মোদি জমানায় কর্মসংস্থানের চেয়ে ছাঁটাইয়ের পাল্লাই ভারি

দেশে চাকরি আছে, না নেই! এ যেন এক ধাঁধাঁ– প্রধানমন্ত্রী নাকি চাকরি দিয়েছেন বছরে ২ কোটি, অর্থাৎ বিগত চার বছরে ৮ কোটি! আর তাঁর মন্ত্রীসভার এক বিশিষ্ট সদস্য নীতিন গড়কড়ি বলছেন, সবাইকে সংরক্ষণ দিয়ে দিলেই বা কী– দেশে চাকরিই নেই যে! বিপাকে পড়ে প্রধানমন্ত্রী স্মরণ নিয়েছেন ইপিএফ এবং ইএসআই–এর৷ কিন্তু যে তথ্যকে ভিত্তি করে তিনি হিসাব মেলাতে গিয়েছিলেন, সেই তথ্যই প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যাচার ফাঁস করে দিয়েছে৷ মোদিজি বলেছেন, এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ৪৫ লক্ষ নতুন চাকরি হয়েছে৷ প্রশ্ন হল এই চাকরি নতুন কী করে? প্রভিডেন্ট ফান্ডের খাতায় নতুন নাম ওঠা মানেই নতুন চাকরি নয়৷ এর বেশির ভাগই অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে সংগঠিত ক্ষেত্রে আসা সংস্থা৷ তা ছাড়া ৪৫ লক্ষ চাকরির দাবিও মিথ্যা৷ গত ১০ মাসে প্রভিডেন্ট ফান্ড সংস্থার খাতা থেকে ৬০ লক্ষ ৪০ হাজার নাম বাদ গিয়েছে৷  ইএসআই–এর খাতা থেকে বাদ গিয়েছে ২৩ লক্ষ৷ এই দুই সংস্থা মিলে বাদ গিয়েছে ৮৩ লক্ষ ৪০ হাজার নাম– যা মূলত ছাঁটাই৷

এছাড়া আরেকটি বিষয়ও লক্ষ্যনীয়, তিন মাস অন্তর কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক চাকরির যে হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছে৷ কেন বন্ধ করল? প্রধানমন্ত্রীর হিসাবের সঙ্গে শ্রমমন্ত্রকের হিসাব মিলছে না বলেই কি এ হেন পদক্ষেপ? অবশ্য পকোড়া ভাজাকে যিনি কর্মসংস্থান বলে দাবি করেছেন তাঁর হিসাব কারও সঙ্গেই মিলতে পারে না৷ প্রধানমন্ত্রীর অকাট্য যুক্তি, যখন দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার এত বেশি, তখন চাকরির বাজার না বেড়ে উপায় কি? রাস্তায় নতুন ট্যাক্সি, বাস, ট্রাক নামছে, সেখানে যাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে তাদেরও তিনি তাঁর তালিকায় লিপিবদ্ধ করেছেন৷ এ ভাবেই প্রধানমন্ত্রী চাকরি দেওয়ার তালিকা বাড়িয়ে চলেছেন৷

প্রধানমন্ত্রীর আরও দাবি, রেকর্ড পরিমাণ বিদেশি লগ্নি আসছে৷ অতএব সেখানেও নিশ্চয়ই কর্মসংস্থান হয়েছে৷ কিন্তু এসব তো সম্ভাবনার কথা৷ চাকরি আক্ষরিক অর্থে কত হল সরাসরি উত্তর দিতে পারছেন না কেন তিনি? কেন তাঁকে গল্পের ছলে সম্ভাব্যতার কথা ছড়াতে হচ্ছে? নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না কেন? কারণ আসলে চাকরি বিশেষ হচ্ছে না৷ বিদেশি লগ্নি কি চাকরি দেওয়ার জন্য এ দেশে আসছে? বিদেশি লগ্নির সিংহভাগই আসছে চালু কারখানার অংশীদারিত্ব কিনতে৷ সেখানে কর্মসংস্থান কোথায়? বরং নানা সংস্কারের খাঁড়ায় শ্রমিক ছাঁটাই চলছে৷ তা ছাড়া যে হিসাবের দিকে মোদিজি কারওর দৃষ্টি নিয়ে যেতে চাইছেন না তা হল, কল–কারখানা বন্ধ বা অন্য কারণে প্রতিদিন কত মানুষ কাজ হারাচ্ছেন সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি–র হিসাব অনুযায়ী মোদিজির নোট বাতিলের পর ১ কোটি ২৬ লক্ষ মানুষ চাকরি খুইয়েছেন৷ তার চেয়েও বড় কথা হল আইএলও–র হিসাব অনুযায়ী ভারতে ৭৭ শতাংশ চাকরির কোনও স্থায়িত্ব নেই৷ এদের বেতনও যেমন স্বাভাবিক জীবন ধারণের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, তেমনি যে কোনও সময় এরা কাজ হারিয়ে পথের ভিখারিতে পরিণত হতে পারেন৷

তা ছাড়া নীতি আয়োগও মেনে নিয়েছে, শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী এ দেশে কাজ মিলছে না, মিলছে না সন্তোষজনক চাকরি৷ মোদি সরকার বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিলেও তা পূরণে কোনও দিশা তাঁদের নেই৷ অন্যদিকে কর্মসংস্থান নিয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী মোদিকে বিঁধলেও কংগ্রেস জমানায় চাকরির প্রতিশ্রুতি একইভাবে ধাপ্পায় পরিণত হয়েছে৷ এ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতি বছর শিল্প সম্মেলন করলেও শিল্পায়ন অধরা৷ অর্থনীতিবিদরাই বলছেন, এ যুগ  বি–শিল্পায়নের৷ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় উৎপাদনের মূল লক্ষ্য মুনাফা, আরও মুনাফা৷ সুপার মুনাফা বাজার সংকটের জন্ম দিয়ে উৎপাদনের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কোনও রাজ্যেই তাই শিল্পায়ন হচ্ছে না৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মেই তা হতে পারে না৷ বেকাররা কাজ পাবে কোথায়? পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বেকাররা জঞ্জাল৷ আতঙ্কের কারণও৷ তাই মিথ্যা আশার ছলনায় ভোলানোই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষক সরকারগুলির ট্র্যাডিশন৷

(৭১ বর্ষ ৫ সংখ্যা ৩১ আগস্ট, ২০১৮)