সত্যপাল সিং ও ডারউইনের তত্ত্ব

একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির যুগে আজও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ নানা রকম কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন৷ এর কারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী মানসিকতা বা বিজ্ঞানমনস্কতা না থাকা৷ অত্যন্ত দুঃখের হলেও একথা সত্য যে, শুধু অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত নয়, উচ্চশিক্ষিত মানুষ এমনকী বিজ্ঞানে উচ্চ ডিগ্রিধারীরাও অনেকে নানা ধরনের কুসংস্কারে ও অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস করেন৷ বিজ্ঞানে যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন করলেও একজন মানুষ সব সময় যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানমনস্ক্ নাও হতে পারেন৷ এর অন্যতম প্রধান কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের কিছু তত্ত্ব ও তথ্য শেখানো হয়, বিজ্ঞানের মর্মবস্তু যে যুক্তিবাদ, তা শেখানোর বিশেষ সুযোগ নেই৷

 ২০১৪ সালে কেন্দ্রে এনডিএ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বিজেপি পরিচালিত সরকার ও তাদের  মতাদর্শগত পথপ্রদর্শক আরএসএস দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উপর নানাবিধ আক্রমণ নামিয়ে আনছে৷ ভারতীয়করণের নামে শিক্ষাব্যবস্থাকে তারা এমনভাবে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছে যাতে ছাত্রছাত্রীদের যুক্তিবাদী মন গডে উঠতে না পারে৷ বিজেপি পরিচালিত গুজরাট এবং আরও কয়েকটি রাজ্যে স্কুলের ছাত্রদের শেখানো হচ্ছে এরোপ্লেন, টেলিভিশন ও পরমাণু বোমার উদ্ভব হয়েছিল রামায়ণ ও মহাভারতের যুগে, সে সময় স্টেম সেল গবেষণা হয়েছিল ইত্যাদি৷ এমনকী প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, গণেশের হাতির মাথা প্রমাণ করে প্রাচীন ভারতে প্লাস্টিক সার্জারি ছিল৷ তবে এতদিন পর্যন্ত বিজেপি ও সংঘ পরিবারের কেউ কোনও প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে প্রকাশ্যে ভুল বলতে সাহস করেননি, যা সম্প্রতি করেছেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং৷ এতদিন বিজেপি ও সংঘ পরিবারের ভাবধারায় বিশ্বাসীরা জোরের সঙ্গে দাবি করে এসেছে যে পুরাণ–উপনিষদ–রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী ঐতিহাসিক সত্য৷

কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে সর্বভারতীয় বৈদিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে গত ১৯ জানুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিক দিক থেকে ভুল৷ তিনি আরও বলেছেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা কেউ মৌখিক বা লিখিতভাবে বানরের মানুষে পরিণত হওয়ার কথা উল্লেখ করে যাননি৷ তাঁদের কেউ বলেননি যে ডারউইন জঙ্গলে গিয়ে বানর থেকে মানুষে রূপান্তর দেখেছিলেন৷ তিনি আরও বলেছেন, শুরু থেকেই মানুষ পৃথিবীতে মানুষ হিসাবেই এসেছে৷ তাই স্কুল–কলেজের পাঠ্যসূচিতে এই তত্ত্ব পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে৷ উল্লেখ্য, ডারউইন তাঁর বিবর্তন তত্ত্বে কোথাও বলেননি যে বানর মানুষে পরিণত হয়েছে৷ বিবর্তনের পথেই মানুষ এসেছে৷ এমন নয় যে মন্ত্রীমশাই একজন অশিক্ষিত রাজনীতিবিদ৷ তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন এবং রসায়নবিদ্যায় এম ফিল করেছিলেন৷ ডারউইনের বিবর্তনবাদ যে বিশ্বে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত সে কথা তিনি জানেন না – একথা মনে করার কোনও কারণ নেই৷ তাই তাঁর মন্তব্য যে বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের গৈরিকীকরণের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্য থেকেই সে কথা মনে করার সঙ্গত কারণ আছে৷ কারণ নানা সময়ে বিজেপি নেতা–মন্ত্রীরা এ ধরনের অনৈতিহাসিক ও অবৈজ্ঞানিক মন্তব্য করে থাকেন৷ যেমন কিছুদিন আগে রাজস্থানের শিক্ষামন্ত্রী বাসুদেব দেবনানি বলেছিলেন, নিউটন নন, প্রাচীন ভারতে হাজার বছর আগে ব্রহ্মগুপ্ত মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন৷ তবে সত্যপাল সিং এঁদের সবাইকে ছাডিয়ে গেছেন৷

 দেশের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তর৷ তাই তাঁর এই মন্তব্য শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে আতঙ্কিত না করে পারে না৷ আগেই বলা হয়েছে, অনেক ভুল ও অবৈজ্ঞানিক তথ্য ছাত্রছাত্রীদের শেখানো হচ্ছে যার মাত্রা ক্রমেই বাডছে৷ এভাবে যদি চলতে থাকে তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হবে, দেশে ফ্যাসিবাদের জমি প্রস্তুত হবে৷ ছাত্রছাত্রীরা ভুল জিনিস শিখবে এবং এই ভুল জ্ঞান নিয়ে বিদেশে গেলে তারা হাস্যাস্পদ হবে৷ ভারতে বিজ্ঞানের অগ্রগতিও ব্যাহত হবে৷ সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং আন্দোলন গডে তুলে সরকারকে বাধ্য করতে হবে এই সর্বনাশা নীতি পরিত্যাগ করতে৷

ডঃ প্রদীপকুমার দত্ত

অবসরপ্রাপ্ত প্রধান, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা