পরিযায়ী শ্রমিকদের খোঁজই রাখে না কেন্দ্রীয় সরকার

করোনা পরিস্থিতিতে ভারতের সাধারণ মানুষের অবস্থাটা কেমন? ভাবতে গেলেই কয়েকটি মর্মান্তিক দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। অস্থির করে দেয়। ভাবায়, এমনটা হওয়া কি অবশ্যম্ভাবী ছিল! সেই ছোট্ট শিশুটা, যে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে মায়ের চিরনিদ্রা ভাঙানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছিল– ভোলা কি যায়! কিংবা সেই রেললাইনে ছড়িয়ে থাকা রক্তমাখা রুটি আর জুতোগুলি, ঘরে ফেরার জন্য মরিয়া অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের ব্যর্থ চেষ্টার শেষ নিদর্শন হয়ে যেগুলি কাঁদিয়েছে বহু মানুষকে। ভুলতে পারবে দেশের মানুষ সেই বাবাকে, যিনি শত শত মাইল হেঁটে চলতে চলতে নিজের কোলে তৃষ্ণার্ত সন্তানের মৃত্যু দেখেছেন!

অথচ কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার লোকসভায় জানিয়ে দিয়েছেন, লকডাউনের কারণে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে এমন কোনও তথ্য সরকারের কাছে নেই। কারণ, এমন তথ্য রাখার কোনও রেওয়াজই সরকারের নেই। মন্ত্রীমশাই বড় উপকার করলেন। কারণ এ দেশের সরকার যে খেটে খাওয়া মানুষকে মানুষ বলেই মনে করে না, তা বোঝাতে এই একটি বাক্যই যথেষ্ট। এরপর আর আলাদা করে বুঝতে হয় না, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকের এই নিদারুণ দুর্দশা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কেন একটি বাক্যও ব্যয় করার দরকার বোধ করলেন না! কেন শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালানোর কথা ভাবতে কেন্দ্রীয় সরকারের একমাসেরও বেশি সময় লাগল! ঘরে ফিরতে চাওয়া শ্রমিকদের খুব সামান্য অংশেরই তাতে ঠাঁই হলেও দীর্ঘ পথে ট্রেনের অব্যবস্থায় বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, রেলের হিসাবেই ৯৭ জন মারা গেলেন। সারা দেশের মানুষ জানে মাত্র চার ঘন্টার নোটিসে আকস্মিক লকডাউন জারি করার ফলে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের জীবনে কী বিপর্যয় নেমে এসেছিল। লক্ষ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে হলেও ঘরে ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।

অথচ দেশে যে কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিক ছড়িয়ে আছেন, তাঁদের মাথা গোঁজার ঠাঁই থেকে শুরু করে প্রতিদিনের সামান্য খোরাক কীভাবে জোটে তা কেন্দ্রীয় সরকারের জানা ছিল না তা তো নয়! লকডাউন হলে যে এই শ্রমিকদের রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে, মালিকরা থাকতে দেবে না, এ কথাও কেন্দ্রীয় সরকার জানত। তাহলে লকডাউন ঘোষণার আগেই এঁদের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থার কথা ভাবল না কেন সরকার? লক্ষ লক্ষ নাগরিককে এভাবে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে কোনও সভ্য দেশের সরকার? ভারত সরকার পেরেছে। কারণ তারা তো এই মানুষদের ভরসায় গদিলাভ করেনি। যে টাকার থলির মালিকদের ভরসায় মন্ত্রীত্বলাভ, তাদের সরকার ঠিকই দেখেছে। সরকার এই কোটি কোটি মানুষের দায়ভার ঝেড়ে ফেলেছে প্রথমেই। তাই লকডাউনে বেতন যাতে চালু থাকে তা দেখার কথা প্রধানমন্ত্রী মুখে একবার বললেও ক’দিন যেতে না যেতেই সরকারতা অস্বীকার করল। এমনকী সরকারের বক্তব্য শিরোধার্য করে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতিপর্যন্ত মন্তব্য করলেন, খাবার দেওয়া হলে পরিযায়ী শ্রমিকদের আবার বেতনের দরকার কী? মালিকরাও বুঝে গেল সরকার নিজেই যে দায় ঝেড়ে ফেলেছে, তাদেরও সে দায় বহন করবার দরকার নেই। ফলে শুধু পরিযায়ী নয়, অসংগঠিত ক্ষেত্রের অগণিত শ্রমিক মৃত্যুর মুখেই দাঁড়ালেন।

অথচ পরিসংখ্যান রাখা কি খুব মুশকিল ছিল? যে সরকার সিএএ-বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দেওয়ার অপচেষ্টায় উমর খালিদদের বিরুদ্ধে ১১লক্ষ পাতার তথাকথিত ‘প্রমাণ’ সাজাতে পারে, ডাক্তার কাফিল খানের বিরুদ্ধে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা সাক্ষ্য সাজাতে পারে, বাড়ি বাড়ি ঘুরে পূর্বতন চতুর্দশ পুরুষের ঠিকুজি-কুলুজি পর্যন্ত টেনে বার করার পরিকল্পনা নিতে পারে– তারা রাস্তায় হাঁটা এই মানুষগুলির জীবনের খোঁজ রাখতে পারে না! তাছাড়া, শ্রমমন্ত্রী যেদিন কোনও তথ্য নেই বলেছেন তার পরের দিনই রেল দপ্তর বলেছে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের ৯৭ জন যাত্রী পথে মারা গেছেন। আরও তথ্য সংগ্রহ করেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। দেশের এবং বিদেশের আইন ও সমাজতত্ত্বের ৬ জন গবেষক তাঁদের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘তেজেশজিএন.কম’ নামে ব্লগে প্রকাশ করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে এই লকডাউনের সরাসরি ধাক্কায় ৪ জুলাই পর্যন্ত ৯৭১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তার মধ্যে ২১৬ জন অনাহারে, ২০৯ জন পথ এবং রেল লাইনের দুর্ঘটনায়, ৭৭ জন পথ চলার সময় চিকিৎসা না পেয়ে, ৪৭ জন পথচলার ক্লান্তিতে প্রাণ হারিয়েছেন। পুলিশের বর্বর আচরণে প্রাণ গেছে ১২ জনের (দ্য ওয়্যার, ১৬.০৯.২০২০)। ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকা লকডাউনে ঘরে ফেরার পথে মৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখেই প্রকাশ করেছে। যাতে দেখা যাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনায় শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ, দ্বিতীয় মধ্যপ্রদেশ। বিজেপির ‘সোনার রাজত্বে’র দুটি উজ্জ্বল মুকুটই বটে! অর্থাৎ পরিসংখ্যানে ঘাটতি থাকার কথাটা সত্য নয়।

শুধু পরিযায়ী শ্রমিকই নয়, দেশের আসল মালিক পুঁজিপতি শ্রেণির বিশ্বস্ত আজ্ঞাবহ হিসাবে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার লকডাউনের সুযোগে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে শ্রমিকদের এতদিনের অর্জিত সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। উত্তরপ্রদেশ সহ আরও কয়েকটি রাজ্যে ৮ ঘন্টার বদলে শ্রমদিবসকে ১২ ঘন্টা করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের যখন খুশি ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীদের যতটুকু অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ছিল, সেগুলি এক এক বিলুপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল কংগ্রেস আমলেই। বিজেপি তাকে সম্পূর্ণ করেছে।

অথচ বেসরকারি মালিকদের যথেচ্ছ শ্রমিক শোষণের উপর লাগাম পরানোর কোনও ইচ্ছাই সরকারের নেই। তাই দেখা যাচ্ছে, ফোর্বস পত্রিকার বিচারে এই লকডাউনের মধ্যেই ভারতে ১০০ বিলিয়ন ডলারের মালিকের সংখ্যা বেড়েছে ১৫ জন। ভারতীয় ধনকুবের মুকেশ আম্বানি এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ধনী বলে পরিচিত হয়েছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না বিজেপি সরকার তার প্রকৃত প্রভুদের সেবায় এতটুকু ঢিলে দেয়নি। তাই দিনে দিনে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে যাচ্ছে শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষ আর সেই সম্পদ গিয়ে জমছে ধনকুবেরদের সিন্দুকে। এটাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিয়ম। আর সেই ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্যই সরকার। স্বাধীনতার পর থেকে যে কাজটা কংগ্রেস করেছে, এখন তা করছে বিজেপি।

বিজেপি সরকার যে নির্লজ্জ নিষ্ঠুরতায় পরিযায়ী শ্রমিকদের দায় ঝেড়ে ফেলেছে তা একদিকে তাদের নির্লজ্জ, নিষ্ঠুর ফ্যাসিস্ট চরিত্রকে উন্মুক্ত করেছে। একই সাথে তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর জনবিরোধী চেহারাটাকে সামনে এনেছে। বিজেপিকে চেনার পাশাপাশি এই ব্যবস্থার স্বরূপটিকে চিনতে ভুল হলে তাই চলবে না।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ৬ সংখ্যা_২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০)