‘বিকাশ’ ছেড়ে সাম্প্রদায়িকতাকেই আঁকড়ে ধরল বিজেপি

গুজরাটে বিধানসভা ভোট এগিয়ে আসতেই বিজেপির মুখে ফুটছে হিন্দুত্ববাদের জিগির৷ দলের সভাপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী সকলেই মুখ ঢেকেছেন সাম্প্রদায়িকতার পুরনো চাদরে৷ কোথায় গেল সেইসব ‘আচ্ছে দিন’, ‘সবকে সাথ সবকা বিকাশ’, ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাটে’র ঢক্কানিনাদ তার বদলে এখন নেতাদের মুখে মুখে ছুটছে রামমন্দির নির্মাণের হুঙ্কার৷ হুঙ্কার চড়ছে মুসলিমদের প্রতি– বিজেপিকে ভোট না দিলে পরিণতি ভাল হবে না৷ নিছক একটি কল্পকাহিনির উপর তৈরি ‘পদ্মাবতী’ ছবিকে শিখণ্ডি বানিয়ে সংঘ পরিবার ধর্মবিদ্বেষের আগুন ওগরাচ্ছে৷

ভোটের প্রচারের এই গরম পরিবেশের মধ্যে অনেকেরই মনে পড়বে গত লোকসভা নির্বাচনের কথা৷ একের পর এক জনসভায় অধুনা ছুটতে থাকা মানুষটির মধ্যে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদিকে খুঁজতে চাইলে পাওয়া যাবে না৷ প্রচার দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সেদিন তাঁকে প্রায় অবতারে পরিণত করেছিল কর্পোরেট পুঁজিমালিকদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যম৷ গুজরাটকে বানিয়ে তুলেছিল উন্নয়নের সুপার মডেল৷ সমস্ত মুশকিলের আসান সেই ‘উন্নয়নের কান্ডারি’, ‘বিকাশ পুরুষের’ চিহ্ণমাত্র নেই আজকের গুজরাটে বিজেপির প্রচার–কান্ডারি নরেন্দ্র মোদির মধ্যে৷

আসলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতির সেই ফোলানো ফানুস একেবারেই ফেটে গেছে৷ ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’–এর বিজ্ঞাপনী জৌলুষের রঙ খসে বেরিয়ে এসেছে সেখানকার সাধারণ খেটে–খাওয়া মানুষের বিবর্ণ জীবনছবি৷ সুদিন একেবারে আসেনি তা নয়৷ গুজরাটের একদল শিল্পপতি মন্ত্রী আমলা কালোবাজারি জমির দালালের জীবনে ‘আচ্ছে দিন’ নিশ্চয় এসেছে, যেমন এসেছে সারা দেশেরই তেমনই কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের জীবনে৷ বাকিটা শুধুই হাহাকার আর চোখের জলের গল্প৷

গুজরাটে দু’দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি৷ কেমন আছে মানুষ সেখানে? গত দশ বছরে গুজরাটের ষাট হাজার ছোট শিল্প বন্ধ হয়েছে, অপুষ্টি–শিশুমৃত্যু–নারীর স্বাস্থ্যে এ রাজ্যের মান জাতীয় গড়ের নিচে, শ্রমিকের নূ্যনতম মজুরি সরকারের ধার্য করা মজুরির থেকে অনেক তলানিতে৷ চূড়ান্ত অমানবিক শ্রমসংস্কার নীতি শ্রমিকদের নূ্যনতম অধিকারগুলিকেও কেড়ে নিয়েছে৷ গুজরাটের হিরে শিল্প, বিদ্যুৎচালিত তাঁতশিল্প, বস্ত্রশিল্প, পোশাক শিল্প কিংবা রাসায়নিক ও ওষুধ শিল্পে নিযুক্ত অন্য রাজ্য থেকে আসা কিংবা স্থানীয় যেসব শ্রমিক, তারা চূড়ান্ত অমানবিক পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হয়৷ সেখানে এমনকী পর্যাপ্ত পানীয় জলটুকুরও ব্যবস্থা নেই, নেই শৌচাগার  কিংবা  হাওয়া  চলাচলের  সামান্য  বন্দোবস্ত৷  বেশির ভাগ জায়গাতেই শ্রমিকদের আইডেন্টিটি কার্ড নেই, রেজিস্ট্রি খাতাতে নামও নেই৷ ফলে প্রাপ্য সব রকমের সুযোগ–সুবিধা থেকেই তারা বঞ্চিত৷ বিজেপি সরকারের মদতে গুজরাট জুড়ে চলছে মালিকরাজ৷

সারা দেশের মতো গুজরাটেও কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছে না, কৃষিপণ্যের  বাজার  নিয়ন্ত্রণ  করছে  একচেটিয়া  কৃষি–পুঁজিপতিরা৷ চলছে  আত্মহত্যার  মিছিল৷  আদানির  মতো  কিছু  শিল্পপতির উন্নয়ন শাসক বিজেপির বদান্যতায় উল্কাগতি পেয়েছে৷  তেমনই একই গতিতে বাড়ছে দরিদ্রের সংখ্যা৷ নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত সারা দেশের  মতো  গুজরাটের  মাঝারি  এবং  ক্ষুদ্র  শিল্পের  উপর, অসংগঠিত শ্রমিকদের উপর মারাত্মক আঘাত হেনেছে৷ লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়েছে৷ গুজরাটের বস্ত্র শিল্প এবং ব্যবসার উপর আঘাত হেনেছে জিএসটি৷ ছাঁটাই হয়েছে এখানেও হাজার হাজার শ্রমিক–কর্মচারী৷ বস্ত্র ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছেন জিএসটির বিরুদ্ধে৷ বহু প্রচারিত গুজরাটের ন্যানো কারখানায় ক্লোজার ঘোষণা করা হয়েছে৷ ছাঁটাই শ্রমিকদের ধরনায় লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ৷

লোকসভা নির্বাচনের আগে গোটা দেশের যে উন্নয়ন–স্বর্গের ছবি তুলে ধরা হয়েছিল, প্রতিশ্রুতির যে বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা–ও এবারের প্রচারে অনুপস্থিত৷ একশো দিনে দাম কমানো, বছরে দু’ কোটি কর্মসংস্থান, সকলের অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ হিসাবে টাকা ভরে দেওয়া, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম প্রভৃতি অগুনতি যে সব প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন তা আজ তাঁর দলের মতো তাঁকেও বিদ্রুপ করছে৷ ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র নামে প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে দেশীয় শিল্পগুলিতে বিদেশি পুঁজির জন্য দরজা হাট করে খুলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপি সরকার৷ তাঁরা দেশের মানুষকে বুঝিয়েছিলেন, এর ফলে কোটি কোটি কর্মসংস্থান হবে৷ কোনও শিল্পেই বিদেশি পুঁজির ঢল নামেনি৷ ছিটেফোঁটা যতটুকু পুঁজি এসেছে তাতে কর্মসংস্থান বিশেষ কিছুই হয়নি৷ বৃদ্ধির হার মুখ থুবড়ে পড়ছে৷ সাধারণ মানুষকে দেওয়ার মতো নতুন প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রীর ঝুলিতে আর কিছুই নেই৷

এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের মন যে আর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাটের’ নামে আগের মতো দুলে উঠবে না, কাজ হবে না বিকাশ কিংবা আচ্ছে দিনের কথায়, বুঝতে অসুবিধা হয়নি বিজেপির৷ ধর্ম ও জাতপাতের নামে মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া নগ্ন সাম্প্রদায়িকতার সেই আদি ও অকৃত্রিম অস্ত্রটির শরণ নেওয়া ছাড়া বিজেপির আজ অন্য পথ কোথায়

তাই প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর দলের অন্য নেতারা ফিরে এসেছেন মন্দির–মসজিদ তত্ত্বে৷ আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত সুর চড়িয়েছেন– রামমন্দির হবেই৷ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘোষণা করছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি স্বাধীন ভারতের বৃহত্তম মিথ্যা৷ দেশের রাজনীতিতে যাঁরা শব্দটি আমদানি করেছিলেন, মানুষের কাছে তাঁদের ক্ষমা চাওয়া উচিত৷’ পদ্মাবতী ছবির বিরুদ্ধে প্রথমে করণী সেনা, পরে গোটা বিজেপি যেভাবে রইরই করে নেমে পড়ল এবং চারটি রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে সেই ছবিকে নিজেদের রাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হিন্দু সেন্টিমেন্ট চাগিয়ে তোলাই এর মূল লক্ষ্য৷ হরিয়ানার এক বিজেপি নেতা এই ছবির অভিনেত্রী এবং পরিচালকের মুণ্ডচ্ছেদের জন্য ১০ কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন৷  আর এক বিজেপি নেতা দাবি করেছেন, তাজমহল হিন্দু শিবমন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছে৷ এই সব উত্তেজক বক্তৃতার কোনওটিরই বিরোধিতা করা হয়নি বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের থেকে৷ যাঁরা এই সব প্ররোচক বক্তব্য রেখেছেন, তাঁরা সকলে অন্তত প্রাদেশিক স্তরের নেতা৷ কোনওটিরই বিরোধিতা করে মুখ খোলেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও৷

অতীতেও দেখা গেছে, যখনই রাজনীতির সোজা পথে জনসমর্থনে ঘাটতি দেখা গেছে, তখনই বিজেপি আশ্রয় নিয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে, উস্কানি দিয়েছে দাঙ্গায়৷ উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনেও প্রধানমন্ত্রী শ্মশানঘাট–কবরস্থান বির্তক উস্কে ছিলেন৷ এবারও প্রধানমন্ত্রী মন্দিরে মন্দিরে ঘুরছেন, পুজো দিচ্ছেন, তার লাইভ প্রচার চলছে টেলিভিশনে, ইউটিউবে, ইন্টারনেটে৷ মানুষের জীবনের সমস্যাগুলিকে বাদ দিয়ে বিজেপি নেতারা বক্তৃতা দিচ্ছেন কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে, সন্ত্রাসবাদ নিয়ে, আইএমএফ–বিশ্বব্যাঙ্ক উন্নয়নের কী সার্টিফিকেট দিয়েছে তাই নিয়ে৷ রাজ্যে কত ঝাঁ চকচকে রাস্তা হয়েছে, ব্রিজ হয়েছে, উড়ালপুল হয়েছে, তার ফিরিস্তি দিয়ে তাকেই মানুষের উন্নয়ন বলে প্রচার করছেন তাঁরা৷ আসলে দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিদিন জীবনের যে সমস্যাগুলি নিয়ে নাজেহাল হচ্ছেন, সেগুলিকে স্পর্শ করারও ক্ষমতা নেই প্রধানমন্ত্রীর, নেই তাঁর দলেরও৷ এই সত্য বিগত  কয়েক  বছরে  প্রমাণিত  হয়ে  গেছে৷ ফলে আজ তাঁদের পুঁজি করতে হয়েছে মানুষের দুর্বলতাকে, অজ্ঞতাকে৷ ভোটে জেতার জন্য মানুষকে অন্ধতার দিকে, সাম্প্রদায়িক হানাহানির দিকে ঠেলে দিতে বিজেপি দ্বিধা করছে না৷ এই তাদের রাজনীতি৷

এখানে বিরোধী কংগ্রেসের কথাটিও না বললে নয়৷ বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম কংগ্রেসকে বিশেষত কংগ্রেসের তরুণ নেতা রাহুল গান্ধীকে খুবই প্রচার দিচ্ছে৷ দেখাচ্ছে, কীভাবে তিনি তাঁর ছেলেমানুষি কাটিয়ে দ্রুত সাবালক হয়েছেন৷ কীভাবে তাঁর জনসভাগুলিতে জনগণের ভিড় বাড়ছে৷ কীভাবে বিজেপির প্রচারের উত্তরে তিনি দারুণ সব টুইট করছেন৷ বিজেপি এই নির্বাচনে হারবে না জিতবে সেটা এই বুর্জোয়া প্রচারকদের কাছে বড় কথা নয়৷ বিজেপির বিরুদ্ধে জনমানসে যে বিরোধিতা বাড়ছে, তাদের লক্ষ্য, দ্বিদলীয় ব্যবস্থার আর এক শরিক হিসাবে সেই বিরোধিতার হাওয়াকে কংগ্রেসের পালে লাগানো৷ না হলে নীতিগত ভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির যে কোনও ফারাক নেই তা তো জানা কথা৷ বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এই মুহূর্তে বুর্জোয়াদের একটা অংশ পছন্দ করছে না৷ কংগ্রেসও বরাবরই সাম্প্রদায়িকতাকে ভোটের কাজে লাগিয়েছে৷ কিন্তু তা নরম সাম্প্রদায়িকতা৷ না হলে এবারের গুজরাট নির্বাচনে বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেস তাদের আর্থিক নীতির ব্যর্থতাকে তুলে ধরে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারত৷ কিন্তু বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা কংগ্রেস শুধু যে সাম্প্রদায়িকতা দিয়েই করছে তাই নয়, জাতপাতের রাজনীতিকেও হাতিয়ার করেছে কংগ্রেস৷ এক দিকে যেমন রাহুল গান্ধী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একের পর এক মন্দিরে ছুটছেন তেমনই গুজরাটে বর্তমান জাতপাত এবং সংরক্ষণের রাজনীতির তিন মূল হোতা হার্দিক–অল্পেশ–জিজ্ঞেশের সাথে হাত মিলিয়েছে৷ এ যেমন আগুন নিয়ে  খেলা,  তেমনই  মূল  সমস্যাগুলি  থেকে  মানুষের  দৃষ্টি ঘুরিয়ে  দেওয়ার  অপচেষ্টা৷  বাস্তবে  কংগ্রেসের  এই  আচরণ  প্রমাণ করে পুঁজিপতি শ্রেণির দুই বিশ্বস্ত দলের রাজনীতির মধ্যেও কোনও ফারাক বাস্তবে নেই এবং এই রাজনীতির সাথে সাধারণ মানুষের স্বার্থের সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিপরীত৷ পথ দেখাতে পারত বামপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনীতি৷ কিন্তু তা বৃহৎ বামপন্থী দলগুলির ভোটসর্বস্ব রাজনীতির  ফলে  শক্তিশালী  হতে  পারছে  না৷ অত্যন্ত সীমিত শক্তি নিয়ে এস ইউ সি আই (সি) বামপন্থী গণআন্দোলনের ঝান্ডা উড়িয়ে গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে৷