বলিভিয়ায় আসন্ন নির্বাচনে কলকাঠি নাড়ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ

বলিভিয়ার মানুষকে আবার একটা নির্বাচনের দিকে ঠেলে দেওয়া হল। নির্বাচন হবে ৩ মে। গত অক্টোবরেই ভোট হয়েছিল বলিভিয়ায়। দেশের মানুষ প্রেসিডেন্ট হিসাবে আরও একবার বেছে নিয়েছিলেন জনজাতি গোষ্ঠী থেকে উঠে আসা ইভো মোরালেসকে। কিন্তু ঠিক এক মাস পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সামরিক বাহিনী পদচ্যুত করে তাঁকে। মোরালেসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলা হয়। যদিও সে অভিযোগের কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ অভিযোগকারী ‘অর্গানাইজেশন অফ আমেরিকান স্টেটস’ দিতে পারেনি। অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন দক্ষিণপন্থী জেনাইন আনেজ, জনজাতিভুক্ত মানুষের প্রতি ঘৃণা ও নিন্দাসূচক মন্তব্যের জন্য যিনি আগে থেকেই কুখ্যাত।

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রেসিডেন্ট মোরালেস তাঁর ১৪ বছরের শাসনকালে বেশ কিছু জনমুখী নীতি নিয়ে চলেছেন। তাঁর আমলে বলিভিয়ার দরিদ্র সাধারণ মানুষ, বিশেষত জনজাতিভুক্ত মানুষের জীবনযাত্রার মানের যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটেছে। দেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই প্রেসিডেন্ট দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য বিস্তারের পথে বাধা হিসাবে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই বাধা হঠাতেই অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা থেকে তাঁকে সরিয়ে দিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার স্যাঙাৎ বলিভিয়ার দেশীয় বৃহৎ পুঁজিপতিরা। প্রেসিডেন্ট মোরালেস এখন আর্জেন্টিনায় রয়েছেন। তাঁর দল ‘মুভমেন্ট ফর সোস্যালিজম’ আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী দিয়েছে।

কিন্তু ভোটের প্রচার চালাতে গিয়ে প্রবল বাধার সামনে পড়তে হচ্ছে মোরালেসের দলের কর্মীদের। পুলিশ দিয়ে নেতাদের গ্রেপ্তার করানো হচ্ছে, কর্মীদের ওপর হামলা চলছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কর্মীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা ও সন্ত্রাস ছড়ানোর মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এমনকী সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতি অগ্রাহ্য করে রেডিওতে দলের প্রার্থীদের প্রচার পর্যন্ত করতে দেওয়া হচ্ছে না। বলিভিয়ায় জনজাতি মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। এঁদের অধিকাংশই প্রেসিডেন্ট মোরালেস ও তাঁর দলের সমর্থক। দেখা যাচ্ছে, বেছে বেছে এই মানুষগুলির ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে আনেজের অনুগামী দক্ষিণপন্থী দুষ্কৃতীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মোরালেস। বলিভিয়ার পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর যে, রাষ্ট্রসংঘের বিশেষ দূত দিয়েগো গার্সিয়া-সায়ান বলিভিয়ায় বেআইনিভাবে আটক করা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বলে টুইটে উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারেননি।

এ সমস্ত কিছুর পিছনে কলকাঠি নাড়ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট মোরালেস মার্কিন সরকারের পেটোয়া সংস্থা ‘ইউএসএইড’-কে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থবাহী এই সংস্থার ভূমিকা অনেকেরই জানা। এর কাজ হল উন্নয়নের নাম করে দেশে দেশে ঢুকে পড়া এবং তারপর সেখানকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী বানিয়়ে নানা ভাবে তাদের সাহায্য দিয়ে দেশের নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো এবং সাম্রাজ্যবাদের পুতুল সরকার বসিয়ে দেওয়া। দেশ থেকে বের করে দেওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট মোরালেসও একই অভিযোগ তুলেছিলেন ইউএসএইড-এর বিরুদ্ধে। বলেছিলেন, এই সংস্থা তাঁর সরকারকে নড়বড়ে করে দেওয়ার চক্রান্ত করছে। এরও আগে মোরালেস সেখানকার নির্বাচনী এজেন্সি ‘টিএসই’-র বড়কর্তা সালভাদর রোমেরোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে ২০০৮-এ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাঁর কার্যকাল যেন আর বাড়ানো না হয়। পদ খোয়ানোয় ক্ষুব্ধ রোমেরো মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে কিছু করতে বলেন। মার্কিন কর্তারা রোমেরোর দায়িত্ব নিয়ে নেন এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতে দেশে দেশে গণতন্ত্র রক্ষার স্বঘোষিত রক্ষক হিসাবে ঢাক পিটিয়ে যে সব সংস্থা নানা ষড়যন্ত্রমূলক কাজ করে চলেছে, তেমনই একটি সংস্থা ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট’-এ তাঁর কাজের ব্যবস্থা করে দেন।

নভেম্বরে বলিভিয়ায় অভ্যুত্থানের পরে পরেই অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আনেজ সেই রোমেরোকে দেশে ফিরিয়ে এনে আবার নির্বাচনে খবরদারি করার কাজে বহাল করেন। এই পথে বলিভিয়ায় আসন্ন নির্বাচনের যাবতীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে নিজেদের লোক নিয়োগ করতে পেরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বেজায় খুশি। এর উপর আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনের জমি তৈরি করতে ইউএসএইড-কেও বলিভিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। ইউএসএইড বলিভিয়ায় পৌঁছবার ঠিক দশ দিন পরে ট্রাম্প সাহেবের আইনি পরামর্শদাতা মরিসিও ক্লাভার-ক্যারোনে বলিভিয়ায় উপস্থিত হয়ে সংবাদমাধ্যমে বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার দেন এবং মন্তব্য করেন, দেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছেন স্বয়ং ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোরালেস। এইভাবে ছলে বলে কৌশলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বলিভিয়ার নির্বাচনী কার্যকলাপে নানা ভাবে হস্তক্ষেপ করে চলেছে।

একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের ফ্যাসিস্টসুলভ দমন-পীড়ন, পাশাপাশি পেটোয়া লোক বসিয়ে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করার সাম্রাজ্যবাদী অপচেষ্টা, সর্বোপরি দেশের মাটিতে কুখ্যাত সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা ইউএসএইড-এর উপস্থিতি– সব মিলিয়ে আসন্ন নির্বাচন প্রেসিডেন্ট মোরালেসের দলের় কর্মীদের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চলেছে। বলিভিয়ার মানুষের সমর্থনে লড়াইয়ের ময়দানে দৃঢ়তার সঙ্গে এসব কিছুরই মোকাবিলা করতে তৈরি এমএএস-এর কর্মী-সমর্থকরা।

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৮ সংখ্যা)