ভোটের স্বার্থেই মুঘলসরাইয়ের নাম পরিবর্তন

 

প্রস্তাব এবং পরিকল্পনা ছিল আগেই, বাকি ছিল রূপায়ণ৷ ৫ আগস্ট তা–ও সম্পন্ন হল৷ এদিন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার ঐতিহাসিক মুঘলসরাই স্টেশনের নাম বদলে দিল৷ আরএসএস নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে স্টেশনের নতুন নামকরণ হল৷

১৮৮৩ সালে পরাধীন ভারতে এই গুরুত্বপূর্ণ জংশন স্টেশনটি তৈরির সময় ছোট এই শহরটির নাম ছিল মুঘলচক বা মুঘলসরাই৷ জানা যায় মুঘল আমলে সম্রাট হুমায়ুনের সেনাবাহিনী বাংলার সুবেদার শের শাহ সুরির বাহিনীকে বিহারের দিকে তাড়া করার পথে ওখানে ডেরা ফেলেছিল৷ তা থেকেই মুঘলসরাই নামটি লোকমুখে ছড়িয়ে যায়৷ রেল স্টেশন গড়ে ওঠার সময় স্বাভাবিকভাবেই এই নামটিই গৃহীত হয়৷ ১৩৫ বছরের এই ইতিহাসকে হঠাৎ পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হয়েছে বিজেপি সরকার৷ ১৯৬৮–র ফেব্রুয়ারিতে এই মুঘলসরাই স্টেশনের কাছে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় দীনদয়াল উপাধ্যায়কে৷ সেই যুক্তিতে স্টেশনটির নাম তাঁর নামে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা৷

কোনও স্থান, প্রতিষ্ঠান, সড়ক, স্টেশন ইত্যাদির নাম পরিবর্তন করা যেতেই পারে৷ কোনও ব্যক্তির নামে নতুন নামকরণ করতে গেলে বিচার্য কী হওয়া উচিত? এ ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবেচনা করা দরকার সমাজ–সভ্যতার অগ্রগতিতে তাঁর ভূমিকা কী৷ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর ইতিহাসগত অবস্থান ও জনমনে তাঁর স্থান– বিচার করা প্রয়োজন এগুলিও৷ এক্ষেত্রে কোন বিচারে বিজেপির এই সিদ্ধান্ত, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে৷

কে ছিলেন এই দীনদয়াল উপাধ্যায়? আরএসএস দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য যে জনসংঘ তৈরি করেছিল, যা নাম বদলে বিজেপি হয়েছে, তিনি ছিলেন তার সভাপতি৷ আরএসএসের কর্মী হিসাবে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন৷ আরএসএস–এর আদর্শে অনুপ্রাণিত জনসংঘের বক্তব্য ছিল, যারা অন্তরে হিন্দুত্বের গৌরব বহন করে না তারা দেশের শত্রু৷ দীনদয়াল উপাধ্যায় আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন চিন্তার বিরোধিতার পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রসার ঘটাতেই কাজ করে গেছেন৷ এ হেন প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার ধারক–বাহকের নামে স্টেশনের নাম রাখার একটিই উদ্দেশ্য থাকতে পারে– হিন্দু জাতীয়তাবাদের আইকন হিসেবে তাঁকে দাঁড় করানো৷ ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিপথে যে মুঘলসরাই নামটি এসেছে, তাকে ভুলিয়ে দিয়ে প্রগতিবিরোধী এক ব্যক্তির নামকে দলীয় স্বার্থে জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া৷ এ–ও তো একপ্রকার ইতিহাস বিকৃতি দলের ইতিহাসে দেশমান্য নেতার অভাব এভাবেই পূরণ করতে চাইছে বিজেপি৷ কোথাও বল্লভভাই প্যাটেলের বিশাল উঁচু মূর্তি স্থাপন করে, কোথাও দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামে স্টেশনের নাম রেখে দেশের ইতিহাসে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চাইছে তারা৷ চাইছে গায়ের জোরে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে৷

চার বছরের বিজেপি শাসনে দেশে অর্থনৈতিক শোষণ–নিষ্পেষণ তীব্র আকার নিচ্ছে৷ বাধাহীনভাবে বাড়ছে কর–মূল্যবৃদ্ধির প্রকোপ৷ বেকারি চরম আকার নিয়েছে৷ ‘আচ্ছে দিন’, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মতো নিত্যনতুন স্লোগানের রঙিন আস্তরণ খুলে একে একে সবগুলোরই খড়ের কাঠামো বেরিয়ে পড়ছে৷ এই অবস্থায় মানুষকে ভুলিয়ে ভোটব্যাঙ্ক অক্ষত রাখতে আস্তিন থেকে হিন্দুত্ববাদের পুরনো অ্যাজেন্ডাই বের করতে হচ্ছে তাদের৷ যে রাজ্যে যেভাবে সম্ভব সেইভাবেই ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক বিভেদ, ধর্মীয় অস্থিরতা সৃষ্টির তোড়জোড় চলছে৷ ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে ওরা বলছে ঐতিহাসিক তাজমহল নাকি ছিল হিন্দু মন্দির তেজোমহল৷ ভেঙে ফেলা হচ্ছে আম্বেদকরের মূর্তি৷ শিক্ষাঙ্গনে, সিলেবাসে হিন্দু ধর্মাচরণ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে৷ কখনও নমাজ বন্ধের ফতোয়া জারি করে, গো–হত্যা বন্ধ করে মুসলিম জনগণকে আতঙ্কিত করে রাখা হচ্ছে৷ মুঘলসরাইয়ের নাম পরিবর্তনও এই ধারাতেই এসেছে৷ ভোটসর্বস্ব দেউলিয়া রাজনীতির স্বার্থে এটি বিজেপির আরেকটি অপকর্মের নিদর্শন৷

(৭১ বর্ষ ৬ সংখ্যা ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)