নাগরিকত্ব নিয়ে বিজেপির প্রচার সঠিক নয়

ভারতের রাজপথ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার৷ ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে রাজ্যে রাজ্যে দিবারাত্র অবস্থান–বিক্ষোভ ধরনা চলছে শান্তিপূর্ণভাবে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে৷ যতদিন যাচ্ছে আন্দোলনের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে৷ ছাত্র–যুব সমাজ এই আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছেন৷ মহিলারাও সদ্যোজাত সন্তান  নিয়ে শারীরিক অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে অবস্থান বিক্ষোভে সামিল৷ আন্দোলনের পিছনে বিরাট সামাজিক সমর্থন ছাড়া এ জিনিস কল্পনাতীত৷ জাতি–ধর্ম–বর্ণের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই আন্দোলন সম্পূর্ণ গণচরিত্র অর্জন করেছে৷ এই রকম একটি সর্বজনীন গণআন্দোলনকেও নূ্যনতম মূল্য দিচ্ছে না কেন্দ্রের মোদি সরকার৷ প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুঙ্কার দিয়েছেন সিএএ লাগু হবেই৷ সরকারের এই মনোভাব লড়াইকে আরও তীব্র করে তুলছে৷ রাস্তাই একমাত্র রাস্তা বলেছিলেন এক কবি৷ সেই রাস্তাই এখন বাঁচার রাস্তা দেখাচ্ছে৷ পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাপটে বিজেপি সরকার যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করিয়েছে, এই আন্দোলন পণ করেছে তাকে ছুঁড়ে ফেলার৷ সরকারও হাত গুটিয়ে বসে নেই৷ আন্দোলন দমনে বহুবিধ পথের সাথে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কৌশলও অব্যাহত রেখেছে৷ সেই বিভ্রান্তির জবাবে কী বলছেন, আন্দোলনকারীরা?

 

প্রশ্ন : মোদি সরকার একটা ভাল আইন করেছে ওদেশ থেকে আসা অসহায় মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য৷ আপনারা তার বিরোধিতা করছেন কেন?

উত্তর : আপনি কী করে বুঝলেন আইনটা ভাল? আপনি কি গভীরে ভেবে দেখেছেন তথাকথিত এই ‘ভাল’ আইন আপনাকে কোন ফাঁদের মধ্যে ফেলবে? শুনে রাখুন, এই আইনে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য প্রথমেই আপনাকে হলফনামা দিয়ে ঘোষণা করতে হবে, আপনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে এ দেশে এসেছেন৷ অর্থাৎ আপনি নিজেই ঘোষণা করলেন, আপনি এ দেশের নন, বিদেশি৷ এই ঘোষণার ফলে আপনার ভোটার কার্ড, রেশনকার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড  ইত্যাদির বৈধতাও প্রশ্নের সামনে পড়ে যেতে পারে শাস্তির মুখেও পড়তে পারেন৷ কারণ আপনি সরকারি কর্তৃপক্ষকে ভুল তথ্য দিয়ে এইসব কার্ড করিয়ে নিয়েছেন৷ শাস্তির মুখে পড়তে পারেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মীরাও৷

দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকারের নেতামন্ত্রীরা বলছেন, নাগরিকত্বের জন্য আবেদনপত্রের সাথে আপনাকে দিতে হবে ধর্মের প্রমাণপত্র৷ কোত্থেকে জোগাড় করবেন ধর্মের প্রমাণ? ধর্মের সার্টিফিকেট দেওয়ার অধিকারী কোন সংস্থা? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বলেছে, নিজের দেশের বিভিন্ন সরকারি নথিতে যে ধর্মের উল্লেখ করেছেন, সেই ধাঁচের কোনও কাগজ ভারত সরকারের কাছে দিতে হবে৷ প্রশ্ন হল, যাঁরা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশ ছেড়ে, একবস্ত্রে এ দেশে এসেছেন, তাঁরা কোথায় পাবেন কাগজপত্র৷

তৃতীয়ত, শুধু ধর্মের প্রমাণ দিলেই হবে না৷ আপনাকে সরকারি দলিলপত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে, উক্ত দেশগুলিতে আপনি ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে এ দেশে এসেছেন৷ এটা কীভাবে প্রমাণ করবেন? আপনার উপর অন্য ধর্মের লোকেরা আক্রমণ করেছে তার কোনও ফটো বা ভিডিও রেকর্ডিং আছে? আপনি কি বাংলাদেশ থেকে আসার সময় ওখানকার থানায় অভিযোগ করে এসেছেন যে, আপনি ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন? সেই অভিযোগের কপি আপনার আছে? মনে রাখবেন, কোনও স্তরেই মৌখিক স্বীকারোক্তির কোনও মূল্য নেই৷

প্রশ্ন : কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যে বলছেন, কোনও কাগজপত্র লাগবে না?

উত্তর : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই মৌখিক বিবৃতির কোনও মূল্য নেই৷ তাঁর দপ্তরের লিখিত  নিয়ম হল, নাগরিকত্বের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হবে, সঙ্গে দিতে হবে অবিভক্ত ভারতে বাবা অথবা মায়ের যে কোনও একজনের জন্মের সার্টিফিকেট৷ সেটা বাংলাদেশ থেকে আসা ক’জন শরণার্থী দিতে পারবেন? অবিভক্ত ভারতে, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের আগে জন্মের সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা আদৌ ছিল না৷ জন্মের সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু ১৯৭০ সালের পর৷ তার আগে যাঁরা জন্মেছেন, কোথায় পাবেন তাঁরা বার্থ সার্টিফিকেট?

প্রশ্ন : কিছু লোক তো কাগজপত্র জোগাড় করে এই আইনের সুফল নিতে পারেন?

উত্তর : আপনি কি ভাবছেন, কাগজপত্র সহ জেলাশাসকের কাছে আবেদন করলেই নাগরিকত্ব মিলবে? সরকারি কর্তৃপক্ষ আপনার কাগজপত্র যদি বৈধ মনে না করে? আপনি তো আগে এফিডেভিট করে বলেছেন, অন্য দেশ থেকে এসেছেন৷ নিজেকে ঘোষণা করেছেন ‘বিদেশি’, এদিকে নাগরিকত্বও পেলেন না! তা হলে ঠাঁই হবে কোথায় জানেন? ডিটেনশন ক্যাম্পে অথবা সরকারি জেলে?

প্রশ্ন : তা হলে, আপনারা শরণার্থীদের নাগরিকত্বের সমস্যাটির কীভাবে সমাধান চান?

উত্তর : আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য, ভারতের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত পূর্বেকার আইনের ভিত্তিতেই নাগরিকত্ব দেওয়া সম্ভব৷ পুরনো আইনেই যে দেওয়া সম্ভব এবং মোদি সরকার তা দিয়েছে, সে বিষয়ে ১৯ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন একটি তথ্য সংবাদমাধ্যমকে দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, গত ৬ বছরে ২,৮৩৮ জন পাকিস্তানি, ৯১৪ জন আফগান, ১৭২ জন বাংলাদেশি শরণার্থী নাগরিকত্ব পেয়েছেন৷ তা হলে নতুন আইনের প্রয়োজন কোথায়? ভোটার কার্ডই তো নাগরিকত্বের অন্যতম প্রমাণ৷ তার ভিত্তিতেই সরকার জনগণকে নাগরিকত্ব দিক৷ এ জন্য জনগণকে এত হয়রানির মধ্যে ফেলা কেন?

প্রশ্ন : কিন্তু বিজেপি নেতারা যে বলছেন, ভোটার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়?

উত্তর : এটা বিজেপি–নেতামন্ত্রীদে গা–জোয়ারি বক্তব্য৷ ১৯৫০ সালের নাগরিকত্ব আইন বলছে, নাগরিক মাত্রেই ভোটার৷ যে দুটি শর্তের ভিত্তিতে ভোটার কার্ড হয় তার একটি হল, ১৮ বছর বয়স, অন্যটি ভারতীয় নাগরিকত্ব৷ অমিত শাহদের বক্তব্য অনুযায়ী ভোটার কার্ডকে যদি নাগরিকত্বের প্রমাণ না ধরা হয়, তা হলে, নির্বাচিত সাংসদরা হবে অ–নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত৷ অতএব সাংসদরাও হবেন অবৈধ৷ মন্ত্রীসভা অবৈধ, সংসদ অবৈধ, তা হলে অবৈধ সংসদে পাশ করা আইন বৈধ হয় কী করে?

প্রশ্ন : কিন্তু অনুপ্রবেশকারী বিতাড়ন যে জরুরি– সেটা তো মানবেন?

উত্তর : অবশ্যই৷ কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, অনুপ্রবেশ ঘটছে কী করে? কেন্দ্রীয় সরকার কি ঠিকমতো সীমান্ত সুরক্ষা করতে পারছে? বি এস এফ তো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই৷ গোয়েন্দা বিভাগও কেন্দ্রের হাতে৷ সীমান্ত প্রাচীর নির্মাণও সরকার করেনি৷ কাঁটাতারের বেড়া বহু জায়গায় দেয়নি৷ প্রথম প্রয়োজন অনুপ্রবেশ আটকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে বাধ্য করা৷ দাবি তোলা দরকার, সীমান্ত সুরক্ষায় সরকারি গাফিলতি বন্ধ কর৷ সরকার যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়ার পরও যদি কোনও অনুপ্রবেশকারী ঢুকে যায় এবং ধরা পড়ে তা হলে আন্তর্জাতিক আইন মেনে তিনি যে দেশের নাগরিক সেই দেশের হাতে তাঁকে প্রত্যর্পণ করতে হবে৷ তার আগে উক্ত ব্যক্তি যে বিদেশের নাগরিক তা ভারত সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে৷

প্রশ্ন : এনপিআর–এনআরসি–র বিরোধিতা করছেন কেন? নাগরিকদের সম্পর্কে জানার অধিকার কি সরকারের নেই?

উত্তর : নিশ্চয়ই আছে৷ কিন্তু আপনি বলুন, জনগণ সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য কি সরকারের হাতে নেই? প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের সম্পর্কে তথ্য সরকার সংগ্রহ করে চলেছে৷ সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ১২৩ কোটিরও বেশি মানুষের আধার কার্ড হয়ে গেছে৷ তার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের বহু ব্যক্তিগত তথ্য, ‘ডেমোগ্রাফিক ইনফরমেশন’, ‘বায়োমেট্রিক ইনফরমেশন’ সরকার পেয়ে গেছে৷ ফলে সরকারের হাতে জনগণ সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে৷ এর পর এনপিআর কি উদ্দেশ্যে? সরকার কি এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে জনস্বার্থে কিছু করবে? এতে বাবা–মায়ের জন্মস্থানের উল্লেখ করতে বলা কী উদ্দেশ্যে? এর সাথে জনগণনার সম্পর্ক কোথায়? তা ছাড়া এই লিস্ট ভবিষ্যতে কোনও অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হবে না তা কে বলতে পারে আমরা তো ইতিমধ্যেই জেনেছি, হাজার হাজার আধার কার্ডের নথি পাচার হয়েছে৷

প্রশ্ন : বিজেপি বলছে, ‘নাগরিকত্ব (সংশোধনী) অধিনিয়ম ২০১৯–এর প্রয়োজনই হত না যদি ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ না হয়ে থাকত’৷ এর ফলেই শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে৷ সেই শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিলে আপনাদের আপত্তি কেন?

উত্তর : নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে আপত্তি নয়৷ আন্দোলনকারীদের স্পষ্ট বক্তব্য, সরকার যাঁদের শরণার্থী বলছে, তাঁরা ভারতেরই নাগরিক৷ সরকার বলুক, সে কেন এঁদের নাগরিক বলছে না? দ্বিতীয়ত, সরকার যদি সত্যিই এঁদের নাগরিকত্বের অতিরিক্ত কোনও সার্টিফিকেট দিতে চায় তা হলে সহজ প্রক্রিয়ায় দিক৷

ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ যেমন ঐতিহাসিক ভুল, তেমনি ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব আইন করাও ঐতিহাসিক ভুল৷ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ নিয়ে বর্তমান বিজেপি নেতাদের বক্তব্য শুনে মনে হবে যেন, বিজেপি এর বিরোধী৷ কিন্তু ইতিহাস বলছে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের অন্যতম উদগাতা ছিলেন বিজেপির আদর্শগত গুরু হিন্দু মহাসভার নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার৷ এই মৌলবাদী নেতা ১৯২৩ সালে ‘হিন্দুত্ব’ নামক বইয়ে লিখেছেন, ‘হিন্দু ও মুসলিম’ দুটো আলাদা জাতি, তারা কখনওই একসঙ্গে থাকতে পারে না৷ সাভারকারের এই বিপজ্জনক চিন্তাকে মাথায় তুলে নিয়ে মুসলিম লিগ নেতা জিন্না মুসলিমদের জন্য পৃথক পাকিস্তানের দাবি তোলেন৷ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করতে এই দ্বি–জাতি তত্ত্বকে অত্যন্ত সুচতুর ভাবে কাজে লাগায়৷ কংগ্রেসের আপসমুখী নেতৃত্ব সরকারি গদির লোভে এই ভ্রান্ত দাবির পক্ষে দাঁড়ায়৷ তাছাড়া সাভারকরের দাবি অনুযায়ী ধর্ম ও জাতিকে সমার্থক করা অনৈতিহাসিক ধারণা৷ ইংরেজিতে ধর্ম হল রিলিজিয়ন, জাতি হল নেশন৷ দুটো আলাদা৷ হিন্দু, মুসলিম আলাদা ধর্ম৷ কিন্তু উভয়ই ভারতে একই জাতিসত্ত্বার অংশ৷ ফলে একসঙ্গে থাকতে পারে না– এ দাবি ঠিক নয়৷

শরণার্থী সমস্যার জন্য তো শরণার্থীরা দায়ী নন৷ এ জন্য দায়ী সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ও বুর্জোয়া দলগুলি এবং মৌলবাদী শক্তিগুলির উদগ্র ক্ষমতার লোভ এবং রাজনৈতিক অবস্থান৷ আজ স্বাধীনতার ৭০ বছর পর, ক্ষমতার স্বার্থে, হিন্দু–মুসলমান মেরুকরণ তৈরি করতে বিজেপি পুনরায় শরণার্থী সমস্যা খুঁচিয়ে তুলছে৷ ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগকে বর্তমান বিজেপি নেতৃত্ব অন্যায় মনে করলে ধর্মের ভিত্তিতে নতুন নাগরিকত্ব আইন সিএএ আনল কেন? একটা অন্যায়ের প্রতিকার কি আরেকটা অন্যায় হতে পারে?

১৯৫০ সালের যে নেহরু–লিয়াকত চুক্তির কথা বিজেপি বলছে, তাতেও বলা হয়েছে, ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা৷ ফলে বিজেপির বর্তমান অবস্থান নেহরু–লিয়াকত চুক্তির বিপরীত৷ পাকিস্তান নেহরু–লিয়াকত চুক্তি অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেনি৷ একইভাবে ভারতেও বিজেপি শাসনে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিঘ্ণিত হওয়ার বহু ঘটনা ঘটছে৷ দুই দেশের এই ঘটনাক্রম দেখাচ্ছে, উভয় দেশের বুর্জোয়া সরকার জনগণের ঐক্য ধ্বংস করতে ধর্মীয় বিভাজনকে কাজে লাগিয়েছে৷ বুর্জোয়া সরকার জনজীবনের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ৷ এই দিক থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে এই ধর্মীয় বিভাজনকে কাজে লাগাচ্ছে৷ পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুর নিরাপত্তা বিঘ্ণিত করার পিছনে বা ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিরাপত্তা বিঘ্ণিত হওয়ার পিছনে সংশ্লিষ্ট মৌলবাদীরাই শুধু দায়ী নয়, দায়ী শাসক বুর্জোয়া শ্রেণিও৷ এই বিষয়টি ভুক্তভোগী জনসাধারণকে মনে রাখতে হবে৷

প্রশ্ন : আপনাদের আপত্তির আর কী কারণ আছে?

উত্তর : আমাদের আপত্তির অন্যতম বড় কারণ হল গরিব মানুষ সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বেন৷ এ দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষ যাঁদের কোনও নিজস্ব জমি নেই, বাড়ি, সম্পত্তি নেই৷ নেই কোনও ডকুমেন্ট বা নথি৷ যাঁরা জনজাতি, আদিবাসী, ভূমিহীন খেতমজুর, যাঁরা–নিরক্ষর, পেটের টানে যারা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে এখানে ওখানে কাজ করতে বাধ্য হন, তাঁরা কোথায় পাবেন ডকুমেন্ট? পুঁজিবাদী শোষণে, সরকারের জনবিরোধী শাসনে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সবকিছু হারিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা কী ডকুমেন্ট দেবেন? রেশনকার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ব্যাঙ্কের বই, জমির দলিল ইত্যাদি নাগরিক পরিচিতির প্রামাণ্য নথি সরকার খেয়ালখুশি মতো অস্বীকার করলে জনগণের হাতে আর কী থাকে দেওয়ার? সেজন্যই আমরা বলছি গরিব মানুষদের বিরুদ্ধে সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে৷

প্রশ্ন : কিন্তু আইন তো পাশ হয়ে গেছে৷

উত্তর : তাতে কি হয়েছে? জনগণ তো গ্রহণ করেননি৷ আইন জনস্বার্থে না হলে, মানুষ আন্দোলন করেই আইন পাল্টাবে৷ ইতিহাস এই সত্য প্রমাণ করেছে৷ আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য আইন–ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এ কথা বলেছিলেন ভগৎ সিং৷ সিএএ নামক যে আইন জনগণের গলায় আজ ফাঁস হয়ে বসতে চাইছে সেই আইন সরকার দ্রুত না পাল্টালে মানুষ জীবন দিয়ে তা রুখবেই৷

প্রশ্ন : এত বড় একটা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এ লড়াই  কত দিন চলতে পারে?

উত্তর : কতদিন চলবে তা নির্ভর করবে সরকারের মনোভাবের উপর৷ সরকার জনগণের দাবির প্রতি মূল্য দিয়ে সিএএ প্রত্যাহার করতে যত বেশি সময় নেবে, আন্দোলনও তত দীর্ঘস্থায়ী হবে৷ সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনগণকেও সঠিক পথে সংগঠিত হতে হবে৷

প্রশ্ন : একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে, তা হল সরকারের প্রতি জনগণের বিশ্বাসহীনতা৷ এর কারণ কী?

উত্তর : এর মূলে আসাম এনআরসি৷ আসামে হিন্দুর ত্রাতা সেজে, উগ্র মুসলিম বিরোধী জিগির তুলে, উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী শক্তির সঙ্গে জোট করে ক্ষমতাসীন হয়েছে বিজেপি৷ তার পরেই যে এনআরসি তালিকা তৈরি হয়েছে তাতে দেখা যায় ১৯ লক্ষের বেশি ভারতীয় নাগরিকের নাম বাদ গেছে, যার মধ্যে ১৬ লক্ষাধিকই হিন্দু৷ এতে শুধু আসামের মানুষই নন, সারা দেশের মানুষই বুঝে যান, হিন্দুর স্বার্থরক্ষা বিজেপির কাছে একটা রাজনৈতিক স্লোগান মাত্র৷ তার লক্ষ্য ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনে সংখ্যাগুরুর ভোট কব্জা করে ভোটে জয়৷ আর সংখ্যালঘুদের ভয় দেখিয়ে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা৷ কিন্তু তাতে সাধারণ হিন্দুর কী স্বার্থ রয়েছে? অর্থনৈতিক কোনও সংকটই সে সমাধান করতে পারেনি৷ মানুষ এই সরকারের প্রতি আস্থা রাখবে কী করে? সরকার অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প কোনও বিষয়েই প্রতিশ্রুতি রাখেনি এবং অসত্য ভাষণ করেই চলেছে৷ কী করে মানুষ বিশ্বাস করবে? ফলে এ লড়াই অনিবার্য৷ ইতিমধ্যে নৈতিকভাবে এই সরকারের পরাজয় ঘটে গেছে৷ ওদের অসৎ উদ্দেশ্য ইতিমধ্যেই উদঘাটিত৷৷ ওদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে নির্মূল করতে হলে সমাজ মনন থেকে সাম্প্রদায়িক চিন্তার অবশেষ দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় আদর্শগত সংগ্রাম তীব্র করা জরুরি৷

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ২৭ সংখ্যা)