রেলে ব্যাপক বেসরকারিকরণ জনগণের সর্বনাশ, কর্পোরেটের পৌষমাস

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মোদি সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে দ্রুত বিলগ্নীকরণ এবং বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে৷ দেশের প্রধান সরকারি পরিবহণ সংস্থা ভারতীয় রেলের ওপর এই বেসরকারিকরণের কোপ কয়েক বছর আগে থেকে শুরু হলেও এবারে বাজেটের পর নীতি আয়োগ এবং রেলমন্ত্রক ঘোষণা করেছে ৫০টি রেল স্টেশন এবং ১৫০টি দূরপাল্লার ট্রেন, আন্তঃশহর এক্সপ্রেস (ইন্টারসিটি) ও কলকাতা, চেন্নাই, মুম্বাই, সেকেন্দ্রাবাদের লোকাল ট্রেন তারা কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেবে৷ ইতিমধ্যে লক্ষ্ণৌ–দিল্লি বেসরকারি বিলাসবহুল ‘তেজস ট্রেন’ চালু হয়েছে৷ উচ্ছ্বসিত যোগী আদিত্যনাথ তা উদ্বোধন করেছেন৷ যদিও রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়াল তার মন্ত্রকের এই সিদ্ধান্তকে ‘রেলে বেসরকারিকরণ হচ্ছে’ বলে মানতে রাজি নন৷

১১ জুলাই সংসদে রেল বাজেট সংক্রান্ত বিতর্কে বিরোধী সাংসদদের তিনি বলেছিলেন, ‘রেলে কোনও বেসরকারিকরণ হচ্ছে না’৷ অথচ এবারের বাজেটে সরকার জানিয়ে দিয়েছে ৭টি গুরুত্বপূর্ণ রেল কারখানাকে কর্পোরেট কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হবে৷ ইতিমধ্যে চেন্নাইয়ের ঐতিহ্যপূর্ণ ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরিতে রেল কোচ তৈরির দায়িত্ব কর্পোরেট পুঁজিপতিদের দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছে৷ রেলমন্ত্রী বলেছেন, আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেম থেকে লাইনপাতা, বৈদ্যুতীকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি বেসরকারি কোম্পানিগুলির সাথে হাত মিলিয়ে পিপিপি মডেলে করা হবে৷ আগে থেকেই খাবার, সাফাই, টিকিট বিক্রি, ইন্টারনেট প্রভৃতি পরিষেবা বেসরকারি সংস্থার অধীনে৷ আয় বাড়ানোর জন্য রেলদপ্তরে থাকা জমি বিক্রির ব্যাপারেও তারা একধাপ এগিয়ে৷ কর্পোরেট পুঁজিপতির দল এই জমিগুলো জলের দরে কিনে শপিংমল, আবাসন প্রভৃতি তৈরি করবে৷ রেলমন্ত্রী এ–ও বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে বেসরকারি মালিকদের হাত ধরে৷

সরকার রেলের ভাড়া বাড়ানো এবং বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে বরাবর প্রচার করে থাকে,  ‘রেলে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়’৷ এই অজুহাতে ‘প্রিমিয়াম তৎকাল’, ‘সুবিধা’ ইত্যাদির নামে মানুষের নিরুপায় অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে বাড়তি টাকা রোজগার করে রেল৷ এ ছাড়া রেল পরিবহণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মাশুল অনেক বাড়ানো হয়েছে৷ সাধারণ স্লিপারের ভাড়াও নানা অজুহাতে বাড়িয়ে চলেছে রেল দপ্তর৷ অন্য দিকে বর্ষীয়ান নাগরিক এবং সাধারণ যাত্রীদের কাছে টিকিটের ফর্মে এবং ইন্টারনেটে আবেদন করা হচ্ছে ভর্তুকি ছেড়ে দেওয়ার জন্য৷ অথচ এবারের রেল বাজেটে সরকার দেখিয়েছে, গত আর্থিক বছরে রেলের মোট আয় ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ২১৪ কোটি টাকা এবং খরচ ১ লক্ষ ৯১ হাজার ২০০ কোটি টাকা৷ নেট লাভ ৬ হাজার ১৪ কোটি টাকা৷ বাজেটের হিসাবে প্রতি ১০০ টাকা আয়ে রেলের খরচ ৯৬.২ টাকা৷ তা হলে রেলের মতো একটি লাভজনক সরকারি প্রতিষ্ঠান যেখানে ১৪ লক্ষ কর্মচারীর এবং তাদের পরিবারের ৭০ লক্ষেরও বেশি মানুষ যুক্ত, তা বেসরকারিকরণ কেন করা হচ্ছে?

 

বেসরকারি হাতে রেল প্রতিবাদ  এস ইউ সি আই (সি)–র

গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ট্রেন বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার বিজেপি সরকারের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এস ইউ সি আই (সি)–র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ৷ ২৮ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, এটা দেশের জনগণের উপর এক মারাত্মক আঘাত৷ এর ফলে রেলযাত্রা আরও ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে এবং লক্ষ লক্ষ রেল কর্মচারী ছাঁটাই হবেন৷ শুধু তাই নয়, এই কর্মচারীরা তাঁদের বহু সংগ্রামে অর্জিত নানা সুবিধা ও অধিকারগুলিও হারাবেন৷ এই ভয়ঙ্কর নির্দেশ আসলে সমগ্র রেল ব্যবস্থা বেসরকারিকরণের চক্রান্তের প্রথম ধাপ৷

কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যাতে এই সর্বনাশা সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়, তার জন্য শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে তিনি জনগণের কাছে আবেদন জানিয়েছেন৷

কর্পোরেট মালিকরা তো অধিক মুনাফা লাভের দিকে তাকিয়ে রেল পরিচালনা করবে৷ তেজস ট্রেন চলছে৷ বিলাসবহুল পরিষেবার নামে যা ভাড়া তাতে এই ট্রেনে সাধারণ মানুষের পক্ষে যাতায়াত করা অসম্ভব৷ আবার এগুলোতে না থাকবে বর্ষীয়ান নাগরিক, শিশু ও অসুস্থদের জন্য ছাড়৷ এর ফলে এক দিকে দ্বিগুণ, তিনগুণ ভাড়া বৃদ্ধি হবে, অন্য দিকে হবে অবাধে কর্মীসংকোচন৷ রেলে এখন ৩ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে৷ এগুলো পূরণ তো দূরের কথা, রেলমন্ত্রক ঘোষণা করেছে, ৫৫ বছরের অধিক বয়স এবং যারা ৩০ বছর কাজ করেছেন তাদের অবসর নিতে হবে৷ এই ভাবে তারা আরও সাড়ে ৩ লক্ষ কর্মচারী ছাঁটাই করতে চলেছে৷

রেলমন্ত্রক যতই উন্নত যাত্রী পরিষেবা ও নিরাপদ যাত্রার কথা বলুক, বাস্তব হচ্ছে এ স্তোকবাক্য ছাড়া আর কিছু নয়৷ যাত্রীরা জেনে গেছেন ট্রেনে তাদের চোর, ডাকাত, ছিনতাইবাজের কবলে যে কোনও সময় পড়তে হতে পারে এবং যে কোনও দিন ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে জীবনহানিও ঘটতে পারে৷ বেসরকারি সংস্থা যারা অধিক মুনাফার স্বার্থে কর্মী সংকোচন সহ জনস্বার্থ বিরোধী নীতি নিয়ে চলে তারা কি সাধারণ যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য এবং নিরাপত্তার বিষয়টি আদৌ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে পারে?

রেলে বেসরকারিকরণের ফলে শুধু মেল এক্সপ্রেস ট্রেনের ভাড়া বাড়বে তাই নয়, লোকাল ট্রেনগুলিও এ থেকে ছাড় পাবে না৷ এ দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ যারা প্রতিদিন নানা প্রয়োজনে শহরে যান, লোকাল ট্রেনে গাদাগাদি করে তুলনামূলক কম ভাড়ায় যাতায়াত করেন, সস্তায় সবজি বিক্রি করেন, তাদের অবস্থা হয়ে উঠবে অসহনীয়৷ মানুষের রোজগার তলানিতে চলে যাবে৷ বাজার সংকট আরও বাড়বে৷

রেলের বেসরকারিকরণের নাগপাশ থেকে বেরোতে হলে বিজেপি সরকারের এই মানুষ–মারা নীতির বিরুদ্ধে চাই গণপ্রতিরোধ৷ শ্রমজীবী মানুষের সংঘবদ্ধ লড়াই ছাড়া একে প্রতিহত করা যাবে না৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১০ সংখ্যা)