ভোট আসে ভোট যায় মানুষের জলসংকট বাড়ে

ভোট আসে ভোট যায় মানুষের জলসংকট বাড়ে, জল–ব্যবসায়ীরা মুনাফার পাহাড় জমায়

বছর দুয়েক আগে প্রবল তৃষ্ণায় গভীর কুয়ো থেকে জল তুলতে গিয়ে মহারাষ্ট্রের ভিদা গ্রামের দশ বছরের শচীন কেনজারের মারা যাবার ছবি দেখে শিউরে উঠেছিল মানুষ৷ খরার সময় ভারতের জলসংকটের ভয়াবহতা যে কী মারাত্মক হতে পারে, তা দেখিয়ে দিয়েছিল এই ছবি৷ শুধু কি খরার সময় জলসংকট! রাজস্থানের ঢোলপুরে কুদিন্না গ্রামের শান্তারা গত ৪০ বছর ধরে মাথায় হাঁড়ি নিয়ে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে চলেছেন শুধুমাত্র আধহাঁড়ি জল সংগ্রহ করতে৷ সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু প্রতি রাতে জলের খোঁজে শান্তাদের হেঁটে চলা থামে না৷ অথচ মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে চম্বল নদী৷ স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও কোনও দেশপ্রেমিক (!) সরকারের মনে পড়ল না সামান্য পাইপলাইন স্থাপন করে ওই এলাকার মানুষকে, রাজভোগ–বিরিয়ানি নয়, একটু জল দেওয়ার কথা৷ এটা শুধু কোনও একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের ছবি নয়, সমগ্র দেশ জুড়েই এই অবস্থা৷ আমাদের রাজ্যও বাদ নেই৷

বিশুদ্ধ জল পাওয়া মানুষের অন্যতম অধিকার৷ অথচ পরিবেশবিদদের মতে দেশে পরিস্রুত পানীয় জল থেকে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি৷ স্বাধীনতার সময়ে জনপ্রতি জল পাওয়া যেত বছরে ৬০৪২ ঘনমিটার৷ তা ক্রমাগত কমতে কমতে ২০১৬–তে দাঁড়িয়েছে জনপ্রতি বছরে ১৪৯৫ ঘনমিটার৷ এক্ষেত্রে ভারতের থেকে এগিয়ে আছে নাইজিরিয়া এবং ইথিওপিয়াও৷ মোদি সরকারের আমলে গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু দিনে চল্লিশ লিটার পরিস্রুত জল দেওয়ার প্রকল্পও মুখ থুবড়ে পড়েছে৷ ভারত এই মুহূর্তে ইতিহাসের প্রবলতম জলসংকটের মুখোমুখি৷ সম্প্রতি নীতি আয়োগের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৬০ কোটির ওপর ভারতীয় ভয়ঙ্কর সংকটের সম্মুখীন৷ প্রতি বছর কমপক্ষে দু’লক্ষ মানুষ পানীয় জল সংকটে মারা যায়৷ আগামী দিন আরও ভয়ংকর৷ ২০৩০–এর মধ্যে জল সরবরাহ দ্বিগুণ না বাড়ালে আরও লাখো লাখো মানুষ জলসংকটের মুখোমুখি হবে৷ ‘কম্পোজিট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনডেক্স’ শীর্ষক ওই রিপোর্টটি প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রী নীতিন গড়কড়ি৷ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে দেশের ২১টি প্রধান শহর প্রবল জলসংকটের সম্মুখীন হবে৷ এর ফলে, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ১০ কোটি ভারতীয়৷

একদিকে জলসংকটে জেরবার হচ্ছে সাধারণ মানুষ, অপরদিকে সেই সংকটকে কাজে লাগিয়ে মুনাফার পাহাড় জমাচ্ছে মিনারেল ওয়াটার ব্যবসায়ীরা৷ এক লিটার জলকে বোতলবন্দি করতে ৫ লিটার জল খরচ হয়৷ অর্থাৎ ৪ লিটার নষ্ট৷ এতে খরচ হয় ৩ থেকে ৪ টাকা৷ অথচ বাজারে বিক্রি হয় লিটার পিছু ১৫ থেকে ২০ টাকায়৷ একদিকে বিশাল জলসংকট অন্যদিকে তাকে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার জলের ব্যবসা৷ সাধারণ মানুষের সর্বনাশ আর জল ব্যবসায়ীদের পৌষ মাস৷

ভোট এলে রাজনৈতিক দলগুলি অন্যান্য সমস্যার মতো পানীয় জলের সমস্যা মেটাবারও আশ্বাস দেয়৷ কিন্তু বাস্তবায়িত হওয়া দূরের কথা, সমস্যা আরও বাড়ে৷ ভারতের মতো নদীবহুল দেশে এইরকম জলসংকট কেন? ১৯০ হাজার কোটি ঘনমিটার ক্ষমতাসম্পন্ন নদ–নদীর মাত্র ৭০ হাজার কোটি ঘনমিটার জল আমরা ব্যবহার করি৷ বাকিটা চলে যায় সমুদ্রে৷ কেন তাকে কাজে লাগানো যায় না? আসলে একে কাজে লাগাতে গেলে দরকার জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা আর পরিকল্পনা, যে দুটোরই অভাব রয়েছে সরকারের৷ শুধু কি তাই? উদারীকরণের আর্থিক নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুরু হয় দেশের মানুষের প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডারগুলি লুটে নেওয়ার জন্য বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া৷ ২০০২ সালে বিজেপি সরকারের আমলে জাতীয় জলনীতিতে যে পরিবর্তন আনা হয় ২০১২ সালে কংগ্রেস সরকার তা সম্পূর্ণ করে৷ দেশের জলসম্পদের ভাণ্ডারকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ব্যক্তিপুঁজির জন্য৷ মুনাফার গন্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশি–বিদেশি পুঁজিপতিরা৷ সকলকে বিনামূল্যে পানীয় জল সরবরাহের গুরুদায়িত্ব থেকে ধীরে ধীরে সরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ মানুষ ক্রমাগত হারাতে থাকে জলের ওপর তার ন্যায্য অধিকার– সমুদ্রের জলে, জলের পাড়ে সাগর–জেলেদের অধিকার, নদীর জলে মৎস্যজীবী, মাঝি, নদীতীরবাসীদের অধিকার৷ জল হারিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ চাষের জমির তলার জল৷ সবুজ বিপ্লবের নামে কৃষিক্ষেত্রে এমন বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হল যাতে জল লাগল অনেক বেশি৷ আগে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সেচব্যবস্থার উন্নতির কথা বলা হলেও আজ আর তা শোনা যায় না৷ যত পার জল টান মাটির তলা থেকে৷ বৃষ্টির জল বা স্বাভাবিক সেচের জলের বদলে শ্যালোর জল, তা না পেলে ডিপ টিউবওয়েলের জল৷ অন্য দিকে পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন আর নগরায়ণের ফলে জলাশয়, জলাধার, জলাভূমি রাতারাতি বদলে গেল মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংয়ে৷ সামাজিক বিষয়, সামাজিক মালিকানার ‘জল’ বদলে গেল ব্যক্তির বিষয়ে, ব্যক্তির অধিকারে থাকা জলে৷

আবার যতটুকু জল সরবরাহ হচ্ছে তাতেও অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো রয়ে গেছে বৈষম্য৷ ‘দ্য ন্যাশনাল কমিশন অন আর্বানাইজেশনে’র রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে জল সরবরাহ প্রবল বৈষম্যমূলক, যা ধনী ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালীদের স্বার্থে পরিচালিত৷ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের বাস গ্রামে৷ চাহিদা এখানে বেশি অথচ সরবরাহ অনেক কম৷ শহরাঞ্চলে দৈনিক ১৩৫ লিটার আর গ্রামে ৪০ লিটার৷ মহারাষ্ট্রে গ্রামের থেকে শহরের মানুষ ৪০০ শতাংশ বেশি জল পায়৷ দিল্লিতে বেশিরভাগ বস্তিতে জল দেওয়ার কোনও সরকারি পাইপ লাইন নেই৷ গ্রামে ১৭.৯ শতাংশ আর শহরে ৬২ শতাংশ বাড়িতে পাইপলাইনের মাধ্যমে জল সরবরাহ করা হয়৷ কলকাতাও এর বাইরে নয়৷ এখানে দৈনিক গড়ে ২০০ লিটার জল সরবরাহ হলেও বস্তিবাসী মানুষ পায় গড়ে মাত্র ৫০ লিটার৷

জলের এই অভাব ও সমস্যার বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি এর আসল কারণ অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও দূষণের কারণের দিকে আমরা দৃষ্টি না দিই৷ ২০০৪–এ ‘দ্য সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ (সিএসই)–এর একটি রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার যে ভারতে সব থেকে বেশি জল ব্যবহার করে বড় শিল্পগুলো, যা বড় বড় শিল্পপতিদের মালিকানাধীন৷ এর মধ্যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি ব্যক্তিমালিকানাধীন– আদানি পাওয়ার, জিন্দাল পাওয়ার প্রভৃতি৷ ভারতের সিংহভাগ জল অপচয় এবং দূষণ এদের সৃষ্টি৷ এদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বা দূষণের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় তো দূরের কথা, কিছু দূষণরোধী ব্যবস্থা নিলেই পুঁজিপতিদের পুরস্কার (ইনসেন্টিভ) দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে সরকার৷ অপর দিকে নাগরিকদের যে জল সরবরাহ করা হচ্ছে তার ৭০ শতাংশ দূষিত৷ জলের গুণমান সূচকে বিশ্বে ১২২টি দেশের মধ্যে ভারত ১২০তম স্থানে৷ সেই দূষিত জল পান করে মানুষের রোগ হচ্ছে৷ দেশে ৭২ শতাংশ রোগের কারণ বিশুদ্ধ জল সরবরাহে সরকারি ব্যর্থতা৷ আর সেই রোগের চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবসায়ীদের বছরে ১০ লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা৷ বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করলে এই ব্যবসার কী হবে? দুষ্টচক্রের চেহারাটি বুঝতে অসুবিধা হয় কি?

সমস্যার মূলে না গেলে সমাধান সম্ভব নয়৷ জলের ক্ষেত্রেও প্রশ্নটা আসলে মালিকানার৷ যতদিন পর্যন্ত সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান না ঘটবে, ততদিন সমস্যা বাড়বে যেমনটা বাড়ছে৷ উদারীকরণের বিষময় ফল হল পৃথিবীর সমস্ত সম্পত্তির একচেটিয়া অধিকার৷ জলেরও৷ জলের অভাবের প্রধান কারণ অসম বণ্টন ও অপচয়৷ যতদিন জলের ওপর ব্যক্তিমালিকানার অবসান হয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা না হবে ততদিন অপচয়, দূষণ আরও বাড়বে, বাড়বে অসাম্য আর জলসংকট৷ জলের অভাবে দীর্ঘতর হবে মৃত্যুমিছিল৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ২১ সংখ্যা)