মেট্রো রেলে ভাড়া বৃদ্ধি অনুচিত

মেট্রোরেলের ভাড়া বৃদ্ধি প্রত্যাহারের দাবিতে ৩ ডিসেম্বর এস ইউ সি আই (সি)-র কলকাতা জেলা সম্পাদক সুব্রত গৌড়ীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল মেট্রোরেলের জেনারেল ম্যানেজারের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন।

কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কলকাতা মেট্রো রেলের ভাড়া দ্বিগুণ করে দিল৷ ভাড়ার নতুন হার অনুযায়ী ৫ টাকায় ২ কিমি পর্যন্ত যাওয়া যাবে৷ অথচ, নোয়াপাড়া থেকে দমদম, দমদম থেকে বেলগাছিয়া সহ বেশ কিছু পরপর দু’টি স্টেশনের দূরত্বই ২ কিমির বেশি৷ সে কারণে, দিনপ্রতি প্রায় সমস্ত যাত্রীর ন্যূনতম ১০ টাকা খরচ বেড়েছে৷ নিত্যযাত্রীদের ক্ষেত্রে মাসে ২৬ দিন যাতায়াত ধরলে অতিরিক্ত খরচ ন্যূনতম ২৬০ টাকা বাড়ছে৷ এসইউসিআই(সি) দল এই ভাড়াবৃদ্ধির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের জন্য ঘোষণার দিন থেকেই আন্দোলন চালাচ্ছে৷

কেন এই ভাড়াবৃদ্ধি? মেট্রোর যাত্রীসংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে৷ সেই অনুযায়ী বাড়ছে তার আয়ের পরিমাণ৷ একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরে কলকাতা মেট্রোর আয় বেড়েছে ৪.৩২ শতাংশ৷ তাহলে ভাড়াবৃদ্ধি করা হল কেন?

এমনিতেই সাধারণ মানুষ চরম মূল্যবৃদ্ধির চাপে দিশেহারা৷ যখন প্রায় প্রতিদিন কোনও না কোনও কল–কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ বেকার, কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে মরছে, তখন এই ভাড়াবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের উপর মারাত্মক আঘাত৷ এটা তো স্পষ্ট যে, এই ভাড়াবৃদ্ধি বহু মানুষকে মেট্রো ব্যবস্থার বাইরে ছুঁড়ে ফেলবে৷ জনস্বার্থ নিয়ে সরকারের ন্যূনতম ভাবনা থাকলে এভাবে তারা মানুষের ঘাড়ে ভাড়াবৃদ্ধির বোঝা চাপাতে পারত কি?

মেট্রো রেল উচ্চবিত্তের বিলাসবাহন নয়৷ দ্রুত যাতায়াতের জন্য গরিব ঠিকা শ্রমিক, সেলসম্যান থেকে শুরু করে হাজার হাজার মানুষ মেট্রো ব্যবহার করে কর্মস্থলে যাতায়াত করেন৷ এর উপর নির্ভর করে অসংখ্য পরিবারের অন্নসংস্থান৷ ফলে মেট্রোর এই ভাড়াবৃদ্ধি এই সমস্ত মানুষের রুটিরুজিতে টান দেবে৷ সমাজে নতুন করে সংকট তৈরি হবে৷

কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মুনাফা অটুট রাখতে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা করছাড় দিয়েছে৷ আবাসন শিল্পের জন্য প্রোমোটারদের ২৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে৷ শিল্পপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্কঋণ মকুব করে দিয়েছে৷ এসব ক্ষেত্রে তার মন উদার, হস্ত দরাজ৷ এসব টাকা তো দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা৷ অথচ পরিবহণের ভাড়া বাড়িয়ে সেই সাধারণ মানুষের পকেট কাটতে সরকারের এতটুকু বাধল না এর চেয়ে অন্যায়, অনৈতিক আর কী হতে পারে?

মেট্রো কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা ছ’বছর ভাড়া বাড়ায়নি, তাই এখন বাড়ানোটা যৌক্তিক৷ অথচ গত ছ’বছরে যাত্রীদের যে দুর্ভোগ তারা বাড়িয়েছে, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ চুপ কেন? ছ’বছর আগে তারা পরিষেবা উন্নয়নের কথা বলেছিল৷ বাস্তবে তার কিছুমাত্র কি হয়েছে? কলকাতা মেট্রোয় দিনে গড়ে ৭ লক্ষের বেশি যাত্রী যাতায়াত করেন৷ তাঁদের দুর্ভোগের সীমা নেই৷ প্রায়ই মাঝরাস্তায় রেক খারাপ হচ্ছে, আলো–পাখা–এসি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অথবা এসির জলে কামরা ভেসে যাচ্ছে, ছুটন্ত ট্রেনে আগুন লেগে যাচ্ছে, গেট খোলা রেখেই ট্রেন চলতে শুরু করছে ইত্যাদি ব্যাপার চলছে তো চলছেই৷ পরিণতিতে গত জুলাই মাসে সজল কাঞ্জিলালের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে, যা পরিষেবার ক্ষেত্রে সরকার ও মেট্রো কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে৷ এছাড়া, মেট্রোতে শৌচালয়ের ব্যবস্থা নেই, পানীয় জলের ব্যবস্থাও যথাযথ নয়৷ বেশ কিছু প্ল্যাটফর্মে এসকালেটর নেই, ফলে বৃদ্ধ বা অসুস্থ সকলকেই ৩০–৩৫ ফুট সিঁড়ি ভেঙে নামতে–উঠতে হয়৷ বারবার দাবি করা সত্ত্বেও এই সমস্ত দিকে মেট্রো কর্তৃপক্ষ কোনও নজরই দেয়নি৷

সুষ্ঠু পরিষেবার জন্য প্রথমত দরকার পর্যাপ্ত পরিমাণে ট্রেন৷ অথচ দিনে গড়ে ২০–২২ টি রেক পাওয়া যায়৷ ফলে অফিস টাইমে লাগাতার ট্রেন বাতিল এবং সময় মতো ট্রেন না চলা একটা মারাত্মক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ দ্বিতীয়ত দরকার পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ কর্মী৷ কলকাতা মেট্রোতে ১৯২ জন ড্রাইভারের মধ্যে ১০০ জনই পূর্ব ও দক্ষিণ–পূর্ব রেল থেকে ধার করা৷ প্রতিটি বিভাগেই বহু পদ খালি পড়ে রয়েছে৷ কর্মীদের অধিকাংশই অস্থায়ী অথবা ঠিকা৷ এভাবে উন্নত পরিষেবা দেওয়া সম্ভব?

সরকারি পরিবহণ কোনও ব্যবসা নয়, জনগণের জন্য রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়িত্ব৷ সে দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে বিজেপি সরকার চরম গাফিলতি করছে৷ এই অন্যায় ভাড়াবৃদ্ধি প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করতে এসইউসিআই(সি) প্রতিটি স্টেশনে যাত্রী কমিটি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে৷ আন্দোলন ছাড়া সাধারণ জনতার কাছে বাঁচার কোনও রাস্তা নেই৷ জোট বেঁধে লড়েই সরকারের অমানবিক, অন্যায় সিদ্ধান্তকে বাতিল করতে হবে৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ১৭ সংখ্যা)