বিপন্ন কৈশোর

লখনউয়ের এক স্কুলে সাত বছরের এক ছাত্রী ছুরির আঘাতে ক্ষত–বিক্ষত করার চেষ্টা করে ওই স্কুলেরই এক ছাত্রকে৷ ছাত্রীটি ভেবেছিল এমন একটা কিছু করতে হবে, যাতে স্কুল ছুটি হয়ে যায় এবং সে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারে৷ প্রায়শই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে চলেছে একের পর এক এই ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা৷ স্কুলের ভিতরে বা বাইরে ছাত্র–ছাত্রীরা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক ও অসামাজিক কাজকর্মে৷

কেন ঘটছে এই ধরনের ঘটনা? প্রতিটি শিশুই তো সামাজিক জীব, তার বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাও সমাজের সাথে যুক্ত৷ যে সমাজ পরিবেশে সে বড় হয়, সেই পরিবেশের সাথে শিশুটির মস্তিষ্কের ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই তার চিন্তার স্ফূরণ ঘটে৷ গড়ে ওঠে যুক্তিবোধ৷ পরিবার ও স্কুলের বড়দের সাথে মেলামেশার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে সে বিভিন্ন ধারণার অধিকারী হয়৷ ক্রমাগত সমাজের নানা ভাল–মন্দ বুঝতে শেখে৷ ছোট্ট বয়স থেকেই শিশুটিকে সামাজিক সম্পদ হিসাবে দেখা ও তার মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা গড়ে তোলা, বিবেক–মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো বা ইতিহাসের বিভিন্ন সত্য ঘটনা ও বড় মানুষদের চরিত্রের সাথে পরিচয় করানোর অত্যন্ত আবশ্যিক কাজটি বড়দেরই করতে হয়৷ কোনও ব্যক্তির মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ও মর্যাদাবোধের যে ‘বাঁচা’ আমরা দেখি তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট বয়সের শিক্ষার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে৷

অথচ আমরা দেখছি বর্তমান অবক্ষয়ী এই সমাজ তার টিকে থাকার স্বার্থেরই পরিপূরক সমাজ মনন গড়ে তুলতে চাইছে৷ চিন্তা–চেতনা–সংস্কৃতি এমনভাবে তৈরি করছে যাতে আমরা নিজেদের অজান্তেই এই পচাগলা ব্যবস্থার সেবাদাসে পর্যবসিত হয়ে উঠি৷ পত্র–পত্রিকা–টিভি–মোবাইল-ইন্টারনেট প্রভৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন কদর্য জিনিসের যে ব্যাপক প্রসার ঘটছে, আমাদের ঘরের ছেলে–মেয়েরা অতি সহজে তার শিকার হচ্ছে৷ অন্য দিকে গোটা সমাজকে ঘিরে রেখেছে অনিশ্চয়তার এক কালো মেঘ৷ একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে বড় হওয়ার সমগ্র প্রক্রিয়াতে স্তরে স্তরে রয়েছে অনিশ্চয়তা৷ শিশুটির বেঁচে থাকা, শিক্ষার সুযোগ পাওয়া, পাশ করা, চাকরি পাওয়া বা চাকরিতে টিকে থাকা–সব কিছুই অনিশ্চিত৷ আর এটাই বাবা–মাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে৷

সারাদিন শিশুটির সব কিছু নিখুঁতভাবে দেখাশোনা করার কাজটা বাবা–মাকে ব্যস্ত করে তোলে৷ পড়া–শোনা, নাচ–গান, সাঁতার প্রভৃতি কাজে শিশুটি যাতে সারাক্ষণ লিপ্ত থাকে এবং এতটুকু সময় অপচয় না হয় তা সুনিশ্চিত করতে অভিভাবকদের তৎপতার শেষ থাকে না৷ সবসময় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা–ভিভাবকদের তাড়িয়ে বেড়ায়৷ এই আশঙ্কা তারা এই সমাজ থেকেই পায়৷ ফলে শিশুটির সামনে স্বাভাবিক বিকাশ, খেলা–ধূলা, নির্মল বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সামান্য অবকাশও থাকে না৷ অবকাশ খোঁজার, আনন্দ পাওয়ার জন্য এমন কিছু আচরণ সে করে যা ওই বয়সে তার করার কথা নয়৷ তাই ব্রিজে হাঁটতে হাঁটতে এক বন্ধু অপর বন্ধুকে রেলিং থেকে জল দেখতে বলে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়৷ এটা তার কাছে অন্যায় মনে হয় না৷ সে মনে করে সিগারেট খেয়ে যেমন ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়, এটাও ঠিক তাই৷ অথবা শহরের নামী সরকারি স্কুলে টিফিনের সময় নবম শ্রেণির দুই ছাত্র ক্লাস–রুমে বসে বিয়ার আর কষা মাংস দিয়ে টিফিন করাটাকে কোনও অন্যায় বলে মনে করে না৷ এটা তাদের কাছে স্বাভাবিক আনন্দ উপভোগ বলেই মনে হয়৷ আনন্দ উপভোগ করার এইসব উপকরণগুলিও তারা পায় সমাজ পরিবেশ থেকেই৷ দশম শ্রেণির কিছু ছাত্র তাদের সহপাঠী ছাত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করার ঘটনাও তো আমাদের অজানা নয়৷

মোবাইল–টিভি–কম্পিউটার গেম বা ভিডিও গেম প্রভৃতির মাধ্যমে আর সমাজের বিভিন্ন ক্রমবর্ধমান অসামাজিক ঘটনাগুলির মধ্য দিয়ে অল্প বয়সেই শিশুটি খুন, ধর্ষণ সহ নানা অপরাধমূলক কাজের সাথে পরিচিত হয়৷ পরিবারগুলিও বাবা–মা–সন্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ বেশিরভাগ শিশুরই কাটে একাকীত্ব ও নানা ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের (গ্যাজেটসের) মধ্যে৷ আবার ছোট্ট বয়স থেকে পড়াশোনা, খেলাধূলা প্রভৃতি বিভিন্ন প্রশ্নে প্রতিযোগিতার মানসিকতা জাগিয়ে তুলে যে কোনও উপায়ে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার শিক্ষাও একটি শিশু পেয়ে থাকে যা তাকে সকলের মধ্যে থেকে সম্মিলিত আনন্দবোধের মানসিকতা থেকে দূরে ঠেলে দেয়৷ ভিডিও গেম, কম্পিউটার গেম প্রভৃতির মধ্য দিয়ে শিশুর মধ্যে একটি কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে যে কোনও উপায়ে জেতার মনোভাবের যে পরিচয় ঘটে তা তার বাস্তব জীবনেও প্রয়োগ করার স্বীকৃতি বড়দের কাছ থেকে সে পায়৷ সত্য ও ন্যায়ের পথে সকলের সাথে লড়ে জেতার বা হারার মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে, তার স্বীকৃতি তাকে দেওয়া হয় না৷ শিশুর বড় হয়ে ওঠার পিছনে এই যে জটিল হীন মানসিকতা কাজ করে তা তাকে ক্রমাগত অসহিষ্ণু বিবেক–মনুষ্যত্ব বিবর্জিত কদর্য জীবনের দিকে ঠেলে দেয়৷ এরই প্রতিফলন আমরা দেখি নানা ঘটনায়, শিশুর নানা অপরাধমূলক কাজের মধ্যে৷ এতে অমাদের কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু সেই কষ্টের বাস্তব মূল্য কতটুকু যদি না তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যায়!

ইফতিকার আলি, কলকাতা

(কৈশোরের বিপন্নতা নিয়ে আরও চিঠি পাঠান)