বুদ্ধিজীবী ধরিবার তামাশা চলিতেছে

বহু বৈচিত্র্যময় প্রতিযোগিতার কথা আমরা জানি৷ দেশ–বিদেশে প্রচলিত অদ্ভুত অদ্ভুত অনেক প্রতিযোগিতার কথা আমরা শুনিয়াছি৷ কিন্তু রাজনৈতিক দলের নেতাদের বুদ্ধিজীবী ধরিবার প্রতিযোগিতার কথা বোধহয় ইতিপূর্বে কেহ শুনেন নাই৷ বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি দলের মধ্যে এই খেলাটি শুরু করিয়াছেন৷ তিনি নিজে এই খেলার একজন খেলোয়াড়ও বটেন৷ তিনি ঘোষণা করিয়া খেলিতে শুরু করিয়াছেন, নাকি খেলা শুরু করিয়া ঘোষণা করিয়াছেন–এ প্রশ্ন অমীমাংসিত রাখিয়াই বলা যায়, খেলা কিন্তু দেশ জুড়িয়া শুরু হইয়া গিয়াছে৷

বিজেপির দাবি, এক এক জন নেতাকে পঁচিশ জন করিয়া বুদ্ধিজীবী খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে, তাঁহাদের সমর্থন প্রত্যাশা করিতে হইবে৷ বিগত চার বৎসরে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যাহা যাহা কর্ম করিয়াছেন, তাহার সুফল কী কী, এ সকল বিস্তারিত বিবরণসহ  পুস্তক সকলের হাতে তুলিয়া দিতে হইবে৷ ভাগ্যিস অপকর্মের তালিকা সম্পর্কিত পুস্তকটি ছাপা হয় নাই ওটি তো সর্ববৃহৎ এনসাইক্লোপিডিয়াকেও বহরে ছাড়াইয়া যাইত লইয়া ঘুরিতেন কেমনে?

যাহা হউক, খেলাটির নাম ‘সমর্থনের জন্য সম্পর্ক’৷ অমিত শাহ সমর্থনের জন্য সম্পর্ক স্থাপন করিতে গিয়াছেন মুকেশ আম্বানির সহিত৷ সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ যে আদানি–আম্বানিদের অঙ্গুলি হেলনেই চলিতেছে এই সরকার এবং আমজনতাকে ঠকাইবার, লুঠ করিবার নিত্য নতুন ফন্দি–ফিকির বাহির করিতেছে, তাঁহাদের কাছেই অমিত শাহ গিয়াছেন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়ার কছেও সভাপতি মহোদয় যাইতেন, কিন্তু মুশকিল হইল উহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইলে জনগণ তলায় তলায় থাকা সম্পর্কটি ধরিয়া ফেলিতে পারে৷ দেশের এ হেন সুসন্তানেরা এখন বিদেশে থাকেন৷ তবে তাঁহাদের সমর্থনের জন্য সম্পর্ক স্থাপনের বিশেষ প্রয়োজন নেই, বিজেপিস্থিত মাসতুতো ভাইদের সহিত তাঁহাদের সু–সম্পর্কের কারণেই উহারা সরকারকে সমর্থন করিবেন৷

অমিত শাহ সম্পর্ক স্থাপন করিতে গিয়াছেন বাবা রামদেবের সঙ্গে৷ সেই রামদেব যিনি বিজেপি সরকারের কৃপাধন্য হইয়া হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা বাড়াইয়া লইয়াছেন, সেই রামদেব যিনি দিল্লির রামলীলা ময়দানে আন্না হাজারের দুর্নীতি বিরোধী মঞ্চ হইতে পুলিশের ভয়ে ছেঁড়া সালোয়ার  পরিয়া য পলায়তি … যোগমন্ত্র জপিয়াছিলেন ধন্য দেশোদ্ধারকারী বাবা আর বাবার সন্তানেরা, উহাদের আরও শ্রীবৃদ্ধি হউক অমিত শাহ আরও দুই বাবার কাছে হয়তো যাইতেন, কিন্তু বাবা রামরহিম  আর আশারাম বাপু সাধনায় সিদ্ধি লাভ করিয়া বর্তমানে কৃষ্ণালয়ে আছেন, উহাদের সহিত তাই প্রকাশ্যে সম্পর্ক বজায় রাখা যাইতেছে না৷ উহাদের সহিত গভীর গোপন সম্পর্ক বজায় রহিয়াছে এ কথা সত্য, কিন্তু প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুসারে উহারা গুণতিতে আসিবেন না৷

তবে গোল বাধিয়াছে বিজেপির বঙ্গীয় নেতাকুলের বুদ্ধিজীবী খুঁজিয়া বাহির করিবার বেলায়৷ নেতা পিছু পঁচিশ জন বুদ্ধিজীবী খুঁজিয়া বাহির করা দুষ্কর হইয়া উঠিয়াছে৷ একে তো স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় হইতেই বড় গলা করিয়া বলিবার মতো কোনও কিছু আরএসএস–বিজেপির ভাণ্ডারে নাই৷ তার উপর, নামডাকওয়ালা বুদ্ধিজীবীর তুলনায় বিজেপির নেতা বেশি হইয়া গিয়াছে, ফলে বুদ্ধিজীবীদের সহিত সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কাড়াকাড়ি পড়িয়া গিয়াছে৷ কে কাহার আগে গিয়া একজনকে ছুঁইয়া ফেলিতে পারিল, তাহারই তামাশা চলিতেছে৷ এক নেতা সকাল দশটায় সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ করিয়াছেন জানিয়া, অপর নেতা প্রাতঃভ্রমণ কালেই সেই বুদ্ধিজীবীকে ছুঁইয়া ফেলিয়া প্রতিযোগিতায় নম্বর বাড়াইয়া লইল৷ বুদ্ধিজীবীদের কেহ কেহ সাক্ষাতের প্রার্থনা শুনিয়া অসুস্থ হইয়া পড়িতেছেন, কেহ বা ‘আসুন–বসুন–জল খান–চা খান’ বলিয়া ল্যাটা চুকাইয়া দিতেছেন৷ বাংলা তথা দেশের জনগণ বেশ মজা উপভোগ করিতেছেন৷ সমস্যা জর্জরিত মানুষ খানিক কমিক রিলিফ পাইতেছেন৷

কিন্তু বুদ্ধিজীবী ধরিয়া কী হইবে? বহু যত্নে বিজেপি এ ধুলিময় কর্দমাক্ত ভারত দেশটিকে গোময় লেপিত পুণ্য হিন্দুভূমিতে পরিণত করিবার লক্ষ্যে কোমর বাঁধিয়া নামিয়া গো–রক্ষার পবিত্র কর্তব্যের খাতিরে নরহত্যা সংগঠিত করিয়া, একবিংশ শতকে প্রাচীন হিন্দুত্বের গরিমা গাথায় দিগ্বিদিক কাঁপাইয়া আশা করিতেছিলেন, দেশের বুদ্ধিজীবীগণ এই পবিত্র অভিযানে সামিল হইবেন৷

সামিল না হইলে তাঁহারা করিবেনই বা কী? বিজেপির যে এমন কোনও মুখ নাই যেথা হইতে নিঃসৃত বাণীতে মানুষের বিশ্বাস জন্মাইতে পারে তাঁহাদের বঙ্গ ব্রিগেডের সভাপতি মশাই থেকে শুরু করিয়া খোদ জাতীয় সভাপতি পর্যন্ত মুখ খুলিলেই যে দুর্গন্ধ ছোটে তাহা মানুষের সব মোহ কাটাইয়া দেয়৷ অতএব বুদ্ধিজীবী চাই, যাঁহারা সাজাইয়া সাজাইয়া কিছু কথা মানুষকে বিশ্বাস করাইতে পারিবেন তাহার উপর কিছু ‘অপবিত্র’ বুদ্ধিজীবীর গলা কাটিতে না কাটিতেই যে হইচই উঠিয়াছে তাতে পবিত্র কর্তব্য যায় বুঝি নাগপুর হইতে সাজিয়া যে ছিলিমগুলি বিতরিত হইবার অপেক্ষায় তাহা জনগণের হাতে তুলিয়া দিবার এজেন্ট চাই তো!

তবে এই তামাশা বর্তমানে বুদ্ধিজীবীদের কাছে উৎপাত হইয়া দাঁড়াইয়াছে৷ মুহূর্মুহূ বার্তা ছুটিয়া আসিতেছে দেখা করিবার জন্য, কে প্রথম কাছে আসিবে, আসিয়া নিজের জীবন ধন্য করিবেন, দলীয় প্রতিযোগিতায় নিজ রাজনৈতিক কেরিয়ারের নম্বর যোগ করিবেন, এই উৎপীড়নে বুদ্ধিজীবীরা আতঙ্কিত হইয়া উঠিতেছেন৷ দেশ জুড়িয়া এই রঙ্গ–তামাশা দেখিয়া সাধারণ বুদ্ধিতে এইটুকু বুঝিতে পারা যায়, তাহার জন্য বুদ্ধিজীবী হইতে হয় না, বিজেপি নেতা–মন্ত্রীদের দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া বুদ্ধিজীবী ধরিবার এই খেলায় জনস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নাই৷ ইহাতে রামা কৈবর্ত্য কিংবা রহিম শেখের জীবনের কোনও হেরফের হইবে না৷

(৭০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা ২৯ জুন, ২০১৮)