যে প্রশ্নের উত্তর দিলেন না অর্থমন্ত্রী

শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেন কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রীও৷ বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ যতই গলা চড়িয়ে বিপুল বৃদ্ধির স্লোগান দিন, আর প্রধানমন্ত্রী ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি বানাবার স্বপ্ন ফেরি করুন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা নীতি আয়োগ বার বার দেশের অর্থনীতির গভীর মন্দা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেই চলেছে৷ শিল্পমহল সরকারি ত্রাণের বায়না ধরেছে৷ এই অবস্থায় ২৩ আগস্ট সাংবাদিক সম্মেলন করে অর্থমন্ত্রী তড়িঘড়ি যেভাবে কিছু টোটকা ঘোষণা করলেন, তা থেকেই স্পষ্ট, সরকার মেনে নিল অর্থনীতির গভীর অসুখের কথা৷ যদিও যে টোটকা অর্থমন্ত্রী এদিন দিয়েছেন, তাতে অর্থনীতির এই অসুখ সারবার নয়৷

বেশ কিছুদিন ধরে গভীর মন্দার ঘূর্ণিপাকে হাবুডুবু খাচ্ছে ভারতের অর্থনীতি৷ খবরের কাগজের পাতায় পাতায় অর্থনীতির দুর্দশাগ্রস্ত ছবি৷ গত ৯ আগস্ট সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অর্গানাইজেশন (সিএসও) বা কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা প্রকাশ করেছে শিল্প উৎপাদন সূচক৷ দেখা যাচ্ছে, জুন মাসে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির হার নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ শতাংশে৷ গত বছরের এই সময়ে তা ছিল ৭ শতাংশ৷ গাড়ি, কাগজ, আসবাবপত্র ও নির্মাণ শিল্পে শূন্যেরও নিচে নেমে গিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়েছে (পিটিআই, ৯ আগস্ট, ২০১৯)৷ তলানিতে পৌঁছেছে পরিকাঠামো বৃদ্ধির হার৷ বাণিজ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যান জানিয়েছে, গত জুন মাসে দেশের রপ্তানিও ৯.৭ শতাংশ কমেছে৷ আমদানি, বিশেষত মূলধনী পণ্য যা অন্য পণ্য তৈরিতে কাজে লাগে, কমে গেছে তার পরিমাণও (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ আগস্ট, ১৭ জুলাই)৷ এক কথায় দেশের উৎপাদন, পরিকাঠামো ও ব্যবসা ক্ষেত্র, অর্থাৎ গোটা অর্থনীতি জুড়েই ঘনিয়ে এসেছে মন্দার কালো মেঘ৷

বিক্রি নেই৷ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কল–কারখানা, শো–রুম, ব্যবসাপত্র৷ কাজ হারাচ্ছে মানুষ৷ এমনিতেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়াই আচমকা নোট বাতিল ও জিএসটি চালুর ফলে গত দু’বছরে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ ছোট উৎপাদক সংস্থা৷ ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’র রিপোর্ট অনুযায়ী, এর ফলে কাজ চলে গেছে এগুলির সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের৷ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাতে ২৪ লক্ষ পদ খালি পড়ে আছে৷ প্রথমবার সরকারে বসার আগে ২০১৪–তে যে নরেন্দ্র মোদি বছরে দু’কোটি বেকারের কর্মসংস্থান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২০১৬ সালে তাঁর সরকারেরই নির্দেশে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে ৫ লক্ষ সরকারি পদ৷ সম্প্রতি রেলে ৩ লাখ ছাঁটাইয়ের ষড়যন্ত্র চলছে৷ গোপন করার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটের আগে ফাঁস হয়ে যাওয়া সরকারি রিপোর্টে বেরিয়ে পড়েছে, বেকারির বর্তমান হার গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে৷ তার উপর নতুন করে শুরু হয়েছে ব্যাপক ছাঁটাই৷

মন্দার আবর্তে পড়া দেশের অর্থনীতির সংকটের বীভৎস চেহারাটা সামনে এসেছে গাড়ি শিল্পে ব্যাপক ছাঁটাইয়ের খবরের মধ্য দিয়ে৷ ৩০ জুলাইয়ের ইকনমিক টাইমসের রিপোর্ট, গত ৮ বছরের মধ্যে বিক্রিবাটা সবচেয়ে কমে গিয়ে ৫ লক্ষ যাত্রীবাহী গাড়ি ও ৩০ লক্ষ দু–চাকার গাড়ি গুদামে পড়ে রয়েছে৷ বিক্রির অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক গাড়ি কারখানা৷ মারুতি উৎপাদনের পরিমাণ অর্ধেকে নিয়ে গেছে৷ গাড়ি সংস্থাগুলির সংগঠন ‘সিয়াম’–এর রিপোর্ট, জুলাই মাসেও পাইকারি বাজারে তাদের ব্যবসা তলানিতে নেমেছে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০ আগস্ট, ’১৯ ও অন্যান্য)৷ এইভাবে উৎপাদন ও বিক্রি কমার কারণে প্রথমেই কোপ পড়ছে কারখানা আর শোরুমগুলির শ্রমিক–কর্মচারীদের উপর৷ এরপর একে একে ছাঁটাই হতে থাকবেন বন্ধ হতে থাকা যন্ত্রাংশ নির্মাণ সংস্থাগুলির শ্রমিক–কর্মচারী, জ্বালানি তেল ও গাড়ি–সারাই কর্মীরা৷ কমবে ইস্পাত, টায়ার সহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের চাহিদা৷ ছাঁটাইয়ের খাঁড়া নামবে সেইসব কারখানার কর্মীদের উপরেও৷ এভাবে চলতে থাকলে গাড়ি শিল্পের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষের কাজ হারাবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির সংস্থাগুলির সংগঠন ‘অ্যাকমা’–র প্রেসিডেন্ট (ইকনমিক টাইমস,১ আগস্ট,’১৯)৷

আবাসন শিল্পেও ঘনিয়ে এসেছে দুর্দশা৷ তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে লক্ষ লক্ষ ফ্ল্যাট, খদ্দের নেই৷ শেষ হচ্ছে না বহু আবাসন প্রকল্প৷ টান পড়ছে ইট, সিমেন্ট, বালি, লৌহ–ইস্পাত, রং সহ সংশ্লিষ্ট অসংখ্য পণ্যের চাহিদায়৷

ছাঁটাইয়ের খাঁড়া আজ ঝুলছে দৈনন্দিন প্রয়োজনের ভোগ্যপণ্য শিল্পের উপরেও৷ ২১ আগস্টের ইকনমিক টাইমসের খবর, দেশের সবচেয়ে বড় বিসুক্ট নির্মাতা সংস্থা পার্লে ১০ হাজারের মতো শ্রমিক–কর্মচারীকে ছাঁটাই করতে চলেছে৷ একই পথে চলবে বলে জানিয়েছে আরেক বিসুক্ট ও ডেয়ারি–পণ্য নির্মাতা সংস্থা ব্রিটানিয়া৷ সংস্থার ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের বক্তব্য উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি জানিয়েছে, ইদানীং ৫ টাকা দামের বিসুক্টের প্যাকেট কেনার আগেও খদ্দেররা দু’বার ভাবছে৷ শহর, গ্রাম সর্বত্রই একই ভাবে কমে গেছে সাবান, মাথার তেল, শ্যাম্পু, দাঁতের মাজন, জামাকাপড়, জুতোর মতো ভোগ্যপণ্যের বেচাকেনা৷ ফলে অচিরেই বন্ধ হবে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের অসংখ্য ছোট–বড় কারখানা৷ বিক্রি না হওয়ায় ধুঁকতে থাকা দোকান–বাজারের কিছুটা বন্ধ হবে, কিছুটা অংশ ছাঁটাই করবে কর্মচারীদের৷ সব মিলিয়ে কাজ হারিয়ে পথে বসবেন কোটি কোটি খেটে–খাওয়া মানুষ৷

অর্থনীতির এই চরম বেহাল দশার কথা স্বীকার না করে পারেননি সরকারি প্রশাসন ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বড়কর্তারাও৷ নীতি আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যান স্বয়ং মন্তব্য করেছেন, বিগত ৭০ বছরে এরকম সঙ্কট আসেনি (বর্তমান, ২৪ আগস্ট,’১৯)৷ এই মন্দা দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর মনিটারি পলিসি কমিটির বৈঠকে৷ এবার অর্থমন্ত্রীকেও স্বীকার করতে হল সে কথা৷

কেন অর্থনীতির এমন করুণ দশা? অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের শীর্ষ প্রশাসক পর্যন্ত সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে এর পিছনে রয়েছে চাহিদার অভাব৷ যার অর্থ দেশের মানুষের কেনার ক্ষমতা নেই৷ কিন্তু বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বিশাল আয়তনের এই দেশে মানুষের হাতে জিনিসপত্র কেনার পয়সা নেই কেন? কেন দু’বেলা পেটের ভাতটুকু জোটাতেই কালঘাম ছুটে যাচ্ছে অধিকাংশ মানুষের? কেন আজ পাঁচ টাকার বিস্কুট, ১০ টাকার সাবান বা দু–তিন টাকার শ্যাম্পুর ছোট্ট প্যাকেটও দোকানে দোকানে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকছে? এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তরটি না দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, না দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷

তাঁরা যে কথাটি বলছেন না তা হল, দেশের বেশিরভাগ মানুষের হাতে শিল্পপণ্য কেনার মতো অর্থ নেই৷ ক্রমাগত আরও বেশি সংখ্যক মানুষের পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে৷ মন্দার এই ভয়ানক দাপট সামনে আসার আগেই শুধু ২০১৮ সালে কাজ চলে গেছে প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের (বিজনেস টুডে, ৪ জানুয়ারি, ’১৯)৷ আর কৃষির সঙ্গে যুক্ত যে সব মানুষ রোদ–জল–ঝড় উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের মানুষের পেটের ভাত জোগান, তাঁদের দুরবস্থার কথা কে না জানে৷ ক্রমাগত কমছে তাঁদের আয়৷ পরিসংখ্যান বলছে, গ্রামীণ আয় বৃদ্ধির হার ২০১৩–’১৪ সালে ছিল ২৮ শতাংশ৷ ২০১৮–’১৯ সালে কমে তা হয়েছে ৩.৭ শতাংশ৷ ফসলের দাম পায় না চাষি৷ জোতদার–মহাজন–ব্যাঙ্কের ঋণের জালে ফেঁসে আত্মঘাতী চাষি–খেতমজুরের মিছিল ক্রমে দীর্ঘতর হচ্ছে৷ অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৮ সালে চাষি–আত্মহত্যার পরিসংখ্যান প্রকাশ করাই বন্ধ করে দিয়েছে৷ এই যখন দেশের অধিকাংশ মানুষের অবস্থা, তখন চাহিদা তথা ক্রয়ক্ষমতা তো কমবেই৷

এই ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টি হল কেন? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে চলমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটির শোষণমূলক চরিত্রের মধ্যেই৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের লক্ষ্য মালিকের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফা হাসিল করা, দেশের মানুষের প্রয়োজন মেটানো নয়৷ মহান কার্ল মার্কস তাঁর যুগান্তকারী তত্ত্বে বিজ্ঞানের সমস্ত শাখার মূল সূত্রগুলি সংযোজনের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিপতিদের মুনাফা আসে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা লুঠ করে নেওয়ার পথ ধরে৷ ফলে মালিকদের মুনাফা লালসায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একদিকে যেমন বাড়তে থাকে শ্রমিক শোষণ, অন্যদিকে খরচ কমাতে ক্রমাগত বাড়তে থাকা প্রযুক্তি–নির্ভরতার কারণে কলে–কারখানায় কমানো হতে থাকে শ্রমিক–কর্মচারীর সংখ্যা৷ যত দিন যায়, পুঁজিমালিক শোষণের জোয়াল আরও জোরদার করতে থাকে৷ একদিকে ফুলে–ফেঁপে উঠতে থাকে মালিকের মুনাফার ভাণ্ডার, পাশাপাশি সংখ্যা বাড়তে থাকে নিঃস্ব রিক্ত সর্বস্বান্ত হতে থাকা ছাঁটাই শ্রমিকের, কাজ না জোটা বেকার যুবকবাহিনী৷ বাড়তে থাকা এই বেকারবাহিনী ক্রমাগত হারিয়ে ফেলতে থাকে ক্রয়ক্ষমতা৷ উৎপাদিত পণ্য কেনাবেচার বাজার ক্রমে ছোট হতে থাকে৷ গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা হাবুডুবু খেতে থাকে বাজারসংকটে৷ মজুরিবিহীন ফাঁকা পকেট৷ তাই চাহিদা নেই শিল্পপণ্যের৷ ফলে স্তব্ধ উৎপাদন৷ পরিণামে আরও ছাঁটাই এবং তার ফলশ্রুতিতে চাহিদার আরও অভাব তথা ভয়াবহ বাজারসংকট৷ আজকের দিনে মরতে বসা পুঁজিবাদ সংকটের এই দুষ্টচক্রে ঘুরে মরছে, বেরোবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না৷ শুধু ভারতে নয়, গোটা বিশ্বেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আজ সংকটগ্রস্ত, মুমূর্ষু৷ মন্দায় ভুগছে জার্মানি, ব্রিটেন সহ ইউরোপের দেশগুলি, এমনকি পুঁজিবাদী অর্থনীতির ইঞ্জিন বলে পরিচিত আমেরিকাও৷ সর্বত্রই ব্যাপক বাজারসংকট৷ একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ভারতের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে গাড়ি, ফ্রিজ, এসি সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নয় এমন দামী পণ্য কেনার ক্ষমতা রয়েছে মাত্র ১০ কোটি মানুষের৷ বাকি ১২০ কোটি মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়৷ আর এই মানুষগুলির ঘাম–রক্ত নিংড়ে মুনাফা লোটে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার মালিক হাতে গোনা শিল্পপতিরা৷ যে ভারতে আজও ধার শোধ করতে না পারা ‘বাঁধা শ্রমিক’ আজীবন সপরিবারে মালিকের কাছে ক্রীতদাসের মতো শ্রম দিয়ে যায়, যেখানে প্রতি বছর গড়ে ১৮ লক্ষ ৩০ হাজার শিশু পাঁচ বছর বয়সে পৌঁছবার আগেই না খেতে পেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, সেই ভারতেরই ১০০ জন পুঁজিমালিকের নাম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনীদের তালিকায় রয়েছে৷

মানুষে মানুষে আর্থিক অবস্থার এই ভয়ঙ্কর বৈষম্য, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আজ দেশের অর্থনীতিকে তলানিতে ঠেলে দিয়েছে৷ প্রবল মন্দার গ্রাসে চলে যাওয়া এ দেশের অর্থনীতিকে এ জায়গায় ঠেলে দিয়েছে খোদ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা৷

পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে মালিকদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব এখন বিজেপির কাঁধে৷ সেই দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালনের জন্য বিজেপির প্রচারে শত শত কোটি টাকা ঢেলেছে পুঁজিপতিরা৷ এখন তা সুদে–আসলে ফিরিয়ে দেবার পালা৷ তাই মন্দায় হাবুডুবু অর্থনীতিকে পাড়ে টেনে তোলার নামে সাংবাদিক সম্মেলন করে গত ২৩ আগস্ট অর্থমন্ত্রী যে সব দাওয়াই বাতলালেন তাতে জনসাধারণের বিন্দুমাত্র সুরাহা এল না, সুবিধা পেল শুধু বহু কোটির মালিক পুঁজিপতিরাই৷ শেয়ার বাজারে লগ্নি থেকে আয়ে যে বাড়তি সারচার্জ ছিল, শিল্পপতিদের চাপের মুখে তা তুলে নিলেন তিনি৷ দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভেও তুলে নিলেন বাড়তি করের বোঝা৷ পাশাপাশি পুঁজিপতিরা বিপুল টাকা ঋণ নিয়ে শোধ না করায় বিপদগ্রস্ত ব্যাঙ্কগুলির পিছনে ঢাললেন ৭০ হাজার কোটি টাকা৷ অর্থাৎ ঋণখেলাপি পুঁজিমালিকদের অসাধুতার মাশুল দিতে ব্যবহার করা হল জনগণের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করা অর্থের একটি অংশ৷ আর কী করেছেন অর্থমন্ত্রী? গাড়ির বাজার চাঙ্গা করতে কিছু নিদান দিয়েছেন যাতে সুবিধা হবে  গাড়ি ক্রেতাদের৷ কিন্তু যে মানুষগুলির, গাড়ি দূরে থাক, চাল ডাল তেল নুন সাবান কিনতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে, যাদের ক্রয়ক্ষমতা না থাকার জন্যই এই বাজারসংকট, তাদের জন্য কী করলেন তিনি? এক কথায়– কিচ্ছু না৷ অর্থাৎ সরকার গোড়া কেটে আগায় জল ঢালার ব্যবস্থাই করল৷ এর দ্বারা পুঁজিপতিরা আরও লাভবান হবে, কিন্তু বাজারের সংকট কাটবে না৷

বোঝাই যায়, এসব টোটকায় কাজ হওয়ার নয়৷ এ সত্য আর কেউ বুঝুক না–বুঝুক, খেটে–খাওয়া মানুষের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি৷ তাই ফিরে তাকালেই চোখে পড়ছে দিকে দিকে বিক্ষুব্ধ জনতার ছবি৷ রাজ্যে রাজ্যে কৃষক–খেতমজুররা ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে৷ রাজপথে বিক্ষোভ মিছিলে সামিল হচ্ছে শোষিত বঞ্চিত শ্রমিক কর্মচারী থেকে শুরু করে শিক্ষক–অধ্যাপক সহ সমস্ত স্তরের মানুষ৷ ঢালাও বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে কল–কারখানায় আওয়াজ উঠছে৷ ফুঁসছেন রেল–কর্মচারীরাও৷ এই পরিস্থিতিতে সংগ্রামী মানুষকে খুঁজে নিতে হবে তার শ্রেণিস্বার্থ রক্ষাকারী উপযুক্ত রাজনীতিকে৷ যে রাজনীতি সংগ্রামী মানুষের কোরবানির ফল ভোটের বাক্সে জমা করার মতলব আঁটে না, তাকে পরিচালিত করে সমস্ত সংকটের মূল এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের লক্ষ্যে, তারই পরিপূরক গণআন্দোলনগুলি আরও জোরদার করার কাজে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৫ সংখ্যা)