প্রধানমন্ত্রীর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দেশবাসীকে হতাশ করল

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার সরকারে বসার পর প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বক্তৃতা দিলেন৷ দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল, তাদের জীবন যে সমস্যাগুলিতে জর্জরিত, নিষ্পেষিত, প্রধানমন্ত্রী সেগুলি সমাধানের কথা বলবেন৷ ঘোষণা করবেন লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে, পঁয়তাল্লিশ বছরে সর্বোচ্চ হারে পৌঁছানো বেকার সমস্যা কাটিয়ে উঠে কোটি কোটি বেকার যুব সমাজের কাজের ব্যবস্থা করতে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন৷ রেলে, মোটরগাড়ি শিল্পে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক–কর্মচারীর উপর ছাঁটাইয়ের যে খাঁড়া ঝুলছে, তাকে আটকাতে কার্যকর ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করবেন৷ ব্যাঙ্কগুলি থেকে শিল্পপতি ও বৃহৎ ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ না করে জনগণের সম্পত্তি যেভাবে আত্মসাৎ করছে তা বন্ধ করতে কড়া মনোভাব ব্যক্ত করবেন৷ দেশজুড়ে সংখ্যালঘু এবং দলিতদের উপর ক্রমাগত বেড়ে চলা আক্রমণ বন্ধ করতে তাঁর সরকার কী ভূমিকা নিচ্ছে তা দেশের মানুষকে জানাবেন৷ কিন্তু দেশবাসী চরম হতাশ হলেন৷ প্রধানমন্ত্রী তাঁদের জীবনের সমস্যার ধারকাছ দিয়েও গেলেন না৷

দেশের মানুষ জানে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রথম দফার সরকারে বসার আগে জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি– বছরে ২ কোটি চাকরি, কালো টাকা উদ্ধার, দুর্নীতি নির্মূল করা, ‘আচ্ছে দিন’, ‘সবার বিকাশ’ প্রভৃতির একটিও কার্যকর করতে পারেননি৷ মানুষ আশা করেছিল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে বসা প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় এবার বকেয়া প্রতিশ্রুতিগুলিই প্রথম পূরণ করার কথা বলবেন৷ দেখা গেল, স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী জনজীবনের মূল সমস্যাগুলি সমাধানের বিষয়কে এড়িয়ে গিয়ে হঠাৎ জনবিস্ফোরণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন আর সম্পদের প্রকৃত স্রষ্টা শ্রমিক শ্রেণিকে উপেক্ষা করে দেশের শিল্পপতিদের ‘সম্পদের স্রষ্টা’ ঘোষণা করে তাদের শ্রদ্ধা করার কথা বললেন৷ যেন বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, দুর্নীতি, অশিক্ষা, কৃষকের আত্মহত্যা, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু– এগুলি কোনও সমস্যা নয়, বা এগুলি দেখা সরকারের দায়িত্ব নয়৷

প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘পরিবার পরিকল্পনা দেশপ্রেমেরই অঙ্গ৷’ বললেন, ‘‘যদি প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা–স্বাস্থ্য পরিষেবা সুনিশ্চিত করা না যায় তবে বাড়ি বা দেশ সুখী হতে পারে না৷’’ শুনতে যতই ভাল লাগুক, বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর এই জনবিস্ফোরণের তত্ত্ব কতখানি সত্য? ২০১৮–’১৯ সালের সরকারি আর্থিক সমীক্ষার ফল অন্য কথা বলছে৷ সেই তথ্য অনুযায়ী আগামী দু’দশকে ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুত কমবে৷ বরং ২০৩০–এর মধ্যে কিছু রাজ্যে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়বে৷ এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, দেশের উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষ পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে ইতিমধ্যেই সচেতন হয়েছে৷

ভারতীয় মহিলাদের সারা জীবনে সম্ভাব্য সন্তানের গড় সংখ্যা, ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেট’ (টিএফআর) ২.২, যা আন্তর্জাতিক গড় হারের থেকে সামান্য বেশি৷ দক্ষিণের রাজ্যগুলি, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব এবং জম্মু–কাশ্মীরে টিএফআর ১.৬ থেকে ১.৭–এর মধ্যে৷ উত্তরপ্রদেশ, বিহার প্রভৃতি হিন্দিবলয়ের কিছু রাজ্যে এই হার ৩.০ থেকে ৩.২–এর মধ্যে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১৭ আগস্ট, ২০১৯)৷ তথ্য থেকে স্পষ্ট, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ এবং জম্মু–কাশ্মীরে মুসলমানদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হলেও এই রাজ্যগুলির টিএফআর কম৷ অর্থাৎ জনসংখ্যার তারতম্য ধর্ম নির্ভর নয়৷ এসব তথ্য তো প্রধানমন্ত্রীর অজানা নয়৷ তা হলে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে এত গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করলেন কেন?

শাসক শ্রেণির পক্ষ থেকে জনবিস্ফোরণের তত্ত্বকে সব সময়ই গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়৷ খাদ্য, চিকিৎসা, বেকারি প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশের বেশিরভাগ মানুষের যে দুরবস্থা তার জন্য জনসংখ্যাকে দায়ী করা হয়৷ জনবিস্ফোরণই যদি এই সমস্যাগুলির জন্য দায়ী হত তবে দেখা যেত– দেশের সব কলকারখানায় ব্যাপক উৎপাদন করেও সবার প্রয়োজন মেটানো যাচ্ছে না৷ কিন্তু ভারতের চিত্র কি তাই? বাস্তব হল, দেশের কলকারখানাগুলির অর্ধেকেরও কম উৎপাদন ক্ষমতাকে কাজে লাগানো হয়৷ বাকিটা অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকে৷ যতটুকু উৎপাদন হয় তা–ও কেনার লোকের অভাবে গুদামে জমে থাকে৷ মালিকরা কারখানায় লে–ফ, লক–আউট ঘোষণা করে৷ ফলে জনবিস্ফোরণ নয়, আসল সমস্যা তীব্র শোষণে জর্জরিত মানুষের দারিদ্র, ক্রয়ক্ষমতার অভাব৷ দেশে যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন হয় তা দেশের মানুষের মোট প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি৷ তা সত্ত্বেও জনসমাজের বিরাট অংশ অর্ধাহারে, অনাহারে থাকে কেন? তার কারণ এ দেশের ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা৷ এখানে এক অংশের মানুষ যখন অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটায় তখন আর এক অংশের খাদ্য–ব্যবসায়ী কর্পোরেট সংস্থা চাষিদের থেকে খাদ্যদ্রব্য সস্তায় কিনে নিয়ে জমিয়ে রাখে, পরে বেশি দামে বিক্রি করবে বলে৷ সরকারি গুদামে লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যদ্রব্য জমে থাকে, পচে নষ্ট হয়৷

শিক্ষা–চিকিৎসার ক্ষেত্রেও দেশের পুঁজিবাদী সরকারগুলি সেই ব্রিটিশ ঐতিহ্যই বহন করছে৷ জনশিক্ষায়, গণচিকিৎসায় কোনও সরকারই আগ্রহ দেখায়নি৷ সকলকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা দরকার ছিল, সকলকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যত সংখ্যক হাসপাতাল খোলার দরকার ছিল কোনও সরকার তার ব্যবস্থা করেনি৷ এখন তো শিক্ষা–চিকিৎসা দুটিকেই মুনাফার পণ্য হিসাবে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়েছে সরকার৷ এ কথা স্পষ্ট যে, সরকারের অবহেলা এবং পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা–স্বাস্থ্য পরিষেবা সুনিশ্চিত না হওয়ার জন্য দায়ী, জনসংখ্যা নয়৷ ফলে এ কথাও স্পষ্ট যে, জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানে তাঁর সরকারের ব্যর্থতা লুকোতেই প্রধানমন্ত্রী জনবিস্ফোরণের তত্ত্ব আওড়ালেন৷

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় ভারতে উৎপন্ন পণ্য ব্যবহারের জন্য দেশের মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন৷ এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দেশের শিল্পপতিদের প্রতি তাঁর গভীর উদার মনোভাব প্রকাশ করে বলেন, ‘‘যাঁরা সম্পদ তৈরি করছেন তাঁরা জাতির সেবা করছেন৷ তাঁদের সন্দেহের চোখে না দেখে, সম্মান করতে হবে৷ শ্রদ্ধার আসনে বসাতে হবে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘যদি সম্পদ তৈরি না হয়, তবে তার বন্টন হবে না, তা যদি না হয় তবে গরিব মানুষ লাভবান হবে না৷’’ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে হঠাৎ শিল্পপতিদের সম্মান জানানোর প্রশ্ণ এল কেন?

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মতো ২০১৯–এর লোকসভা নির্বাচনেও দেশের শিল্পমহল বিজেপির ফান্ড ভরাতে টাকা ঢেলে দিয়েছে৷ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বিগত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে৷ অন্য সূত্রে এর পরিমাণ প্রায় দু–লক্ষ কোটি টাকা৷ স্বাভাবিক ভাবেই প্রধানমন্ত্রী সেই শিল্পমহলের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার চিহ্ণ হিসাবে এমন অভয় বাণী প্রচার করলেন৷ প্রধানমন্ত্রীর দল বিজেপি শিল্পপতিদের দেওয়া টাকাতে যে খুবই লাভবান, তা তো স্পষ্ট৷ কিন্তু তাতে দেশের দরিদ্র মানুষ কীভাবে লাভবান হলেন? তা ছাড়া সম্পদের সত্যিকারের জন্মদাতা কারা? শিল্পপতি–পুঁজিপতির, নাকি শ্রমিক শ্রেণি? কারা সম্পদ তৈরি করে? ইতিহাস বলে, অর্থনীতির বিজ্ঞান বলে, সম্পদ তৈরি করে শ্রমিক শ্রেণি, আর মালিকরা তাদেরই স্বার্থে তৈরি আইনের জোরে শ্রমিকদের বঞ্চিত করে সেই সম্পদ আত্মসাৎ করে৷ শ্রমিককে বঞ্চিত করেই আসে মালিকের মুনাফা৷ আজ সেই শোষণ–বঞ্চনা এত তীব্র যে, দেশের মোট সম্পদের ৭৩ শতাংশই কুক্ষিগত করেছে ১ শতাংশ শিল্পপতি–পুঁজিপতি৷ আর ৬০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ৪.৮ শতাংশ (অক্সফ্যাম রিপোর্ট, ২০১৯)৷ এই চরম ধন–বৈষম্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কোথায় বণ্টন দেখতে পেলেন, আর দরিদ্রদের লাভবান হতেই বা কোথায় দেখতে পেলেন? দেশের শ্রমিক–কৃষক সহ সমস্ত স্তরের শ্রমজীবী মানুষকে শুধু শোষণ করেই নয়, ঘাম–রক্ত ঝরিয়ে তারা যে নামমাত্র উপার্জন করে, তার যে ভগ্নাংশ পরিমাণটুকু তারা সঞ্চয় করে, ব্যাঙ্কে জমানো সেই উপার্জনটুকুও এই মালিক পুঁজিপতিরা অবাধে লুঠ করে চলেছে৷ এদেরই গায়ে ‘সম্পদের জনক’ তকমা লাগিয়ে শ্রদ্ধার আসনে বসাতে বলছেন প্রধানমন্ত্রী৷ ঠিকই, পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে এটাই তো নরেন্দ্র মোদিদের দায়িত্ব৷ মালিকী শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা, যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে, তা যে কোনও সময় তীব্র আন্দোলনের আকারে ফেটে পড়তে পারে৷ মালিক শ্রেণি শ্রমিক আন্দোলনের ভয়ে ভীত৷ তাই শোষিত মানুষের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে, তাদের বিভ্রান্ত করতে মালিক পুঁজিপতিদের জাতির সেবক হিসাবে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মতো সব নেতা–মন্ত্রীরা মালিক শ্রেণির প্রতি তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন৷ এই কাজ দীর্ঘদিন কংগ্রেস নেতারা দক্ষতার সঙ্গে করে এসেছেন, এখন করছেন বিজেপি নেতারা৷ তাই তো তাঁরা মালিকদের এতো পছন্দের, তাই তো মালিকদের ‘আশীর্বাদ’ তাঁদের মাথায় এমন অবিরল ঝরে পড়ে!

কিন্তু দেশের খেটে খাওয়া শ্রমিক–কৃষক–সাধারণ মানুষকে এই চালাকির রাজনীতিতে, প্রতারণার রাজনীতিতে ভুললে চলবে না৷ বুঝে নিতে হবে, যত দিন এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকে থাকবে তত দিন তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফল পুঁজিপতিরা এই ভাবে আত্মসাৎ করেই যাবে৷ শুধু ভোট দিয়ে, সরকার বদলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না৷ একমাত্র তীব্র গণআন্দোলনের আঘাতে এই ব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন ব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দ্বারাই আসবে গণমুক্তি৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৪ সংখ্যা)