বাঁচার রাস্তা পেতে নামতে হল রাস্তাতেই

সুপ্রিম কোর্টের প্রতিনিধিদের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন তুললেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই আগে কোনও দিন একা রাস্তায় বার হননি। কেউ কেবল সংসারের জোয়াল ঠেলেই বার্ধক্য পর্যন্ত কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু শাহিনবাগের আন্দোলন মঞ্চে তাঁরাই অভিভাবকের মতো আগলে রেখেছেন তরুণ প্রতিবাদীদের। দু’মাস কেটে গেছে, তাঁরা রাস্তায়। লাগাতার চলছে ধরনা। কখনও স্লোগান, কখনও বত্তৃতা আবার কখনও বা চলছে গান। তাঁরা গলা মেলাচ্ছেন স্লোগাননে, বক্তাকে তারিফ জানাচ্ছেন। আবার কমবয়সি মা ধরনা চলার মধ্যেই দুরন্ত শিশুকে নিয়ে যখন নাজেহাল, তাঁরাই সামলাচ্ছেন সেই ঝক্কি। সারা দেশ শাহিনবাগের প্রতিবাদী মহিলাদের সাথে এই বর্ষীয়ান ‘দাদি’দের কুর্নিশ জানাচ্ছে। তাঁদের সেইসব অমোঘ প্রশ্নের জবাবে নীরবতা আঁকড়ে থাকা ছাড়া উপায় খুঁজে পাননি শীর্ষ আদালতের প্রতিনিধিরা।

এবার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন শাহিনবাগের বিক্ষোভকারীরা। যাবেন তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতেই। দেখি আলোচনা তিনি করেন কি না! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ‘শাহিনবাগে কারেন্ট লাগাতে’ না পেরে কথা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন– শাহিনবাগের প্রতিবাদীরা এলে সরকার আলোচনা করবে। কিন্তু মিছিল করে আলোচনার জন্য এগোতেই রে রে করে তেড়ে এল কেন্দ্রীয় সরকারের পুলিশ। যেতে দিল না মিছিলকে। কিন্তু ভয় দেখানো যায়নি শাহিনবাগকে। প্রতিবাদী মহিলারা তাই সুপ্রিম কোর্টের পাঠানো প্রতিনিধিদের চোখে চোখ রেখে জানিয়ে দিলেন, সরকারকে বলুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন তুলে নিতে, এনআরসি প্রত্যাহার করতে। তাহলেই খুলে যাবে রাস্তা। তাঁরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, ৬৭ দিন ধরে এতগুলি মানুষ তাঁদের কথা শোনাতে চাইছেন সরকারকে, মন্ত্রীদের সময় হল না একবার আসার? তাঁরা প্রশ্ন তুললেন, আজ আপনারা এসেছেন শুধু আমাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাস্তা চালু করার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু এই একটা রাস্তা যদি না আটকাত, আপনারা এটুকুও কি করতেন? কেন আমরা রাস্তায় এতদিন ধরে বসে– সে কথা কেউ জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করতে এল না কেন? সরকার কি আদৌ মনে করে দেশের নাগরিকদের প্রতি তার কোনও দায়বদ্ধতা আছে?

সুপ্রিম কোর্টের প্রতিনিধিরা প্রশ্ন করেছিলেন, কে বলেছে আপনারা দেশের নাগরিক নন? গর্জে উঠল শাহিনবাগ– ‘নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ’। অমিত শাহ এবং তাঁর দল বলে চলেছে শাহিনবাগটা নাকি মিনি পাকিস্তান! কারণ তাঁরা এই আন্দোলনকে দাগিয়ে দিতে চান নিছক মুসলিমদের আন্দোলন বলে। কেন্দ্রীয় কিংবা বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলির একের পর এক মন্ত্রী এসে প্রতিবাদীদের গুলি করে মারার হুঙ্কার দিয়েছেন। তাঁদের কথা অনুসরণ করে নাথুরাম গডসেকে জীবনের আদর্শ মানা দু’জন আরএসএস সমর্থক এসে গুলি চালিয়েও গেছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। এরপরেও কি মনে করতে হবে, যখন সিএএ-এনপিআর-এনআরসি-র জন্য এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের বিপন্ন বোধ করছেন, তাদের প্রতি সরকারের নূ্যনতম দায়বদ্ধতা আছে? সংবেদনশীল মনোভাব নিয়ে কি সরকার বিষয়টিকে দেখেছে? নাকি মুসলিম মাত্রই অনুপ্রবেশকারী, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি– এই প্রচার দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে? সরকারের মনোভাবের জন্যই হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাংলাভাষী মানুষ দিল্লিতে, বেঙ্গালুরুতে, মুম্বাইতে, ইউপিতে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। বিজেপির নেতা তথা মন্ত্রী কৈলাস বিজয়বর্গীয় রাজমিস্ত্রীদের চিঁড়ে খেতে দেখে তাদের বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী পোশাক দেখেই ‘দাঙ্গাকারী’ চেনার নামে মুসলিম বিদ্বেষে উস্কানি দিচ্ছেন।

নাগরিকদের প্রতি সরকারের কোনও সংবেদনশীলতা, দায়বদ্ধতা যে নেই, তা দেখেছে আসাম। ১৯ লক্ষ মানুষকে এনআরসি-র নামে চূড়ান্ত অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দিয়ে সরকারি কর্তারা হেসেছেন। সরকার শুধু নয়, রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ বিচারবিভাগের প্রধান পর্যন্ত আক্ষেপ করেছেন মাত্র ৯০০ লোককে ডিটেনশন ক্যাম্পে পোরা গেছে দেখে। এর মধ্যেও শাহিনবাগ আঁকড়ে ধরেছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন বলিদান দেওয়া বীরদের ছবি। বলেছে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থেকে তাঁরা পিছু হঠবেন না।

আজ সুপ্রিম কোর্টের প্রতিনিধিরা তাঁদের শোনাচ্ছেন, প্রতিবাদ করুন কিন্তু তা যেন কারও অসুবিধা সৃষ্টি না করে। এক সময় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারও ঠিক এইরকম যুক্তি দিত। যা দেখে মহান মানবতাবাদী সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘‘দেখিতে পাই, বড়লাট হইতে শুরু করিয়া কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই বলিতেছেন–সত্যকে তাঁহারা বাধা দেন না, ন্যায়-সঙ্গত সমালোচনা– এমনকি, তীব্র ও কটু হইলেও নিষেধ করেন না। তবে বত্তৃতা বা লেখা এমন হওয়া চাই, যাহাতে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে লোকের ক্ষোভ না জন্মায়, ক্রোধের উদয় না হয়। চিত্তের কোন প্রকার চাঞ্চল্যের লক্ষণ না দেখা দেয়– এমনি। অর্থাৎ, অত্যাচার-অবিচারের কাহিনী এমন করিয়া বলা চাই, যাহাতে প্রজাপুঞ্জের চিত্ত আনন্দে আপ্লুত হইয়া উঠে, অন্যায়ের বর্ণনায় প্রেমে বিগলিত হইয়া পড়ে এবং দেশের দুঃখ দৈন্যের ঘটনা পড়িয়া দেহ-মন যেন তাহাদের একেবারে স্নিগ্ধ হইয়া যায়! ঠিক এমনটি না ঘটিলেই তাহা রাজবিদ্রোহ”(সত্য ও মিথ্যা)। আজ যেন সরকার থেকে আদালত সকলেই এই কথারই প্রতিধ্বনি করতে এসেছে শাহিনবাগে। অথচ কেউই শাহিনবাগের মহিলাদের একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেননি। যতদিন না তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন ততদিন সরকারের টনক নড়েনি কেন? যদিও তাঁরা এটাও দেখিয়ে দিয়েছেন, শাহিনবাগ সংলগ্ন একটিমাত্র রাস্তা ধরনার জন্য কিছুটা আটকে থাকছে ঠিকই, কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে স্কুলবাস থেকে অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের ব্যবস্থা আন্দোলনকারীরাই করছেন। একই সাথে তাঁরা সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন শাহিনবাগের চারপাশ দিয়ে আরও অনেকগুলি রাস্তা দিল্লি-নয়ডার সংযোগকারী হিসাবে কাজ করতে পারে। সেগুলি সবই আটকে রেখেছে দিল্লি এবং উত্তরপ্রদেশের পুলিশ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২-০২-২০২০)। কারণ পুলিশ চেয়েছে শাহিনবাগের প্রতি দিল্লির মানুষের মন বিরূপ হয়ে উঠুক। যাতে কেবলমাত্র রাস্তা খোলার অজুহাতেই আন্দোলন ভাঙতে পেশিশক্তি নিয়ে লাঠি-গুলি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তারা।

শাহিনবাগের এই প্রসঙ্গ আজ দেশের সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। নিয়মবাঁধা নিশ্চিন্ততায় এতটুকু ঘাটতি পড়তে না দিয়ে দুনিয়ায় কোনও দিন কোনও দাবি কি শাসকের কাছ থেকে আদায় করতে পেরেছে জনগণ? যে সংবাদমাধ্যম মিছিল দেখলেই যানজটের অসুবিধার কথা তুলে সেটাকেই বড় করে দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাদের সাংবাদিকদেরও কি পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ক্যামেরা রাস্তায় রেখে অবরোধ করতে কলকাতা দেখেনি? সেটাই তো প্রতিবাদের সঠিক উপায়। পাশ-ফেল চাই– এই দাবিতে স্কুলের ছাত্ররা রাস্তায় নামলে যারা মহা চিন্তিত মুখে কোর্টে দৌড়ান তাঁরাও কি অস্বীকার করতে পারবেন, এই ছাত্রসমাজই শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দাবি প্রথমিকে ইংরেজি পড়ানো এবং পাশ-ফেল ফেরানোর কাজে অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে? চিকিৎসক নিগ্রহের প্রতিবাদের পাশাপাশি হাসপাতালের উপযুক্ত পরিকাঠামোর দাবিতে আউটডোর বন্ধ রেখেও গাছতলায় বসে রোগী দেখেন, প্রতিবাদের কণ্ঠ তোলেন যে ডাক্তাররা, তাঁদের দাবি আদায় যে সমাজের সকলের বাঁচার রাস্তাকে একটু সহজ করে, সে কথা কি অস্বীকার করা যায়? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শ্রমিক-কৃষক-খেটে খাওয়া মানুষ যখন সব স্তব্ধ করে ধর্মঘটের ডাক দিতে বাধ্য হন, সে কি জীবন স্তব্ধ করতে, না কি বাঁচার রাস্তা খুলতে? শাহিনবাগ তাই প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছে, প্রেরণা হয়ে পথ দেখিয়েছে কলকাতা সহ সারা দেশে অসংখ্য এমন ধরনামঞ্চে বসা অগণিত মানুষকে। সেখানে কেউ তাঁরা মুসলমান, হিন্দু, শিখ কিংবা খ্রিস্টান নন– ভারতের একজন প্রতিবাদী নাগরিক হিসাবেই হাতে হাত মিলিয়েছেন।

শাহিনবাগ আজ শিক্ষা দিয়ে গেল বাঁচার রাস্তা খুলতে গেলে প্রয়োজনে রাস্তা আটকাতেও হয়, সেটাই গণতন্ত্রের পরিসর। এ অধিকার মানুষ কখনও ছেড়ে দিতে পারে না। শাসকের চাপে, কিংবা মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে ভুলে রাস্তা ছাড়লে শোষণ-অত্যাচারের জগদ্দল পাথরটাকে শাসকরা আরও বেশি করে চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে। তাতে সর্বনাশ জনগণের।

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৮ সংখ্যা)