শ্রমিকদের আরও নিংড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা বিজেপি সরকারের

দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ নিরুপায় পরিযায়ী শ্রমিকের পরিণতি কী হবে সে চিন্তাকে বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে চার ঘণ্টার নোটিশে লকডাউন জারি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে দেশের মানুষের জীবনযাত্রা, সেই শ্রমিকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের দায়বদ্ধতার নমুনা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে এই ঘটনায়।

কিন্তু পুঁজিপতিদের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিচয় দেওয়ার তাগিদ থাকলে এতেই থামলে কি চলে! বরং এইতো সুযোগ! গোটাদেশ এখন করোনা-আতঙ্কে কাঁপছে। ঘরবন্দি সকলে। এখনই তো সময় কৌশলে কাজ হাসিল করার!

ঠিক তাই করতে চলেছে বিজেপি সরকার। ১৯৪৮ সালের কারখানা আইনের ধারা বদলে দিয়ে শ্রমিকের দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে ১২ ঘন্টা করতে চাইছে তারা। সরকারের বক্তব্য, কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে দিলে লক ডাউনের এই সময়ে কম শ্রমিক ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো যাবে। এতে নাকি শ্রমিকদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করানো যাবে, আটকানো যাবে করোনার প্রকোপ।

সত্যিই বোধহয় ‘দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না’! স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখতেই নাকি কাজের সময় বাড়াতে চলেছে তারা! প্রধানমন্ত্রী উত্তর দেবেন কি, তাহলে খোদ রাজধানী দিল্লির আশ্রয়শিবিরগুলিতে গা-ঘেঁষাঘেষি করে শ্রমিকদের থাকতে হচ্ছে কোন স্বাস্থ্যবিধি মেনে? উত্তর তাঁরা দেবেন না। কারণ, সত্য তাঁরা বলছেন না।

বেশ কিছুদিন ধরেই শ্রমিকদের কাজের সময় বাড়িয়েদেওয়ার মতলব আঁটছে কেন্দে্রর বিজেপি সরকার। গত বছরের নভেম্বর মাসে তারা মজুরি সংক্রান্ত নিয়মকানুনেরযে খসড়া প্রকাশ করেছিলসেই ড্রাফট ওয়েজকোড রুলে দৈনিক কাজের সময় ন’ঘণ্টা করার সুপারিশ ছিল। এখন লকডাউনের সুযোগে এক ধাক্কায় দৈনিক ৪ ঘন্টা করে বাড়িয়ে দিয়ে ১২ ঘন্টা কাজের সময় করার জোরদার তোড়জোড় শুরু করেছে বিজেপি সরকার।

রক্ত ঝরানো দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়েগোটা বিশ্বের শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের অধিকার আদায় করেছিল। আমাদেরদেশেও স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালের কারখানা আইনের ৫১ নম্বর ধারায়সেই অধিকারের স্বীকৃতিদেওয়া হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনও শ্রমিককে দিয়ে সপ্তাহের ৬ দিন দৈনিক ৮ ঘন্টারবেশি কাজ করানো যাবে না। বলা হয়েছে, প্রয়োজনে কারখানা-মালিক ‘ওভারটাইম’ অর্থাৎ দৈনিক আট ঘণ্টারবেশি কাজ করাতে পারবে শ্রমিকদের দিয়ে, কিন্তুসেই কাজের পরিমাণও তিন মাসে একশো কুড়ি ঘণ্টারবেশি হওয়া চলবে না। আইনে এ-ও বলা আছে, প্রতি ঘন্টা ওভারটাইম কাজের জন্য চলতি মজুরির দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ দিতে হবে শ্রমিককে।

বলা বাহুল্য, যেখানেবেকার সমস্যার তীব্রতা আকাশ ছুঁয়েছে, লক্ষ লক্ষবেকার কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে,সেখানে বেসরকারি কলকারখানাগুলিতে বহু ক্ষেত্রেই ৮ ঘণ্টার বেশি সময় খাটিয়েনেওয়া হয় শ্রমিকদের। এসইজেডগুলিতে তো এই সমস্ত আইন মানার কোনও বাধ্যতাইনেই মালিকদের। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত, ছাঁটাই হওয়ার ভয়ে ভীত অসংগঠিত শ্রমিকরাবেশিরভাগ সময়েই মুখ বুজেমেনে নিতে বাধ্য হন মালিকদের এই অত্যাচার। তবুযেটুকু প্রতিবাদ ওঠে, মালিকের মুনাফা নিশ্চিত করতেসেটুকুও মুছে দিতে দীর্ঘদিন ধরেই আইন পাল্টানোরতোড়জোড় করছে কেন্দে্রর বিজেপি সরকার। করোনা বিপর্যয় ও লকডাউনকে এর সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চাইছে তারা।

এই আইন পরিবর্তনের কারণ হিসাবে কম শ্রমিক দিয়েবেশি উৎপাদনেরযে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বিজেপি সরকার, তা যে অজুহাত মাত্র বুঝতে অসুবিধা হয় না। শ্রমিকদের প্রতি বিন্দুমাত্র দরদ থাকলে উৎপাদন বাড়াতে তারা মালিকদের একাধিক শিফ্ট চালু করার কথা বলত। এমনিতেই চরম অর্থনৈতিক সংকটেদেশের অর্থনীতি জর্জরিত। এদিকে করোনা সংক্রমণ রুখতে দীর্ঘ সময় ধরে লকডাউন চলছে দেশ জুড়ে । লকডাউন উঠে যাবার পরদেশের অর্থনীতিভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। এই অবস্থায় তীব্র বেকার সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে সরকারের উচিত ছিল যতটা সম্ভব বেশি করে শ্রমিকদের কাজের ব্যবস্থা করা। কারখানাগুলোতে একাধিক শিফ্ট চালু করে আগের চেয়ে আরও বেশি সংখ্যক শ্রমিককে কাজ দিলে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ত। পাশাপাশি এই পথে শ্রমিকদের হাতে কিছুটা অর্থের জোগান দিয়ে তাদের জীবনরক্ষা করা যেত। মানুষের কেনার ক্ষমতা বাড়ায় অর্থনীতির থমকে যাওয়া চাকা খানিকটা হলেও গতি পেত। এতে মালিকদের মুনাফার অঙ্ক হয়ত কিছুটা কমত, কিন্তু শ্রমিকদের পেটে দেওয়ার মতো দু’মুঠো ভাতের বন্দোবস্ত হত।

কিন্তু মুনাফাবাজ পুঁজিপতিদের রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে বিজেপি সরকার সেই পথে হাঁটার কথা আদৌ ভাবছে না। তাই মিথ্যা অজুহাতে শ্রমিকদের কাজের সময় বাড়িয়ে দিয়ে তাদেরশেষ রক্তবিন্দুটুকু নিংড়ে নেওয়ার মতলব আঁটছে তারা। শ্রমিকদের অসংগঠিত থাকার সুযোগ নিয়ে তাদের মাথায় পা রেখেই অর্থনীতির ডুবতে-বসানৌকা ভাসিয়ে রাখতে চাইছে সরকার এবং মালিকরা। শ্রমিকরা মরে মরুক মালিকদের মুনাফার থলি তো আরও ভরিয়ে তোলার বন্দোবস্ত করা গেল! এই পুঁজিবাদী রাষ্টে্র সরকারে থাকতে হলে মালিকের কৃপাদৃষ্টি লাভ না করলে চলবে কী করে! তাদের ইচ্ছা ও বদান্যতাতেই যে ভোটে জেতার দেদার টাকা আসে দলের ভাণ্ডারে!

ষড়যন্ত্র হাসিল করতে নির্লজ্জের মতো নরেন্দ্রমোদির বিজেপি সরকারবেছে নিয়েছে লকডাউনের এই সময়টাকে। যাতে একদিকে উৎপাদন বজায় রাখার অজুহাত খাড়া করে দেশের মানুষকে ভোলানো যায়। অন্যদিকে তার এই সর্বনাশা চক্রান্তের বিরুদ্ধেদেশ জুড়ে ঐক্যবদ্ধভাবেজোরালো প্রতিবাদ সংগঠিত করতে না পারে শ্রমিকরা।

যুগ যুগ ধরে মালিকদের শোষণ নির্যাতনের শিকার হয়ে চলেছেমেহনতি মানুষ। রক্তঢেলে প্রাণ দিয়েসে অত্যাচারেরমোকাবিলা করেছে তারা। এই পথেই একদিন তারা অর্জন করেছিল ৮ ঘণ্টারবেশি কাজ না করার অধিকার। আজও মালিকদের মুনাফার নগ্ন স্বার্থে কেন্দে্রর বিজেপি সরকারের এই নির্লজ্জ ষড়যন্ত্র তারা মুখ বুজেমেনেনেবে না। লড়াইয়ের পথেই তারযোগ্য জবাবদেবে।

(সূত্র : এই সময় ও হিন্দুস্তান টাইমস ১২ এপ্রিল ‘২০ এবং লাইভমিন্ট ৩ নভেম্বর ‘১৯)