সংযম–অসংযম

কলকাতা মেট্রো রেলে সম্প্রতি দুই যুবক–যুবতীকে নিয়ে প্রকৃতই কী হয়েছিল প্রত্যক্ষদর্শীরা বলতে পারবেন৷ এ নিয়ে প্রহৃত যুবক–যুবতী কোথাও কোনও অভিযোগ করেছেন বলে সংবাদ নেই৷ তাই দু’পক্ষের কারও কাছ থেকে আমরা ঘটনার সঠিক বিবরণ জানতে পারিনি৷ অনেকে বলছেন ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ্যে আসার লজ্জায় যুগল নিগৃহীত হয়ে কোথাও কোনও অভিযোগ করেননি৷ যদিও যারা মেট্রোর মতো জনবহুল জায়গায় আলিঙ্গন করতে পারে তাদের এই সঙ্কোচ না থাকারই কথা কোনও পার্কে বা পর্যটন কেন্দ্রে এমন বহু ঘটনার সাক্ষী আমরা সবাই৷ সেখানে দেখেও সবাই এড়িয়ে যান৷ গণ্ডগোল কোথাও দেখিনি৷ কিন্তু বাসে, ট্রেনে বা মেট্রোতে মানুষজন তাদের পরিবার–পরিজন ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের নিয়ে বা ব্যক্তিগত কাজে যাতায়াত করেন৷ সেখানে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ থাকে না৷ যা পার্কে বা পর্যটন কেন্দ্রে চলে তা বাসে, ট্রামে, মেট্রোতে চলে কি? এটি যদি সামান্য একটু আলিঙ্গনের ঘটনা হয়ে থাকে তাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কোনও মানেই হয় না৷ একটু এড়িয়ে যাওয়াই যায়৷ কিন্তু এর তীব্রতা যদি কোনও ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায় তা হলে জনতার মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া একটা হয়৷ সংযত সবাইকেই হতে হবে৷ যাঁরা ওই যুগলের গায়ে হাত তুলেছেন তাঁরা কিন্তু পরোক্ষে ওই অসংযমের সংস্কৃতিকে শক্তি দিলেন৷

মেট্রোর ঘটনা ভাল করে সবার যেহেতু জানার সুযোগ নেই সেহেতু এই ঘটনাকে বাদ দিয়ে বলি, কোনও যুগল এইরকম পাবলিক প্লেসে ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনের নামে নিজেদের আবেগের মুহুর্মুহু বহিঃপ্রকাশ ঘটালেই কি ‘অত্যাধুনিক’ মানসিকতার প্রকাশ ঘটে৷ কেউ যদি তার প্রতিবাদ করে তাকে কি বুড়োদের প্রতিবাদ বলে উপেক্ষা করা যায়?  এ কি বুড়ো–ছোকরার দ্বন্দ্বের বিষয়? যেন কেউ আমরা বুড়ো হব না!

আচ্ছা বুড়োদের কথা বাদ দিন৷ ওঁরা বড্ড সেকেলে যাঁরা বড্ড আধুনিক বলে মনে করছেন তাঁদের প্রশ্ন করি– হে আধুনিকগণ, আপনারা আজও কি জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন? হাতে অষ্টধাতুর আংটি বা তাবিজ বাঁধার সংস্কৃতি মন থেকে তুলে ফেলেছেন তো? হস্তরেখাবিদের কাছে হস্তগণনার জন্য ছুটে যাননি তো? জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমাজে যে হাজার গোঁড়ামি কুসংস্কার জগদ্দল পাথরের মতো বসে রয়েছে তার বিরুদ্ধে লড়াই জারি আছে তো? আচ্ছা, কাল যদি বিদ্যালয়ে–বিদ্যালয়ে এই যত্রতত্র আলিঙ্গন সংস্কৃতির আমদানি হয় তা মেনে নিতে পারবেন তো? আর যখন একটি দুটি সন্তানের জনক–জননী হয়ে উঠবেন তখন সন্তানদের ওইরকম ‘আধুনিক’ ঘটনার অংশীদার হতে দেখে খুশি হবেন তো? ছোট্ট থেকেই তাদের শিখিয়ে দেবেন তো ওই ‘আধুনিক’ সংস্কৃতির ধারাটি?

কেউ বলতে পারেন, টিভিতে বা সিনেমাতে যখন এমন ঘটে তখন কি তার প্রতিবাদ করা হয়? মনে রাখতে হবে, মানুষ তার পছন্দ অনুযায়ী সিনেমা বা টিভি দেখবে কি না তার একটা সুযোগ থাকে৷ কিন্তু তার জন্য মেট্রো রেল বা গণপরিবহণকেও  কেউ সিনেমার অভিনয় ভেবে নিলে সেটা স্বাভাবিক হবে? আবেগ, যৌনতার তাড়না এলেই তা যত্রতত্র প্রকাশ করা যায় কি, তা যেমন তেমন করে ভোগ করতে চাওয়াই কি মানুষের ধর্ম? এই অসংযত তাড়নার বশবর্তী মানুষের দেহধারীরাই বহু ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন, ইভটিজিং চালায় এবং তা ক্রমাগত বাড়ছে৷ এর প্রতিবাদ অবশ্যই হওয়া দরকার, কিন্তু সে প্রতিবাদেরও সংস্কৃতি থাকবে অবশ্যই৷

নিজেদের স্বার্থেই সারা বিশ্বে শাসকরা আজ এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনছে৷ মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনতে পারলে সহজেই মানুষকে কেনা যায়৷ তাই শাসকরা চায় তাৎক্ষণিক আনন্দে মেতে থাকুক যুবক–যুবতীরা৷ চারিদিকে তাই যৌনতার এত ছড়াছড়ি৷ যেন এটাই সব, এ ছাড়া জীবনের আর কোনও মূল্য নেই৷ মানুষ যে পশুজগতের থেকে ভিন্ন, বিচার–বুদ্ধি–বিবেক– তার প্রমাণ৷

প্রেম ভালবাসা অবশ্যই জীবনের সুন্দরতম একটি অঙ্গ৷ এক্ষেত্রে কুকুর–বেড়ালের সঙ্গে মানুষের সংস্কৃতির যে পার্থক্য রয়েছে সেটা মাথায় রাখতে হবে তো! প্রেম, ভালবাসার সাথে যে দৈহিক বিষয়টা থাকে তা বাইরে জনসমক্ষে অহরহ দেখানোর জিনিস নয়, এতে তার সৌন্দর্যটাই হারায়৷ না হলে তো আদিম মানুষরাই সবচেয়ে বড় আধুনিক হতো৷ এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়৷

‘সাহিত্যের রীতি ও নীতি’ প্রসঙ্গে তিনি এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘নর–নারীর যৌন মিলন যে সকল রস–সাহিত্যের ভিত্তি…ভিত্তির মতো ও–বস্তুটি সাহিত্যের গভীর ও গোপন অংশেই থাক৷ বনিয়াদ যত নিচে এবং যতই প্রচ্ছন্ন থাকে অট্টালিকা ততই সুদৃঢ় হয়৷ ততই শিল্পীর ইচ্ছা মতো তাহাতে কারুকার্য রচনা করা চলে৷ গাছের শিকড়, গাছের জীবন ও ফুল–ফলের পক্ষে যতই প্রয়োজন হউক–তাহাকে খুঁড়িয়া উপরে তুলিলে তাহার সৌন্দর্যও যায়, প্রাণও শুকায়’৷ আধুনিকতার নামে সেই প্রেম–ভালবাসার শিকড়টাকেই উপড়ে এনে উৎকট রূপে আনন্দ খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে না তো?

কিংকর অধিকারী

বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর৷

(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)