শাসক দলগুলি জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাখতে চায়

 

সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট অবনী বনসাল সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়ায় এক প্রতিবেদনে তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন৷ তিনি লক্ষ করেছেন ভারতের রাজনৈতিক দল এবং নেতারা তাঁদের মূল্যবান ভাষণে দেশের শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নীতি, নারী সুরক্ষা, ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যার সমাধান ইত্যাদি জনজীবনের মূল সমস্যাগুলি নিয়ে কোনও আলোচনাই করেন না বা সযত্নে বিষয়গুলি এড়িয়ে যান৷ বিপরীতে জাতি–বর্ণগত বিভেদ, ধর্মীয় ভেদাভেদ ইত্যাদি বিষয় তাঁদের বক্তব্যে অত্যন্ত গুরুত্ব পায় এবং বক্তব্যের সিংহভাগ জুড়ে থাকে৷ এটা তাঁকে বিস্মিত করেছে৷

তাঁর প্রশ্ন, গত চার বছরে অর্থনীতির কী উন্নতি হয়েছে, কর্মসংস্থানের কী হাল, চাষির আত্মহত্যা কমছে কিনা, দেশের মানুষের কাছে বিশুদ্ধ পানীয় জল পৌঁছেছে কি না, দারিদ্রসীমা নামল কি না, অপুষ্টি কমল কি না, দেশের সকল মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটল কি না? খরা–বন্যার কবল থেকে মানুষের মুক্তি ঘটবে কি না, নোট বাতিলের ফল কী দাঁড়াল– ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দেশে বিতর্ক চলছে কি? সাধারণ মানুষের কাছে এই প্রশ্নগুলি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কি? শাসক দল কি এই বিষয়গুলি নিয়ে প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়?

তাঁর পর্যবেক্ষণ, শাসকদলগুলি এসব প্রশ্নের উত্তর তো দেয়ই না, বিপরীতে জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের জিগির তুলে এ বিষয়গুলি ভোলায়৷ একই সাথে আঞ্চলিক ভাবাবেগ উস্কে দিয়ে কখনও নানা শহরের, কখনও রেলস্টেশনের নাম পাল্টানোর পথ নেয় এবং জনগণের দৃষ্টিকে এর মধ্য আটকে দেয়৷ তাঁর মতে এটা ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তার দেউলিয়াপনার প্রমাণ৷ কিন্তু কেন এই দেউলিয়াপনা সে বিষয়ে তিনি কোনও ইঙ্গিত দেননি৷ সম্ভবত সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে জড়িত থাকায় তিনি এ বিষয়টি স্পষ্ট করে কিছু বলতে চাননি৷ বুর্জোয়া শ্রেণি বা তাদের রাজনৈতিক দলগুলিই বা কেন এই কৌশল নেয়? আসলে বুর্জোয়া শোষণ এবং বুর্জোয়া শাসনই যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দুর্দশার মূলে, এই সত্য যাতে সাধারণ মানুষ ধরতে না পারে এবং এর প্রতিকারে বুর্জোয়া ব্যবস্থা উচ্ছেদের দিকে জনরোষ ধাবিত না হয় সেই লক্ষ্যে বুর্জোয়া ব্যবস্থার রক্ষকরা এ ভাবে মানুষকে অন্য কিছু দিয়ে ভুলিয়ে রাখে৷ এটা তাদের নিছক দেউলিয়া রাজনীতি বললে কম বলা হয়৷ বরং বলা যেতে পারে, অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে জনগণকে এ ভাবে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়৷

এ অবস্থায় করণীয় কী? তাঁর বক্তব্য, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে এবং বিদায়ও নেবে৷ কিন্তু দেশের নাগরিক হিসাবে এটা আমাদের অধিকার বা কর্তব্য রাজনৈতিক দলগুলি যা বোঝাবে, টি ভি চ্যানেল–সোস্যাল মিডিয়া বা সংবাদ মাধ্যম যা জনগণকে গেলাবে সে সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা এবং এমন পথ বের করা যাতে নেতারা উত্তর দিতে বাধ্য হন৷ আমার মনে হয়, অবশ্যই এটা গুরুত্বপূর্ণ করণীয়৷ একই সাথে শ্রেণি স্বার্থের বিষয়টি প্রচারে আনতে হবে৷ বুর্জোয়া শ্রেণির শাসনে সর্বহারা শোষিত, মেহনতি সাধারণ মানুষের যে কল্যাণ নেই – এই চিন্তার প্রসার ঘটাতে হবে৷ এ পথেই একদিন মানুষ ধরতে পারবে শোষিত শ্রেণির রাজ কায়েম না হলে শোষিত শ্রেণির সংকট মিটবে না, মুক্তি ঘটবে না৷ লেখক অবনী বনসাল যে সমস্যাগুলির উল্লেখ করেছেন সেগুলি দীর্ঘ শোষণ ব্যবস্থারই ফল৷

সুমিত সেন, কলকাতা–৪০

(৭০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা ৬ জুলাই, ২০১৮)