সংগ্রামী স্পর্ধায় সমুন্নত এগারোর অনুভূতি

ফি-বৃদ্ধি রোধ, উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে স্কুল-কলেজ খোলা সহ নানা দাবিতে ২৬ জুলাই রাজ্য জুড়ে প্রতীকী অবরোধের ডাক দেয় এআইডিএসও। বাঁকুড়ায় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীদের গ্রেপ্তার করে জামিন অযোগ্য ধারায় জেলবন্দি করে পুলিশ। প্রতিবাদে উত্তাল হয় ছাত্রসমাজ। ৩১ জুলাই মুক্তি পেয়ে বন্দি ওই ১১জন শিক্ষার্থী তুলে ধরেছেন তাঁদের অনুভূতিঃ

শাসকের ষড়যন্ত্রে অবরুদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্গল উন্মুক্ত করতে, মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠতম সম্পদ ‘জ্ঞান’কে লুঠেরাদের হাত থেকে রক্ষা করতে এই বাংলার হাজার হাজার সংগ্রামী সাথীদের সাথে আমরাও সেদিন শাসক তথা শোষণতন্ত্রের ধমনীগুলোকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছিলাম। মাত্র এক ঘন্টার যুদ্ধে হাঁসফাঁস করে উঠেছিল ওরা। সীমাহীন আতঙ্কে জান্তব ঔদ্ধত্যে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উন্মত্ত হিংসায়।

আমরা শুনেছিলাম বিপ্লবী ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও-র উদাত্ত আহ্বান, যে প্রত্যয়পূর্ণ সুর একদিন এ দেশের নবজাগরণ তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ প্রতিভূদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল।

এই বাংলার হাজার হাজার সংগ্রামী সাথীদের সাথে সেই ধ্বনির অনুরণন উঠেছিল আমাদের বুকেও। হ্যাঁ, খরাপীড়িত, দারিদ্র অধ্যুষিত, প্রত্যন্ত নগরী বাঁকুড়ার আমরা এগারো জন। যারা শাসকের ষড়যন্ত্রে অবরুদ্ধ হয়েছি কারাগারে।

বাইরে বাকি লড়াইয়ের ইতিহাস রচনা করলেন যাঁরা, তাঁরাই আমাদের অভিনন্দিত করলেন পুষ্পে মাল্যে। বিভূষিত করলেন ‘বীর’ আখ্যায়। প্রাপকের যোগ্যতা আর দাতার উদারতার মাঝে সাত সমুদ্রের ব্যবধান, তবুও তা দ্বিধা-সংকোচে বিহ্বল করেনি আমাদের। বরং তা আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে সুমহান কর্তব্যের আহ্বান।

মুক্তি যন্ত্রণায় ছটফট করা এই পচনশীল পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় নিত্য যেখানে মানবতার অপমৃত্যু ঘটছে, যেখানে জনশ্রুতি চলে ‘কেউ ভালো নয়’, ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’– সেই সমাজের গর্ভে আজও শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সত্যসাধক মানবাত্মার স্রোতধারা ফল্গুধারায় প্রবাহিত হতে দেখলাম আমরা। এ কি আমাদের কম পাওয়া! এই তো আমাদের আশীর্বাদ!

আমরা যখন কারান্তরালে, বহির্জগত থেকে পরিপূর্ণ সংযোগহীন, তখন আমরা বুক ভরা ভালোবাসা পেয়েছি কারারুদ্ধ মানুষের কাছ থেকে। ‘চোর-ডাকাত’ বলে সমাজ যাঁদের ঘৃণা করে তাঁরাই আমাদের বুকে করে আগলে রেখেছিলেন কারান্তরালের ওই দিন কটি। লৌহকারার শৃঙ্খলিত জীবন যাঁরা ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন সকলের সাথে তাঁরাও আমাদের মুক্তির জন্য দিন গুনেছেন। তাঁদের অসহায় জীবন, চোখের জল আমাদের কাছে আগামী দিনের পথ চলার চির সম্পদ হয়ে থাকবে। তাঁদের ব্যক্তিস্বার্থ-মুক্ত ভালোবাসা আমরা চিরদিন মাথায় করে রাখবো। আমরা সেলাম জানাই তাঁদের।

আমরা পেলাম এমন একদল মানুষকে যাঁরা মানবাধিকার রক্ষার জন্য এই দুঃসময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। সরেজমিনে তদন্ত করে সমাজের কাছে তুলে ধরলেন প্রকৃত সত্য। কুর্নিশ জানাই তাঁদেরও।

আমরা পেলাম সংগ্রামী চেতনার পাশে দাঁড়ানোর ঐতিহ্যবাহী বাঁকুড়া কোর্টের একদল উন্নতশির আইনজীবীকে।

যখন সিঙ্গুরে কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবক তাপসী মালিকের নির্মম হত্যার প্রতিবাদে বাঁকুড়ায় আন্দোলনকারী ২৯টি সংগ্রামী প্রাণকে বদ্ধ করা হয়েছিল কারাগারে, তখন তাঁদের পক্ষে শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন এই কোর্টের আইনজীবীরাই।

যখন পথনাটিকার মাধ্যমে শোষণযন্ত্রের নগ্নতা উন্মোচনের অপরাধে শহরের বুদ্ধিজীবীরা হয়েছেন কারাবন্দি, তখনো তাঁরাই দাঁড়িয়েছেন পাশে।

ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে, ১৯২৫-এ যখন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা শচীন্দ্রনাথ সান্যাল এ জেলায় এসে ‘বিপ্লবী ইস্তেহার’ প্রচার করতে গিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে কারারুদ্ধ হয়েছেন, তখন এ জেলার তৎকালীন আইনজীবীরাই তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন, লড়েছেন। আজও প্রবাহমান সেই ধারার স্পর্শে আমরা গর্বিত, প্রাণিত। আমরা সেলাম জানাই তাঁদেরও।

অগণিত ছাত্র যুবক শিক্ষক অধ্যাপক চিকিৎসক সহ সাধারণ মানুষ যাঁরা আমাদের মুক্তির দাবিকে সোচ্চারে সমর্থন জানিয়েছেন। সর্বত্র আলাপে আলোচনায় আমাদের লড়াইয়ের ন্যায্যতার স্বপক্ষে এই নগরীর পরিবেশকে সংগ্রামমুখর করে তুলেছেন, যা শাসকের বুকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা সেলাম জানাই তাঁদেরকেও।

গল্পে, উপন্যাসে, বিপ্লবী কাহিনীতে আমরা অনেক মাতা-পিতার কথা শুনেছি, যাঁদের বীরগাথা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা আমাদের অভিভাবকদের নতুন রূপে প্রত্যক্ষ করে গর্বিত হয়েছি। তাঁরা শুধু তাঁর নিজ সন্তানের জন্য নয়, সকল সন্তানের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। আমরা পেয়েছি এমন পিতাকে যিনি তাঁর সন্তানকে লিখে জানিয়েছেন, ‘পরিবারের পক্ষ থেকে তোমার সংগ্রামকে অভিনন্দন।’ এ যে আমাদের কত বড় শক্তি, মূল্যবান পাথেয়– তা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন! আমরা সেলাম জানাই তাঁদেরকেও।

আমরা সেলাম জানাই সেই বিপ্লবী সাথীদের, কমরেডদের যাঁরা এই যুগের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ বুকে বহন করে শাসকের বর্বরতাকে উপেক্ষা করে, রক্তাক্ত হয়ে, কারারুদ্ধ হয়ে সমগ্র বাংলাকে পুনর্জাগরিত করেছেন। তাঁদের বিপ্লবী হৃদয়াবেগ, বিপ্লবী বন্ধুত্বের হৃদয়স্পর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।

আমরা লাল সেলাম জানাই তাঁদের।

সংগ্রামী অভিবাদন সহ

আমরা এগারো জন

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৩ সংখ্যা