মালিকি শোষণ এবং সরকারের ভূমিকায় আড়াই লক্ষ চটকল শ্রমিকের জীবন বিপন্ন

পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প চটশিল্প৷ তীব্র মালিকি শোষণ ও সরকারের ভূমিকায় এই শিল্পের আড়াই লক্ষ শ্রমিক বিপন্ন৷ এই শিল্পের সাথে যুক্ত চল্লিশ লক্ষ পাটচাষি পরিবারও বিপন্ন হয়ে পড়েছে৷ তীব্র বঞ্চনা, শোষণ, লকআউট, ক্লোজার, লেফ, পিএফ–ইএসআই–গ্রাচ্যুই টাকা আত্মসাৎ, ঠিকা প্রথায় কাজ করানো, অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, বাজার দরের সাপেক্ষে মজুরি না দেওয়া, অর্ধাহার, অপুষ্টি, পেশাবাহিত রোগাক্রান্ত জীবন– এ সবে পিষ্ট চটকল শ্রমিকরা৷

কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের চরম উদাসীনতা, অবহেলা এবং নির্লজ্জ মালিক তোষণকারী নীতির কারণেই এই শিল্পের শ্রমিকদের আজ এই দশা৷ পশ্চিমবাংলার হালিশহর থেকে বজবজ, বাঁশবেড়িয়া থেকে উলুবেড়িয়া গঙ্গানদীর দু’ধারে যে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে সেখানে আজ শ্রমিক জীবন ভয়াবহরূপে আক্রান্ত, বিধ্বস্ত৷ বন্ধ কারখানা মানেই চটকল৷ বন্ধ কল–কারখানার শ্রমিকদের অনাহারে মৃত্যু এবং আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে চটশিল্প সবার আগে৷ কিছু দিন আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া হাওড়া জুটমিলের অসহায় শ্রমিকের গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার পর তাঁর পোশাকের পকেট থেকে বের হয়েছিল মেয়ের বিয়ের কার্ড এবং জলে ভেজা পে–টিকিট৷ কাঁকিনাড়া স্টেশনের রেললাইনে যে শ্রমিকটি গলা দিয়েছিলেন তাঁর পকেট থেকেও গড়িয়ে পড়েছিল প্রায় দেড়বছর বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা নফরচাঁদ জুটমিলের শ্রমিকের পরিচয়পত্র৷ ওড়িশার কটক জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মাইগ্রান্ট শ্রমিক হিসাবে যাযাবরের মতো ঘুরতে ঘুরতে আগরপাড়া জুটমিলের দরজায় রাতের শিফটে কাজ না পেয়ে ফুটপাথের পলিথিন ঘেরা অস্থায়ী আশ্রয়ে ফিরতে পারেননি মধুসূদন– চটকল গেটেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি৷

এমনি করেই কত মাইগ্র্যান্ট শ্রমিক ওড়িশা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে কাজ করতে এসেছিলেন শুধু বাঁচার তাগিদে৷ কিন্তু ভয়াবহ মালিকি শোষণ, ঘন ঘন মালিকি লক আউট, আশ্রয়হীন জীবনের অনিশ্চয়তায় আবার তাঁরা চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন অন্যত্র– একটু বাঁচার মতো মজুরির আশায়৷ মালিকরা ইচ্ছেমতো বন্ধ করে দিল টিটাগড়ের কেলভিন জুটমিল, লুমটেক্স জুটমিল, নদিয়া জুটমিল, হুগলির ইন্ডিয়া জুটমিল এবং গোন্দলপাড়া জুটমিল৷ আশঙ্কা এবং অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ডুবে গেল প্রায় কুড়ি হাজার শ্রমিক পরিবার৷

মালিকরা কেন মিল বন্ধ করছে? চটশিল্প কি লোকসানের শিকার? জুট মিল মালিকদের লোকসান হওয়ার কোনও কারণই নেই৷ চটশিল্পে প্রায় সত্তর শতাংশ চটের ব্যাগের ক্রেতা কেন্দ্রীয় সরকার৷ চটকল মালিকরা সরকারের কাছে উৎপাদন খরচ বেশি করে দেখায়৷ যেখানে ১ টন মাল উৎপাদন করতে ৪০ জন শ্রমিক লাগে, সেক্ষেত্রে সরকার দেয় সমস্ত ফ্রিঞ্জ বেনিফিট সহ ৪০ জন শ্রমিকের পূর্ণ মজুরি৷ অথচ বাস্তবে ওই ৪০ জন শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ পার্মানেন্ট শ্রমিক যারা পূর্ণ মজুরি এবং ফ্রিঞ্জ বেনিফিট পাচ্ছেন৷ বাকি ৮৫ শতাংশ মজুরই হয় বদলি নয় তো ঠিকা শ্রমিক– যাঁদের পার্মানেন্ট শ্রমিকদের মতো কোনও মজুরি বা বেনিফিট নেই৷ এভাবেই হিসাবের কারচুপি করে মালিকরা মুনাফা লোটে অত্যধিক৷ 

গত ২ এপ্রিল চটশিল্পের ত্রিপাক্ষিক এগ্রিমেন্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে নতুন চার্টার অফ ডিমান্ড বা দাবি সনদ পেশ করেছে৷ এবারের মূল দাবি আঠারো হাজার টাকা মাসিক মজুরি, তিন হাজার টাকা ন্যূনতম পেনশন, সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত শ্রম আইনগুলির কঠোর প্রয়োগ, ঠিকা শ্রমিক বন্ধ করা, স্থায়ী কাজে স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ এবং সর্বোপরি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী চটশিল্পে ৯০ শতাংশ পার্মানেন্ট এবং ২০ শতাংশ স্পেশাল বদলি শ্রমিক রাখার সিদ্ধান্ত রূপায়ণ করা৷ এই ন্যায়সঙ্গত এবং আইনসম্মত দাবিগুলি নিয়ে সনদ পেশ করার ৬ মাস পরও রাজ্যের তৃণমূল সরকারের শ্রমমন্ত্রী কোনও ত্রি–পাক্ষিক মিটিং ডাকেননি৷ শ্রমিকদের যৌথ দরকষাকষির অধিকার যেটা এতদিন যাবত বলবৎ ছিল, তার অধিকার অকার্যকারী করে দেওয়ার জন্যই সরকারের এই নীরবতা৷ এই ঘটনা আবারও দেখাল শ্রমিকদের প্রতি তৃণমূল সরকার কত উদাসীন৷

সিপিএম যখন এ রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল, তার ভূমিকাও ছিল অনুরূপ৷ ২০০২ সালের ত্রি–পাক্ষিক চুক্তিটিও ছিল মালিক শ্রেণির কাছে শ্রমিকদের আত্মসমর্পণের একটি  নির্লজ্জ চুক্তি যা সিটু এবং আই এন টি ইউ সি–র নেতৃত্বে স্বাক্ষরিত হয়েছিল৷

সেই সময় চটশিল্পের মালিকদের সুরে সুর মিলিয়ে সিটু চটশিল্প বাঁচানোর স্লোগান তুলে বলেছিল, শ্রমিকদের ‘স্যাক্রিফাইস’ অর্থাৎ আত্মত্যাগ করতে হবে৷ এই আত্মত্যাগের ফল কী দাঁড়াল? ১৭২ টাকার দৈনিক মজুরি কালা চুক্তির মধ্য দিয়ে হয়ে গেল ১০০ টাকা৷ এবং এই চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি শ্রমিকের এক–তৃতীয়াংশ মজুরি উৎপাদনের সাথে যুক্ত করা হল৷ এই উৎপাদনভিত্তিক মজুরি শ্রমিকদের মধ্যে ‘কাটৌতি’ হিসাবে কুখ্যাত হয়ে গেল৷

এ আই ইউ টি ইউ সি তথা বেঙ্গল জুট মিলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন এই কালা চুক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর না করে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে৷ কালা চুক্তি স্বাক্ষর করে সিটু ও সহযোগীরা চটকল ধর্মঘট থেকে সরে গেলেও শ্রমিকরা এ আই ইউ টি ইউ সি–র নেতৃত্বে আরও ১৭ দিন ধরে ধর্মঘট চালিয়ে যায়৷ সেই আন্দোলনের ফলে ‘উৎপাদনভিত্তিক মজুরি নীতি’ বাতিল হয়৷ আপসকামী নেতৃত্বের আত্মসমর্পণের পথ ছেড়ে দিয়ে চটকল শ্রমিকদের আবারও ঘুরে দাঁড়াতে হবে ঐক্যবদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী আপসহীন আন্দোলনের পথে৷ এটাই মালিকি শোষণ–বঞ্চনা থেকে  মুক্তির রাস্তা৷

(৭১ বর্ষ ৯ সংখ্যা ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)