নন্দীগ্রাম সিঙ্গুরের আন্দোলন কোনও নেতার রাজনৈতিক ঘুঁটির চাল নয়

সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের কথা আজ উচ্চারিত হচ্ছে দিল্লি-হরিয়ানার সীমান্ত এলাকা সিংঘুতে। শুধু সেখানেই বা কেন বলি, এ নাম বারবার উচ্চারিত হচ্ছে দিল্লি সীমান্তে আছড়ে পড়া কৃষক বিক্ষোভের সর্বত্র। নামদুটি বারবার উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধায়, ভারত সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে।

গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যে দৈত্যাকার করপোরেট কোম্পানির অর্থশক্তি আর তার দোসর সরকারি পেশি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ধরে তা দেখিয়ে দিয়েছে এই দুই আন্দোলন। তাই কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে ভোট-লোভী নানা রাজনৈতিক দল এই দুটি আন্দোলনের গুরুত্বকে কমিয়ে দেখাতে চায়, তাকে হেয় করার চেষ্টা করে। আর এক দল চেষ্টা করে আন্দোলনের উত্তাপে জল ঢেলে তাকে ভোটবাক্সে বন্দি করতে।

৯ মার্চ ২০০৭ কলকাতা

ঠিক এমন একটি চেষ্টা সম্প্রতি দেখা গেল ১১ নভেম্বর নন্দীগ্রামে ‘অপারেশন সূর্যোদয়’-এর প্রতিরোধের ১৩ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। রাজ্যের বর্তমান শাসক তৃণমূল কংগ্রেস দলের দুই গোষ্ঠী মেতে উঠল নন্দীগ্রাম আন্দোলনের গৌরবকে নিজের ভোটস্বার্থে কাজে লাগাতে। নন্দীগ্রামে সেদিন সভা হল দুটি। গোটা নন্দীগ্রাম ছেয়ে গেল নেতা-নেত্রীদের ছবির কাট আউটে। সংবাদমাধ্যমের গাড়ি ধুলো উড়িয়ে ছুটল নেতা-মন্ত্রীদের পিছনে পিছনে। নেতারা সব কতই না বত্তৃতা দিলেন, বললেন, অমুক নেতা অথবা নেত্রী না থাকলে নন্দীগ্রামকে উদ্ধার করত কে? কিন্তু ধর্ষক পুলিশ আর গুণ্ডা বাহিনীর নখারাঘাতে ছিন্নভিন্ন হতে হতেও তাদেররুখেছিলেন যে বীর নারীরা, শহিদদের পরিবার যাঁরা সেদিনের স্মৃতি বহন করছেন, তাঁরা রয়ে গেলেন আড়ালে। সংবাদমাধ্যম ফলাও করে লিখল, কোন নেতার ডাকে কত লোক জমায়েত হয়েছে। কে বড়? তার ফয়সালা নাকি হবে ভোটের বাক্সে  অথচ নন্দীগ্রাম যেদিন জীবন বাজি রেখে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইতে নেমেছিল, সেদিন কোনও ভোটের হিসাব তো সে করেনি! আজ তাকে ভোটের ঘুঁটি করে দেওয়া হচ্ছে। মানবে কী করে নন্দীগ্রাম!

২০০৭-এ তদানীন্তন সিপিএম সরকারের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার বহুজাতিক পুঁজি সালেম গোষ্ঠীর এসইজেড গড়ে তোলার জন্য ৪০ হাজার একর জমি দখলের প্রস্তুতি। একই সাথে শুরু হয় জনগণের প্রতিরোধ। গড়ে ওঠে ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’। দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ তাতে সামিল হন। শাসক সিপিএম সালেম গোষ্ঠীর লেঠেল বাহিনীর ভূমিকায় নামিয়েছিল তাদের কর্মী-সমর্থকদের। তাদের আক্রমণে নন্দীগ্রামের তিনজন কৃষক নিহত হন। গ্রামের পর গ্রাম ঘিরে চলতে থাকে হাড় হিম করা সন্ত্রাস। শাসকদল এবং পুলিশের মদতে ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, বোমাবাজি, গুলি, নারীর ইজ্জতহানি চলতেই থাকে। জনগণও রাস্তা কেটে, ব্যারিকেড তৈরি করে গড়ে তোলে প্রতিরোধ। ১৪ মার্চ পুলিশ আর শাসকদলের পোষা গুণ্ডা বাহিনী শান্তিপূর্ণ জমায়েতের উপর গুলি চালিয়ে ১৪ জনকে হত্যা করে।প্রতিরোধ ভাঙতে গ্রামে গ্রামে তারা গণধর্ষণের মতো বর্বর পথ নেয় তারা। এরপর কখনও তারা পাঠিয়েছে দিল্লির জামা মসজিদের ইমামকে, মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনগণকে আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে। কখনও তারা আন্দোলনের উপর মাওবাদী তকমা লাগাতে চেয়েছে। কিন্তু কোনও চক্রান্তই সফল হয়নি। নন্দীগ্রাম আন্দোলন শুধু রাজ্যের শাসক সিপিএম নয়, কেন্দ্রের কংগ্রেস, সেই সময়কার বিরোধী বিজেপি সকলেরই মুখোশ খুলে দিয়েছিল। নন্দীগ্রাম শিখিয়েছে, জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আর ভোটের স্বার্থে বাজার গরম করার জন্য লোক দেখানো আন্দোলনের ফারাক কোথায়। ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’র তিনজন প্রধান নেতা, ভবানী দাস, নন্দ পাত্র, আবু সুফিয়ানদের দুজন এস ইউ সি আই (সি), একজন তৃণমূল করতেন। কিন্তু এই আন্দোলনে তাঁরা রাজনৈতিক পরিচয়ে সামনে আসেননি। বস্তুত সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম দুটি ক্ষেত্রেই আন্দোলনের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিল এস ইউ সি আই (সি)। আন্দোলনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য প্রথম থেকেই গণকমিটি গড়ে তুলে ব্যাপক সংখ্যার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছিল এই দল। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করে আন্দোলনকে নেতাদের রাজা উজির বানাবার পথ হিসাবে ব্যবহার করার জঘন্য রাস্তা এই দল কোনও দিন নেয়নি। তাই সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম লড়াইয়ের এই জোর পেয়েছে। দল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেস এই আন্দোলনে এসেছে অনেক পরে। প্রথমে তাদের স্থানীয় নিচুতলার কর্মী সমর্থকরা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠার পর সংবাদমাধ্যমকে সাথে নিয়ে নামী-দামি নেতারা পৌঁছেছেন। ফলে মাটিতে থেকে যারা লড়ছিল, তারা চলে গেছে পিছনে। আর সংবাদমাধ্যম দেখিয়েছে যেন বাইরে থেকে আসা এই সব নেতাদের ম্যাজিকেই সব হয়েছে!

২০১১-তে ভোটে জেতার পর শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস নন্দীগ্রাম- সিঙ্গুরের আন্দোলনকে তাদের ক্যারিশমা প্রচারের হাতিয়ার করেছে। নন্দীগ্রামের অত্যাচারী পুলিশ অফিসারদের প্রমোশন দিয়ে নিজেদের কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করেছে। সিপিএম সরকার জনগণের বিরুদ্ধে যে সব মিথ্যা মামলা করেছিল সেগুলি প্রত্যাহারেও তাদের অনীহা দেখা গেছে।

আজ নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর উভয় আন্দোলন নিয়েই শাসকদলের অভ্যন্তরের গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যাপক প্রচার দিচ্ছে সংবাদমাধ্যম। এই পথে যত এই দুই আন্দোলনের মহত্ত্বকে খাটো করা হচ্ছে, তত সুকৌশলে জোরদার করা হচ্ছে কর্পোরেট স্বার্থের সেই প্রচার– সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রামকে সরকার দখল করতে পারলেই নাকি সোনা ফলত বাংলায়! অথচ সেই সময় বাংলার জাগ্রত বিবেক এই সমস্ত অসার যুক্তিকে নস্যাৎ করে দেখিয়েছিল, কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ মানে উন্নয়ন নয়। সারা ভারতে জমি অধিগ্রহণ আইন পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন। এই সংগ্রামের জয়কে ভুলিয়ে দিতেই নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের আন্দোলনকে তৃণমূলের এক এক জন নেতা-নেত্রীর রাজনীতির দাবার ছকের ঘুঁটি হিসাবে উপস্থিত করা হচ্ছে। এই অপচেষ্টা নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর তথা গোটা বাংলা মানতে পারে না।x

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ১৩ সংখ্যা_১৮ ডিসেম্বর, ২০২০)