প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা রচনার মুখবন্ধ (৪) : ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস

১৮৮৩ সালে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান শিক্ষক ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস রচনা করেন ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’৷ এতে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের আলোকে প্রকৃতিবিজ্ঞানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগত সমস্যাগুলির ব্যাখ্যা দেন তিনি৷ রচনার মুখবন্ধে সমগ্র বিষয়টি চুম্বকে তুলে ধরেছিলেন এঙ্গেলস৷ তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে মুখবন্ধটি প্রকাশ করা হল৷ এবার চতুর্থ তথা শেষ কিস্তি৷

যাই হোক, যা কিছু সৃষ্টি হয় তাই একদিন ধ্বংস হয় (‘‘অল দ্যাট কামস ইনটু বিয়িং ডিজার্ভস টু পেরিশ’’ : গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ থেকে উদ্ধৃত – সম্পাদক)৷ কোটি কোটি বছর কেটে যেতে পারে, লক্ষ লক্ষ প্রজন্মের জন্ম ও মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু অমোঘ নিয়মে এমন একটা সময় আসবে, যখন সূর্যের ক্রমাগত কমতে থাকা উত্তাপ মেরুপ্রদেশ থেকে এগিয়ে আসা বরফ গলাতে পারবে না৷ মানুষ বেশি বেশি করে নিরক্ষীয় এলাকায় জড়ো হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানেও বেঁচে থাকার উপযুক্ত তাপ পাবে না৷ যখন জীবজগতের শেষ চিহ্ণটুকুও মুছে যাবে, আমাদের পৃথিবী তখন নির্বাপিত চাঁদের মতো জমে যাওয়া একটা গোলক হিসাবে নিভে যাওয়া সূর্যের চারপাশে গভীরতম অন্ধকারে ক্রমশ ছোট হয়ে আসা কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত একদিন তার ওপরে গিয়ে পড়বে৷ কোনও কোনও গ্রহের এই অবস্থা হবে পৃথিবীর আগেই, কোনটার হবে পরে৷ সুসংবদ্ধ রূপে সাজানো গ্রহ–উপগ্রহদের নিয়ে তৈরি উজ্জ্বল, উত্তপ্ত সৌরজগতের বদলে একটা ঠাণ্ডা, মৃত গোলক মহাশূন্যের মধ্যে তার নিঃসঙ্গ পথ পরিক্রমা করতে থাকবে৷ আমাদের সৌরজগতের যে পরিণতি হবে, আগে হোক বা পরে, সেই একই পরিণতি হবে মহাজাগতিক দ্বীপের অন্যান্য জগতগুলিরও৷ অসংখ্য যে মহাজাগতিক দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে– এমনকি যেগুলির আলো, পৃথিবীতে সে আলো দেখার মতো জীবন্ত মানুষ থাকতে থাকতে কখনও এসে পৌঁছবে না– সেগুলির প্রতিটিরই এই পরিণতি ঘটবে৷

এ’রকম এক সৌরজগতের জীবন–ইতিহাস যখন সম্পূর্ণ হবে, যখন তা সসীম সকল বস্তুর শেষ পরিণতি মৃত্যুতে পৌঁছাবে, তারপর কী হবে? তারপর কি সূর্যের মৃতদেহটি মহাশূন্যের মধ্যে চিরকাল ধরে আবর্তিত হতে থাকবে এবং একদিন যেসব প্রাকৃতিক শক্তি অসীম বিচিত্র বিভিন্ন রূপে রূপায়িত হয়েছিল, সেই সমস্ত শক্তি চিরকালের জন্য একটিমাত্র গতি রূপে, অর্থাৎ আকর্ষণ রূপে পরিবর্তিত হয়ে যাবে?

না কি সেকি যেমন প্রশ্ন তুলেছেন,‘‘প্রকৃতিতে কি এমন কোনও শক্তি আছে যা আবার মৃত জগতকে জ্বলন্ত নীহারিকার মূল অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে? তাকে আবার নবজন্মের জন্য জাগিয়ে তুলতে পারে? তা আমরা জানি না৷’’

দু’য়ে দু’য়ে চার হয় বা বস্তুর আকর্ষণ দূরত্বের বর্গফল অনুযায়ী কমে বা বাড়ে– এই নিয়ম আমরা যেভাবে জানি, সবকিছু আমরা সেভাবে জানি না৷ প্রকৃতিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সামগ্রিকভাবে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি তাত্ত্বিক প্রকৃতিবিজ্ঞান গড়ে তুলেছে তাকে বাদ দিয়ে আজ এমনকি চিন্তাহীন নিছক অভিজ্ঞতাবাদীও চলতে পারে না৷ সেই তাত্ত্বিক প্রকৃতিবিজ্ঞানে বহু সময়ে আধা–জানা তথ্য নিয়ে চলতে হয়৷ এবং জ্ঞানের ত্রুটি সবসময়ই পূরণ করে নিতে হয় চিন্তার যুক্তিপূর্ণ সঙ্গতি দিয়ে৷ গতির অবিনশ্বরতার নীতিটি প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়েছে দর্শন থেকে৷ এই নীতি বাদ দিয়ে আজ প্রকৃতিবিজ্ঞান টিকে থাকতে পারে না৷ কিন্তু বস্তুর গতি মানে শুধু যান্ত্রিক গতি নয়, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া শুধু নয়৷ বস্তুর গতি মানে তাপ, আলো, বৈদ্যুতিক ও চৌম্বকশক্তি, রাসায়নিক সম্মিলন ও বিভাজন, প্রাণ ও সর্বশেষে চেতনা– এ সবই বস্তুর গতির নানা রূপ৷ যদি বলা হয়, অনাদিকাল থেকে বিদ্যমান বস্তু তার চিরকালীন অস্তিত্বের অতিক্ষুদ্র ভগ্ণাংশ সময়ের জন্য মাত্র একবারই তার গতিকে বিশেষ রূপে প্রকাশ করেছে এবং তার মধ্যেই গতির সমস্ত সম্পদ প্রকাশ করেছে, এবং তার পূর্বে আর পরে বস্তুর গতি চিরকাল ধরে শুধুমাত্র স্থান পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তা বলার মানে দাঁড়ায়, বস্তু নশ্বর ও তার গতিও ক্ষণস্থায়ী৷ গতির অবিনশ্বরতাকে কেবল পরিমাণগত ভাবে নয়, গুণগতভাবেও বুঝতে হবে৷ বস্তুর যান্ত্রিক গতি ও স্থান পরিবর্তনের মধ্যেই অনুকূল পরিবেশে তাপ, বিদ্যুৎ, রাসায়নিক ক্রিয়া–বিক্রিয়া এবং প্রাণে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নিহিত আছে৷ কিন্তু যে বস্তু নিজের ভেতর থেকে  সেই অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে না, এ’রকম বস্তুর গতি ‘বাজেয়াপ্ত গতি’, যে গতির বিভিন্ন উপযোগী রূপে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে, সে গতির তখনও ‘ডায়নামিস’ (সম্ভাব্যতা) থাকতে পারে বটে, কিন্তু ‘এনার্জিয়া’(কার্যকারিতা) থাকে না, এবং তাই তা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়েছে৷ দুই–ই কিন্তু অকল্পনীয়৷

এইটুকু নিশ্চিত যে, এমন এক সময় ছিল যখন আমাদের এই মহাজাগতিক দ্বীপটির পদার্থ এমন এক পরিমাণ গতিকে– সে গতিটি কী রকম তা অবশ্য এখনও আমরা জানি না– উত্তাপে রূপান্তরিত করেছিল, যা থেকে অন্তত দু’কোটি তারা সমেত (ম্যাডলারের মতানুযায়ী) বহু সৌরজগৎ বিকাশ লাভ করতে পেরেছিল, যার ক্রমিক বিনাশও সমান নিশ্চিত৷ এই রূপান্তর কীভাবে হল? আমাদের এই সৌরজগতের ভবিষ্যৎ ‘কাপুট মরটাম’ (মূল্যহীন অবশেষ) আবার কোনও দিন নতুন সৌরজগতের কাঁচামালে পরিবর্তিত হবে কি না, সে বিষয়ে, ফাদার সেকি যেমন, আমরাও তেমনই খুব কম জানি৷ কিন্তু তাহলে, হয় আমাদের নির্ভর করতে হবে একজন সৃষ্টিকর্তার উপর, অথবা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আমরা বাধ্য হব যে, আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সৌরজগতের ভাস্বর কাঁচামাল প্রাকৃতিক উপায়ে, গতিশীল পদার্থের মধ্যে প্রকৃতিগত ভাবে অন্তর্নিহিত গতিরই রূপান্তরের ফলে উদ্ভূত হয়েছে৷ এবং তাই এই উদ্ভবের পরিস্থিতি অবশ্যই পদার্থ দ্বারাই পুনরায় সৃষ্টি হবে, এমনকি কোটি কোটি বছর পরে হলেও এবং কমবেশি আকস্মিক ভাবে হলেও, যে আকস্মিকতার মধ্যে নিহিত থাকে অবশ্যম্ভাবিতা৷

এইরকম রূপান্তরের সম্ভাবনা ক্রমেই বেশি করে স্বীকৃত হচ্ছে৷ ক্রমেই এই ধারণায় আমরা পৌঁছাচ্ছি যে, জ্যোতিষ্ক্গুলি শেষপর্যন্ত একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটাবে৷ সেই সংঘর্ষ থেকে কতটা তাপ উদ্ভূত হতে পারে তাও গণনা করে বের করা হচ্ছে৷ হঠাৎ করে কোনও নতুন তারার জ্বলে ওঠা অথবা পরিচিত তারার ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যাওয়ার যে সব ঘটনা জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে আমরা জানতে পারি, তা এই সংঘর্ষের ধারণা দিয়ে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়৷ আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলিই শুধু সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে না, আবার সেই সূর্যই কেবল মহাজাগতিক দ্বীপে ঘুরছে না, এমনকী মহাজাগতিক দ্বীপটাও মহাশূন্যে অন্যান্য মহাজাগতিক দ্বীপের সাথে সাময়িক ও আপেক্ষিক ভারসাম্য রক্ষা করে ছুটে চলেছে৷ কেননা, স্বাধীনভাবে গতিশীল বস্তুগুলির এমনকি আপেক্ষিক ভারসাম্যও তখনই থাকতে পারে, যখন বিভিন্ন গতি একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ অনেকেরই ধারণা মহাকাশের সর্বত্র তাপমাত্রা সমান নয়৷ আমরা এও জানি যে, অতি সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, মহাজাগতিক দ্বীপের অসংখ্য সূর্যের তাপ মহাশূন্যেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তার দ্বারা মহাকাশের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের লক্ষ ভাগের একভাগও বাড়ছে না৷ এই বিপুল পরিমাণ তাপ যায় কোথায়? মহাকাশকে ডত্তপ্ত করার প্রয়াসে তা কি হারিয়ে যাচ্ছে? তার কি বাস্তব অস্তিত্ব আছে না কি  তার অস্তিত্ব শুধু তত্ত্বে? এর দ্বারা মহাশূন্যের তাপ এক ডিগ্রির হাজার কোটি ভাগের একভাগ বেড়েছে– এটা মেনে নিলে গতির অবিনশ্বরতার নিয়মকেই অস্বীকার করা হয়৷ তাতে এই সম্ভাবনাই মেনে নেওয়া হয় যে, জ্যোতিষ্ক্গুলি ক্রমাগত একে অপরের উপর আছড়ে পড়ায় যাবতীয় যান্ত্রিক গতি তাপে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং তা মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ছে৷ তাহলে ধরে নিতে হবে ‘শক্তির অবিনশ্বরতা’র নিয়ম থাকা সত্ত্বেও সাধারণভাবে সকল গতির অবসান হবে৷ (এ থেকে লক্ষ করা যায়, ‘গতির অবিনশ্বরতা’র বদলে ‘শক্তির অবিনশ্বরতা’ বলাটা কত অসঙ্গত)৷ তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত করতে হয় যে, মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়া তাপ কোনও ভাবে অন্য ধরনের গতিতে রূপান্তরিত হতে সক্ষম, যে গতি আবার সঞ্চিত ও সক্রিয় হয়ে ডঠতে পারবে৷ কীভাবে তা হয়, তা দেখানো হবে ভবিষ্যতের প্রকৃতিবিজ্ঞানের কর্তব্য৷ একমাত্র এই সিদ্ধান্ত নিলেই, নির্বাপিত সূর্যের আবার জ্বলন্ত বাষ্পে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাটা দূর হয়৷

তাছাড়া অন্তহীন কালে একের পর এক নতুন জগতের সৃষ্টি ও বিলোপের চিরন্তন পুনরাবৃত্তিই হল, অসীম মহাশূন্যে অসংখ্য জগতের একই সঙ্গে অবস্থানের ধারণার সঙ্গে যুক্তিসম্মত ভাবে সঙ্গতিপূর্ণ৷ এই নীতির প্রয়োজনীয়তাকে ড্রেপারের মতো তত্ত্ববিরোধী ইয়াঙ্কি মস্তিষ্কও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে (‘অনন্ত মহাশূন্যে জগতের অসংখ্যতা থেকে এই ধারণাই আসে যে, অনন্তকালের ক্ষেত্রে জগৎসমূহের ক্রমপর্যায় চলেছে’ : ড্রেপার, ‘ইউরোপের মনন বিকাশের ইতিহাস’, দ্বিতীয় খণ্ড – এঙ্গেলসের টিকা)৷

এ হল পদার্থের গতির এক চিরন্তন চক্র৷ এই চক্রের একপাক ঘুরতে যে বিশাল সময় লাগে তা মাপার পক্ষে জাগতিক বছর খুবই ছোট৷ এই চক্রের সর্বোচ্চ বিকাশ জৈবজগতের ডদ্ভবকাল, আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, আত্মসচেতন এবং প্রকৃতি–সচেতন জীবের জীবনকালটুকু ঠিক তেমনই নগণ্য যেমন নগণ্য সেই জীবন ও আত্মচৈতন্যের ক্রিয়াক্ষেত্রটুকু৷ এই চক্রে বস্তুর প্রতিটি সুনির্দিষ্ট রূপ, তা সে সূর্যই হোক আর বাষ্পীয় নীহারিকাই হোক, একটা প্রাণীই হোক আর প্রাণীর একটা বর্গই হোক, রাসায়নিক সংযোজনই হোক বা বিয়োজন– সবই সমান ক্ষণস্থায়ী, কিছুই চিরন্তন নয়৷ চিরন্তন কেবল চিরকালীনভাবে গতিশীল পদার্থ এবং তার গতি ও পরিবর্তনের নিয়মগুলি৷ কিন্তু স্থান ও কালের মধ্যে যত বার ও যত অবিরাম ভাবে এই চক্র পরিপূর্ণ হোক না কেন, কোটি কোটি সূর্য ও পৃথিবীর উদ্ভব ও বিলোপ হোক না কেন, জৈবজীবন উদ্ভবের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে যত দীর্ঘ সময়ই লাগুক না কেন, জীবের মধ্যে থেকে স্বল্পকালের জন্য জীবনধারণের উপযোগী অনুকূল পরিবেশ পেয়ে চিন্তা করার ক্ষমতাসম্পন্ন মস্তিষ্ক্বিশিষ্ট প্রাণীর উদ্ভব ও পরে নির্মমভাবে ধ্বংস হওয়ার আগে যত অসংখ্য রকমের জীবের বিকাশ ও বিনাশ ঘটুক না কেন, এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত যে সমস্ত ধরনের রূপান্তরের মধ্যে পদার্থ চিরকাল একরকমই থেকে যায়, তার কোনও বৈশিষ্ট্যই কখনও হারিয়ে যেতে পারে না এবং সেই কারণেই যে অমোঘ অবশ্যম্ভাবিতায় তা তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি– চিন্তাশীল মননকে নিশ্চিহ্ণ করবে, সেই একই অমোঘ অবশ্যম্ভাবিতায় অন্য কোনও স্থানে, অন্য কোনও কালে আবার তার উদ্ভব ঘটাবে৷(শেষ)