শোষণ ব্যবস্থার সাথে আপস করে মর্যাদা অর্জন করা যায় না–শিবদাস ঘোষ

‘‘আপনারা কি এই কথাটার মানে বোঝেন যে, ইউ ক্যানট ফাইট ফর ইওর ওন ফ্রিডম উইদাউট ফাইটিং ফর দ্য ফ্রিডম অফ আদারস। আগেও বহু ক্লাসে একথা আপনাদের বলেছি–এই ফ্রিডম কথাটা বুঝতে হবে কী ভাবে? বুঝতে হবে–তুমি যদি নিজে বিকাশলাভ করতে চাও, সমাজ বিকাশের জন্য তোমার যদি উদ্বেগ এবং আকাঙ্খা থাকে, সংস্কৃতিসম্পন্ন, রুচিসম্পন্ন, শালীনতা এবং মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপন করতে যথার্থই যদি তুমি চাও এবং মর্যাদা সম্পর্কে তোমার যদি কোনও ভ্রান্ত ধারণা না থাকে, মর্যাদা মানে টাকাপয়সা, মর্যাদা মানে আইসিএস অফিসার হওয়া, মর্যাদা মানে হাইকোর্টের জজ হওয়া, মর্যাদা মানে মিনিস্টার হওয়া, চিফ মিনিস্টার হওয়া, মর্যাদা মানে অ্যামবাসাডর হওয়া এবং গাড়িবাড়ি থাকা; লোকে আমাকে স্যার স্যার বলবে, এইরকম তোমার যদি ভাবনা না থাকে, মর্যাদা কথাটার যথার্থ উপলব্ধি যদি তোমার থাকে তা হলে এ সমাজে তার একটাই মানে। সেটা হচ্ছে, এই সমাজে যদি সত্যিই মর্যাদার সঙ্গে, সম্মানের সঙ্গে নিজের মাথা উঁচু করে বিবেকের অনুশাসন অনুযায়ী চলতে চাও, তাহলে, ‘দ্য ওনলি ওয়ে টু লিড ইওর লাইফ ইন অনারেবল ওয়ে ইজ টু এনগেজ ইওরসেলভস কনস্ট্যান্টলি ইন দ্য স্ট্রাগল অফ দ্য মাসেস ফর জাস্টিস।’ ইনজাস্টিসের বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণের সংগ্রাম সংগঠিত করা এবং তাকে নিয়ে লড়াই করা এবং এই লড়াই সংগঠিত করার কাজে এবং সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করার মধ্য দিয়েই তুমি একমাত্র মর্যাদা এবং ডিগনিটিসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারো। বাকি সমস্ত রাস্তা সব সেল্ফ ডিসেপশন, মর্যাদার নয়– অহম। কারণ এ সমাজে ওয়াগন ব্রেকারের টাকায় সম্পত্তি করলেও মর্যাদা মেলে, ফুলের মালা মেলে। ডাকাতি-গুণ্ডামির পয়সায় টাকা-কড়ি হলে তারও কদর হয়। তারপরে সে এমএলএ, এমপি হয়, আর তা হয় পয়সার জোরে। তারপরে সে মিনিস্টার হয়। তারপরে তিনি বাণী দিতে থাকেন। তা তিনি যদি এসব ঠুনকো মর্যাদায় আত্মসন্তুষ্টি পান তা হলে ফ্রিডম নিয়ে অত মাথা ঘামাবার দরকার কী?

কেউ ভাবতে পারে, আমি একটু লেখাপড়া শিখে ডাক্তার হব, এটা অনারেবল ওয়ে। কিন্তু ডাক্তার হলেও তো হবে না। কারণ এই সমাজে ডাক্তার যদি ‘এথিক্স অফ মেডিকেল সায়েন্স’কে আপহোল্ড করে, ডাক্তারের নোবেল লাইফ লিড করতে চায়, তা হলে তাকে না খেয়ে থাকতে হবে। তার দ্বারা প্র্যাক্টিস হবে না এবং সে নামও করতে পারবে না এবং টাকাপয়সাও তার হবে না। কেউ তাকে ব্যাক করবে না। সে একটা পাগল বলে গণ্য হবে। সর্বস্তরে তার রীতিনীতি, নৈতিকতা, মেডিকেল এথিক্স নিয়ে সংঘর্ষ হবে। ফলে সে কিছুই করতে পারবে না। তা হলে মেডিকেল এথিক্স বা বিজ্ঞানের যে এথিক্স, একজন বিজ্ঞানী বা ইঞ্জিনিয়ার বা কেমিস্ট হোক বা ফিজিক্সের ছাত্র হোক, তার কোনও কিছু পরোয়া না করে হোয়াট ইজ দ্যা এথিক্স অফ সায়েন্স, তার পরোয়া না করে তিনি যদি নিজেকে গোলাম, চাকুরিজীবীতে পর্যবসিত করেন, পয়সার বিনিময়ে টাটার কাছে, না হয় বিড়লার কাছে, না হয় কোনও ফার্মের কাছে, না হয় গভর্নমেন্টের কাছে, নিজের বিবেক বিক্রি করেন, হ্যাঁ তা হলে তার পয়সা হবে, নাম হবে। এই তো? তা হলে সে যদি ভাবে যে না না, আমি তো ওয়াগান ব্রেকিং করে বা রেস খেলে বা গুণ্ডাদল তৈরি করে টাকা করে তো নাম করিনি, আমি ডাক্তারি করে নাম করেছি, ফাঁকি দিয়ে নয়। কিন্তু তুমি কি জানো যে, শুধু ডাক্তারি করে নাম করোনি। ডাক্তারির সঙ্গে তুমি গোলামি করেছ, তোষামোদি করেছ। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাথে গোলামি করেছ, তোষামোদি করেছ। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেছ। মানব সভ্যতার চরম দুষমনদের কুকার্যগুলোকে চূপ করে থেকে হজম করেছ। তাদের কাছে নিজের বিদ্যাবুদ্ধি জ্ঞান বিকিয়ে দিয়েছ। তবে তুমি পয়সা করেছ। এর নাম কি মর্যাদা? এই মর্যাদার জন্য সিদ্ধার্থবাবুর দল দৌড়চ্ছে, অন্য দলগুলো দৌড়চ্ছে।

পৃথিবীতে দু-দল মানুষ আছে। একদল মানুষ ঠুনকো মর্যাদার জন্য দৌড়তে থাকে। আর এক দল মর্যাদা বলতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জিনিস মনে করে। মনে করে বিবেকের দংশন কী করতে বলে, মনে করে সত্যিকারের প্রগতি আছে সেখানে যেখানে সমাজের অগ্রগতি নিহিত রয়েছে। যে অগ্রগতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রত্যেকটি ব্যক্তি মানুষকে তার কূপমণ্ডুকতা, দুর্বলতা, লোভ, ভয়, ভীতি থেকে মুক্ত করা এবং সেই রাস্তায় মাথা উঁচু করে সংগ্রাম করা। সমাজকে শোষণমূলক অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া। সমাজের পরিবর্তন আনা। আর সমাজের এই পরিবর্তন আনার মধ্য দিয়ে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনা এবং তার বিকাশের রাস্তা খুলে দেওয়া।” (শিক্ষাশিবির, ১৯৭৪)

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা ২২ এপ্রিল ২০২২