তদের নাম প্রমাণ সহ উঠে এসেছিল। বিশেষ আদালতে মামলা ওঠার পর প্রায় দুশো জন প্রত্যক্ষদর্শী সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছিলেন যা সিটের রিপোর্টের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও কোনও অভিযুক্তের কোনও শাস্তি হল না–যেন গোটা বিষয়টা বাস্তব সত্যই নয়, মরীচিকা মাত্র।

নারোডা গাম মামলা নিয়ে দেশ জুড়ে ধিক্কারে ফেটে পড়েছে মানুষ। এ তো শুধু ন্যায়বিচারের কণ্ঠরোধ নয়, দেশের বিবেকবান শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের আবেগ নিয়ে, বিচারব্যবস্থার উপর তাদের আস্থা-ভরসা যতটুকু আছে তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা! এ জিনিস চলতে দিলে গোটা দেশ অচিরেই ভরে উঠবে রক্তপিপাসু অত্যাচারীর নিষ্ঠুর জয়োল্লাসে, যার নিচে চাপা পড়বে আক্রান্ত, বঞ্চিত অসহায় মানুষের আর্তনাদ।

তাই প্রশ্ন উঠছে সর্বত্র। কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি আসীন হওয়ার পর থেকে যে সাম্প্রদায়িকতাবাদী, স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক শাসনের দাঁত-নখ ক্রমশ আরও বেশি করে প্রকট হচ্ছে, তাতে গোটা দেশ জুড়েই প্রশ্ন তুলছেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ। তাঁরা সরকার ও বিচারব্যবস্থার অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। গণতন্ত্র রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন দেশের মানুষকে। লড়াইয়ের পথ ছাড়তে রাজি নন নারোডা গামের আক্রান্ত মানুষও। শরিফ মালেক সংবাদমাধ্যমের কাছে মন্তব্য করেছেন, ‘‘ন্যায়বিচারের জন্য আমরা ২১ বছর ধরে লড়াই করে চলেছি। উচ্চ আদালতে এই মামলা নিয়ে যাব আমরা। সন্তানদের মুখ চেয়ে ২০০২-এর গণহত্যায় আক্রান্তদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এ আমাদের করতেই হবে।”

লড়াকু এই ন্যায়বিচারপ্রার্থীদের পাশে দাঁড়াতে হবে দেশের গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন সর্বস্তরের মানুষকে। আদালতে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন শাসকের ন্যায়বিচারকে মুঠোয় পোরার অন্যায় বাসনা প্রতিহত করতে গণআন্দোলনের চাপ সৃষ্টি করতে হবে স্বৈরাচারী সরকারের উপর।

(তথ্যসূত্রঃ ২১ এপ্রিল ‘২৩-এর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, আউটলুক, দি ফেডেরাল)